বুধবার ● ২৪ অক্টোবর ২০১৮
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » হেমন্তের পরেই বৈচিত্র্যপূর্ণ শীতঋতু : গ্রামেও এখন প্রাণোচ্ছলতার আয়োজন খেজুর রস
হেমন্তের পরেই বৈচিত্র্যপূর্ণ শীতঋতু : গ্রামেও এখন প্রাণোচ্ছলতার আয়োজন খেজুর রস
নজরুল ইসলাম তোফা :: হেমন্তের শেষেই শীতঋতুর আগমন, শীতের কনকনে ঠান্ডায় বাঙালির প্রথমেই স্মৃতিপটে ভেসে উঠে যেন খেজুর গাছের মিষ্টি রস।আবহমান বাংলার চাষীরা সে রসে নিজেকে ডুবিয়ে নেয়ার নান্দনিক দৃশ্য না দেখলে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য একেবারেই বৃথা। হেমন্তের ফসল ঘরে উঠার পরপরই প্রকৃতির মাঝে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে, সেই শূন্যতার মাঝে আসলেই এমন শীতঋতুর আগমন ঘটে। উত্তরের মৃদু হাওয়াতে ঠান্ডা আমেজ, তা হেমন্ত ঋতুর পরেই যেন অনুভব হয়। এমন এই আগমনী বার্তাটা প্রকৃতিকে ঘোষণা করে থাকে খুুব শীঘ্রই শীত আসছে। শুষ্ক শীতল চেহারা নিয়ে আসে শীতঋতু। একঘেয়েমি যান্ত্রিকতার জীবনকে অনেক পরিবর্তন এনে থাকে এই শীত ঋতুচক্র। বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রামীণ সংস্কৃতির এমন এই শৈল্পীক ঐতিহ্যের চরম প্রাণোচ্ছলতায় আসলেই ঋতুচক্র বছর ঘুরেই দেখা দেয় বারবার।
হিমেল আবরণ টেনেই উপস্থিত হয় এমন শীত, তার চরম শুষ্কতা, নির্মম রুক্ষতা, পরিপূর্ন রিক্ততা আবার বিষাদের প্রতিমূর্তী হয়েও আসে এমন এই শীতঋতু।অপর দিকে, এমন শীতঋতু গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্ব পূর্ণ হয়ে উঠে, তাদের জীবনে শীত অর্থাৎ বিশেষ করে চাষীদের কাছে সে তো বিভিন্ন মাত্রায় হাজির হয়। স্বপ্ন আর প্রত্যাশায়, তাদের অনেক খানি খেজুর গাছের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবেই যেন আর্থিক উন্নয়নে বসবাস। চাষীর জীবন সংগ্রামে অনেক কষ্টের মাঝেও অনেক প্রাপ্তিই যুক্ত হয়। বাংলার জনপ্রিয় তরুবৃক্ষ খেজুর গাছের সঙ্গে ভূমিহীন চাষী, প্রান্তিক চাষী বা দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের জন্য এই সময়টা হয় অনেক আনন্দদায়ক। কারণ, গাছই তো চাষীর অন্নদাতা। খেজুর গাছে যত্ন-আত্তি না করলে ‘রস’ মিলবে না। আর রস না মিললে গুড় হবে কি করে। পাটালি না দেখলে যেন ঘুম আসে না চাষীর। চাষীরা তাদের মেয়ে কিংবা বউয়ের হাতের কাঁচা সুপারির কচি পান গালেপুরে যেন এক বাঁশের ডালি মাথায় করে গঞ্জে বা দূর্বতী হাটে যাবেই বা কি করে। পাটালি গুড়ের মিষ্টিমধুর গন্ধে চাষীরা বিক্রয় কাজে না থাকলে পেটে ভাতে বাঁচবে কি করে। শীত আমেজেই প্রকৃতির মাঝ হতে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য চাষীরা যেন চষে বেড়ায় সকাল, বিকেল এবং সন্ধ্যায় মেঠো পথ ধরে, তার বহিঃপ্রকাশে চমৎকার নান্দনিকতার সৃষ্টি কিংবা অপরূপ দৃশ্য পরিলিক্ষত হয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী মাঝে এমন এই দৃশ্য অবশ্যই শৈল্পীকতার নিদর্শন। এ শৈল্পীক আস্থা ও বিশ্বাসকে নিয়ে প্রকৃতির মাঝেই বিশাল আকৃতির এক কুয়াশা চাদরে মুড়ি দিতে হয়। শীতেকালে এ রূপ সৌন্দর্যের আর একটি উপাদেয় সামগ্রী ‘খাঁটি শরিয়া তেল’, যা শরীরে মালিশ করে অনেকাংশে ত্বকের মশ্রিণতা ও ঠান্ডা দূর করে। এভাবেই তেল মালিশে খেজুর গাছে উঠলে নাকি ঠান্ডা দূর হয়। এই শীতেই শাল, সেগুন, আমলকী, জামরুল, কৃষ্ণ চূড়া কিংবা শরিষের বনে লাগে হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া। শীতের এমন বাতাসে রিক্ততার সুর বেজে ওঠলেও অনেক চাষীর আর্থিক উন্নয়নে জন্য এই শীতঋতুই প্রিয়।
গ্রামাঞ্চলে খুব ভোরে অর্থাৎ সূর্য উদয়ের আগে, বহু খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে নামিয়ে আনতে চাষীর যেন কোনো প্রকার ক্লান্তি বা অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায় না । রাতের শেষে, কুয়াশার সকালে হিমশীতল ‘রস’ এমন হাড় কাঁপানি ঠান্ডাতে খাওয়ার স্বাদ একটু আলাদা। খুব ভোরে রস খেলে শীত আরো জাঁকিয়ে বসে। তবুও এমন শীতে শরীর কাঁপানি ঠান্ডার এক স্পন্দন যেন চরম মজা দায়ক। ভোররে এই প্রকৃতি তখন ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাক। ঠিক তখনই উত্তর দিকের প্রচন্ড হিমেল হাওয়ায় হাড়ে কাঁপন লাগিয়ে তীব্র শীত এসে জেঁকে বসে। সমগ্র প্রকৃতি সেসময় শীতের দাপটেই নির্জীব হয়। শীত লাগে লাগুক না, তবুও রস খাওয়ার কোন বিরাম নেই। এক গ্লাস, দুই গ্লাস খাওয়ার পর পরেই, কাঁপতে কাঁপতে যেন আরও এক গ্লাস মুড়ি মিশিয়ে মুখে তুলে চুমক দেয়া কিংবা রোদ পোহানোর যেকি আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা দূরহ। শীতের কুয়াশায় গ্রামাঞ্চলের ছেলে মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে খড় কুটোয় আগুন জ্বেলে হাত পা গরম করে।আবার তারা অপেক্ষা করে কখন যে রোদের তেজ প্রখর হবে। ‘রোদ’ পোহানো আরামের সঙ্গে আরও অপেক্ষা, তা হলো তাদের প্রিয় খেঁজুর ‘রস’। সে রস আসলে যথা সময়ে হাজির হলে তাদের কাছে যেন আনন্দ উল্লাসের কোনই কমতি হয় না। আবার যেন গ্রামের অভাবী মেয়েরা রংবে রংয়ের যে সব খেজুর পাতার খেজুর পাটি তৈরী করে তার উপর চলে রস খাওয়ার আসর। উপার্জনের জন্যেই ‘খেজুর পাতা’ শুকিয়ে তা দিয়েই “খেজুর পাটি” তৈরী। পরে বিক্রয় করে সংসারের কিছুটা অর্থ সংকোলান হয়। দেখাও যায় গ্রামের অনেক পরিবার খেজুর পাটিতে ঘুমানো কাজে তা ব্যবহার করে। ‘খেজুর পাতা’ এক ধরনের সাহেবী টুপিও তৈরি হয়। খেজুরের পাতা, ডাল এবং গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। আবার “মোরুব্বা” তৈরিতেই খেজুর গাছের কাটার ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, এই খেজুর গাছের পাতার এবং ডাল সেতো কবর পর্যন্ত ব্যবহার হয়।
শীতরে শুষ্কতায় অধকিাংশ বৃক্ষলতা পত্র-পল্লবহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু ‘খেজুর গাছের পাতা’ শক্ত হওয়ার জন্য ঝরে পড়ে না। তাই খেজুর পাতার বেড়া দিয়ে সেখানে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে। এ শীতে তাদের শরীরে বিভিন্ন রংয়রে শাল, জাম্পার, জাকেট, সোয়েটার, চাদর, কারো গলাতে মাফলার, কারো মাথায় গরম টুপি পরতে দেখা যায়। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ তীব্র শীত উপেক্ষা করেই কাজে বের হয়। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে কৃষক লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে মাঠে যায় এবং জমি চাষ করে ঘরে ফিরেই দুপুর থেকে খেজুর গাছ পরিচর্যা করে রসের হাঁড়ি লাগাতে ব্যস্ত হয়। চাষীরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান এ গাছে থেকে সে গাছে। মাটিতে পা ফেলার ফুরসতটুকুও পায় না এই মানুষ গুলো।শীত আসা মাত্রই খেজুর গাছ তোলার জন্য অনেক আগ থেকেই সকাল-সন্ধ্যায় যেন লেগে থাকে চাষী। খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। আর এই গাছ গুলোকে যারা কাটে তাদেরকে গাছি বলা হয়। বিভিন্ন উপকরণ সমন্বয়ে এই গাছি নাম ধারি মানুষ পরিচ্ছন্ন ভাবে গাছ কাটায় ব্যস্ত হোন। গাছ কাটতে ব্যবহার করে দা, দড়ি, এক টুকরো চামড়া বা পুরনো বস্তা আবার দা রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি থলি বা ঝাঁপি। সেই ঝাঁপি গাছিরা রশি দিয়ে খুব স্ব যত্নে ‘দা’ রেখে এ গাছ থেকে সে গাছে উঠা, নামা করে সুবিধা পায়। আবার তারা কোমরে বেশ কিছু চামড়া কিংবা বস্তা বেঁধে নেয় যেন গাছে উঠা নামায় কোন প্রকার সমস্যা না। গাছ কাটার জন্য ‘গাছি’ তাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার সময় কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়। এমন দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার সময় গাছি অতি সহজে মুহূর্তের মধ্যে গিঁট দুটি জুড়ে দিয়ে নিজের জন্য গাছে উঠার নিরাপদ ব্যবস্থা করে নেয়।
খেজুর গাছ ছয় সাত বছর বয়স থেকে ‘রস’ দেওয়া শুরু করে। পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত ‘রস’ দেয়। গাছ পুরনো হয়ে গেলে ‘রস’ কমে যায়। আর পুরনো খেজুর গাছের রস যেন খুুুব মিষ্টি হয় এবং তা মাঝ বয়সী গাছ থেকে সব চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করাও গাছের জন্য ক্ষতিকর। সেই “রস” সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু এবং এমন এই মাসেই গাছ থেকে রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে গাছ হতে রস ঝরার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যেন আছে। শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও ততই মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ মাস হলো রসের ভর মৌসুম। অগ্রহায়ণ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত একটি খেজুর গাছে মাসে চল্লিশ কেজি রস পাওয়া যেতে পাবে। খেজুর গাছ শুধু রস দিয়েই ক্ষান্ত হয় না। শুকনো ‘খেজুর’ হতেই অনেক ভেষজ গুন বিদ্যমান রয়েছে। খেজুরের বীজ গুলো বাহির করে নিয়ে “দুধে” খেজুর গুলো মিশিয়ে ভাল ভাবে ফুটিয়ে গরম করে এই দুধ, খেজুর ঠান্ডা করে শিশুকে খাওয়ালে শক্তি বাড়ে৷ তাই একটি শুকনো খেজুরের ফলের পুষ্টি মান তুলে ধরে বলা যায়, প্রায় ৭৫-৮০% শর্করা, প্রায় ২% আমিষ এবং প্রায় ২.৫% স্নেহজাতীয় পদার্থ থাকে। ১০০ গ্রাম শাঁসে থাকে, ২ ভাগ পানি, ৬০-৬৫ ভাগ শর্করা, ২ ভাগ আমিষ এবং খুব সামান্য , সালফার, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ, বি-১, বি-২ সহ কপার থাকে ও খনিজ লবণ খোঁজে পাওয়া যায়।
রস জ্বাল দিতে যে পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন তা পাওয়া যায় না এমন এ আক্ষেপে চাষীর বউ ঝগড়া করলেও চালের আটায় তৈরি ‘ভাপা পিঠা’ খেজুরের গাঢ় রসে ভিজিয়ে খাওয়ার পরে যেন সব রাগ মাটি হয়ে যায়। তাছাড়াও কখনও সখনও চাষীর বউ’কে এক প্রকার সান্তনা দিয়ে বলে অভাবের সংসারে যা আছে তা দিয়ে এই পেশা চালালে আমরা কিভাবেই বেঁচে থাকি? বছরে পাঁচ মাস ধরেই তো খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা হয় আর তাকেই খড়-কুটার জ্বালানিতে ‘গুড়’ বানিয়ে বাজারে বিক্রি হয় বলেই কোন মতে এই পেট চলে। চাষীর বউ আবার মুচকি হাসি দিয়েই বলে, সংসার চলছে তো ভালোই কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য ভাবো কিছু? মেয়ের তো বিয়ের বয়স হয়েছে, এমন এ কথাগুলোও যেন চলে আসে, খেজুর গাছির দরিদ্র অসহায় এক ছোট্ট পরিবারে।চাষীর খেয়াল তো আছে, তবে আরও পরিশ্রম এবং কষ্ট করবার প্রয়োজন হবে, বউ’কে সান্ত্বনার সহিত বলে, সামনের শীতে ইচ্ছা আছে আরোও বেশ কিছু খেজুর গাছ বর্গা নিলেই ‘মেয়ের বিয়ের’ বেশ কিছু টাকা হাতে আসবে। এমন কথা সচরাচর শুনা যায় খেজুর চাষির কন্ঠে। এই সকল চাষিদের আবারও দেখা যায় তাদের কোনো কোনো পরিবারে আদরের বিবাহিত মেয়ে জামাইকে দাওয়াত দিয়ে এই খেজুর রসের পিঠা পায়েসের তৈরী আয়োজনেও চরম ধুম পড়ে। চাষীর মেয়ে, বউ, ঝিয়েরা খেজুরের ”রস” বা ‘গুড়’ কিংবা ‘পিঠা’ তৈরিতেও অত্যন্ত ব্যস্ত সকালের মনোরম পরিবেশে উপভোগ করে। এমন চমৎকার দৃশ্য বড়ই শৈল্পিক উপাখ্যান। শুধুই কি তাই, শীতরে র্দীঘ রজনীতে চাষীর লেপ, কাঁথা, কম্বল মুড়ি দিয়ে জড়াজড়ি করেই ভোরে প্রত্যাশায় রাত কাটায়। এই
শীতের ভোরেই “রস” কিংবা “পাটালি” গুড় তৈরীতে জ্বালানীর পাশে বসে অথবা লেপ মুড়ি দিয়েই চিড়া, মুড়ির মোয়া খাওয়ার মজার একটি পরিবেশ চাষীর পরিবারের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ মেয়ে জামাই ভুল করে না।
রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হবে গুড়। সেই গুড়ের আবার রকমফের আছে। যেমন, পাটালি গুড়, ঝোলা গুড়। এ সব গুড় বিভিন্ন ভাবে খাওয়া হয়। শীতের খেজুর গাছের রস হতে যে গুড়ে তৈরি তা দিয়ে দুধের পিঠা, পুলিপিঠা, সেম পিঠা আরও কত কি যে পিঠা তৈরী হয়, তা না খেলে একেবারেই জীবন বৃথা। “পাটালি গুড়” দিয়ে মুড়ির ‘মোয়া’ খাওয়া এবং ঝোলা গুড়ের সঙ্গে মচমচে মুড়ি খাওয়ার জনপ্রিয়তা গ্রামাঞ্চলের মানুষেরই খোঁজে পাওয়া যায় । আবার এমনিতেও তারা খেজুর গুড় সরবত করে কিিংবা খালি খালিই খায়। তবে খেজুরের “রস” দিয়েই তৈরি রসের পিঠা, তা খুবই সুস্বাদু হয়ে থাকে। তাছাড়াও খেজুর গুড়ের প্রচলিত সন্দেশ যে হয় তার স্বাদই অপূর্ব। শখ করে অনেক চাষিরা চা খাওয়ার নেশায় ঘরেই চা বানিয়ে খায় খেজুর গুড়কে উপজীব্য করে।
শীত তার বিচিত্র রূপ ও রস নিয়েই হাজির হয় গ্রাম বাংলায়। নবান্ন উৎসব কিংবা শীতের পিঠা পায়েশ তৈরির উৎসব শীতে ঘটা করেই হয়। শীতে চিরায়ত যা কিছু সৃষ্টির নিয়ামত, তা উপলব্ধি করতে চাইলে অবশ্যই গ্রামে যেতে হবে। শীতের নিরবতার অস্তিত্ব সৌন্দর্য মন্ডিত বাংলাদেশের ষড় ঋতুর এক ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিয়মান হয় খেজুর গাছ। আশ্বিনের শুরু থেকেই চাষীরা খেজুর গাছ তোলা এবং পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই উপযুক্ত সময় তারা নির্ধারণ করে মাঘের ‘বাঘা শীতে’ গুড় বিক্রিয় এবং তৈরীর প্রক্রিয়া যেন শেষ হয়। তাদের প্রক্রিয়াজাত খেজুর গুড়, পাটালি বা রস সারা বছর সংগ্রহ করে রাখে কোন কোন গ্রামের গৃহস্থ পরিবার। গ্রামের বাজার গুলোতেও জমজমাট হয়ে ওঠে খেজুর রস এবং গুড়ে। প্রকৃত পক্ষেই শীতে উৎসব মুখর হয়ে উঠে গ্রামবাংলা। জলাভূমি এবং কিছু পাহাড়ি ভূমি বাদে এদেশে এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে খেজুর গাছ জন্মে না। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমা অঞ্চলে খেজুর গুড় বাণিজ্যিকভাবেই উৎপাদিত হয়।
গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের শাখা কেটে চেঁছে পরিষ্কার করে সেই কাটা অংশেরই নিচ বরাবর দুটি খাঁজ কাটার প্রয়োজন পড়ে। সে খাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নলী বসানো হয়। এই নলী বেয়ে হাড়িতে রস পড়ে। নলীর পাশে বাঁশের তৈরি খিল বসানো হয়। সেই খিলেই মাটির হাড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়। বিকেল থেকে হাড়িতে রস জমা হতে হতে সারা রাত্রিতে হাড়ি পূর্ণ হয়। এ গাছ কাটার পর দুই তিন দিন পর রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসকে বলে “জিরান” কাট। জিরান কাট রস খুবই সুস্বাদু। প্রথম দিনের রস থেকে ভালো পাটালি গুড় তৈরি হয়। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে দোকাট। তৃতীয় দিনের রসকে বলে তেকাট। রসের জন্যে এই খেজুর গাছে একবার কাটার পর আবারও পাঁচ ছয় দিন পর কাটতে হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানোর জন্য এই সময় দেওয়া প্রয়োজন পড়ে। খেজুর গাছ কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্য সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে।
গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। হাড়িকে আবার অনেকে বলে ভাঁড়। ঠিলা হিসেবেও হাড়ির নাম ব্যবহার হয়। যে যাই বলুক না কেন, ভাঁড়টি আসলেই খুব ছোট আকৃতির কলসের মতো হয়ে থাকে। মাঝারি আকৃতির দশ বা পনেরো ভাঁড় রস জ্বাল দিয়েই এক ভাঁড় গুড় হয়। সেই এক ভাঁড় গুড়ের ওজন ছয় থেকে আট কেজির মতো বলা চলে। গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের তাপালে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। এ গুড়ের কিছু অংশ তাপালের এক পাশে নিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি একটি খেজুর ডাল দিয়ে ঘষতে হয়। ঘষতে ঘষতে এই অংশটুকু শক্ত হয়ে যায়। আর শক্ত অংশকেই আবার কেউ কেউ বীজ বলে থাকে। বীজের সঙ্গে তাপালের বাকি গুড় মিশিয়ে স্বল্পক্ষণের মধ্যে গুড় জমাট বাঁধতে শুরু করে। তখন এ গুড় মাটির হাঁড়ি বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখার প্রয়োজন পড়ে। সে গুড় দেখলে বুঝা যাবে, একেবারে জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করেছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বহুকাল ধরে পেশাদার খেজুর গাছ কাটিয়ে আছে। স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয় গাছি। কার্তিক মাসের শুরু হতে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত তারা খেজুর গাছ কাটায় নিয়োজিত থাকে। যে সব চাষির স্বল্প সংখ্যক খেজুর গাছ রয়েছে নিজেরা তা কেটে থাকে। তারা রস পাড়ে এবং তা বাড়িতে নিয়ে এসেই জ্বাল দিয়ে তৈরি করে গুড়। শীতের এমন এ প্রকোপ যত বেশি হয়, রসও তত বেশি পান চাষীরা। রস গাছে যখন কমে যায় তখন সে রসের স্বাদ যেন বেশী হয়। এ রসকে ‘জিরান কাট’ রস বলে, গন্ধেও এই ‘রস’ হয় সবচেয়ে উত্তম। এই ‘জিরান কাট’ রস নামানোর পর আবারও রসের ভাঁড় বা কলস গাছে টাঙালে তখন এই খেজুর গাছ হতে যে রস পাওয়া যাবে তা ‘উলাকাটা’ রস। গ্রাম বাংলায় এমন শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে যারা খেজুর বনের চাষ করে তারাই তো গভীব রাতে খেজুর রস নামিয়ে উনুনের আগুনে জ্বালাতে ব্যস্ত হয়। সত্যিই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর বনের পাশে উঁচু ভিটায়। এমন নিবিড় স্তব্ধতার মধ্যেও যেন জীবন সংগ্রামে তাদের মজার স্পন্দন উপলব্ধি হয়। উনুনের পাশেই থাকে গাছি বা শ্রমিক মজুর, তাদের থাকবার জন্যেই বানায় ‘কুঁড়ে ঘর’, খেজুরের পাতা এবং বিচালি দিয়ে ছাওয়া হয়। কান পাতলে শোনা যায়, গাছিয়া নিঃসঙ্গতা কাটাতে গ্রামাঞ্চলের বহু প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক গান শুনতে পাওয়া যায়। তাদের সুরে আছে অদ্ভুত প্রাণময়তা ও আবেগ, সহজেই হূদয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তাদের এই শীতে উপাদেয় খাবার খেজুরের রস। তারা সংগ্রহে ব্যস্ত এ গাছ থেকে ও গাছে এবং খেজুর রস সংগ্রহ করতে শীত কাঁপানি কন্ঠে মজার মজার গান ধরে।
পত্রবৃন্তে আবৃত খেজুরের কাণ্ডটি সরল, গোলাকৃতি এবং ধূসর বর্ণের হয়। মাথায় মুকুটের মতো ছড়ানো পাতা গুলোও উর্ধ্বমুখী কিংবা ছুরির ফলার মতোই তীক্ষ্ণ। খেজুরের ভিন্নবাসী গাছে স্ত্রী ফুল এবং পুরুষ ফুল আলাদা ভাবে গাছে জন্মায়। এমন এই খেজুর গাছের পুং পুষ্পমঞ্জরী খাটো, ফুল সাদা মোচার মত অথবা ঘিয়ে রঙের মতোই দেখতে হয়। তাই খেজুর গাছের পরিপক্ক এই ফুলের মোচায় ঝাকুনি দিলেই ধুলার মতো পুংরেণু বাহির হতে দেখা যায়। আবার স্ত্রী পুষ্প মঞ্জরী লম্বা এবং ফুলের রং হালকা সবুজ হয়ে থাকে। স্ত্রী গাছে অজস্র ফল হয়ে থাকে তাকেই অনেক উজ্জ্বল দেখায়। এক একটা মজ্ঞরীতেই বহু স্ত্রী ফুল ফোটে, যা একটি কাঁদি তৈরী হয়। খেজুরের গাছের মাথায় খুব সূচালো অসংখ্য কাঁটার সমন্বয়ে ঝোপের মতো সৃষ্টি হয়। এমন এ পাতার গোড়াতেই প্রতিটি পাতায় কাঁটা রূপান্তরিত হয়। সাধারনত এই পাতা ৩ মিটার লম্বা এবং নীচের দিকে বিশেষ করে বাঁকানো হয়। খেজুর গাছ সারা বছর একই রকমেই থাকে। পাকা ফল দেখতে পার্পেল-লাল রঙের এবং তা সুমিষ্ট হয়, খাওয়াও যায়। বলা যায়, পাখিদেরও প্রিয় এটি।
শীতঋতুতে খেজুরের ‘রস’ সবারই রসনা তৃপ্ত করে। আর খেজুর গাছের মাথার কচি অংশ খেতে দারুন লাগে খেতে। খেজুর গাছ ছয় সাাত বছর বয়সে রস দেওয়া শুরু করে। ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত “রস” দেয়। গাছ পুরনো হয়ে গেলে রস কমে যায়। পুরনো গাছের রস গুলো খুবই মিষ্টি হয়। আবার দেখা যায়, মাঝ বয়সী গাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি ‘রস’ পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা গাছের জন্যে ক্ষতিকর। রস সংগ্রহের জন্যে কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। সেই মাস থেকেই রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গেই “রস” ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শীত যতই বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ মাস হলো রসে ভরপুর মৌসুম। একবার গাছ কাটার পর দুই তিন দিন রস পাওয়া যায়। ১ম দিনের রসকেই বলে জিরান কাট। এই জিরান কাট রস খুবই সুস্বাদু। প্রথম দিনের রস থেকে ভালো পাটালি গুড় তৈরি হয়। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে থাকে “দোকাট”। তৃতীয় দিনের রসকেও বলে ‘তেকাট’। রসের জন্য গাছ একবার কাটার পর পাঁচ ছয় দিন পর আবার কাটা হয়। গাছের এ কাটা অংশ শুকানোর জন্য এমন সময় দেওয়া হয়। কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। কারণ হলো যে, সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশটুকুতে পড়ে। রস পেতে হলে খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। যারা গাছ কাটে তাদের বলা হচ্ছে “গাছি”। গাছিদের গাছ কাটার জন্য কয়েকটি উপকরণ দরকার হয়। যেমন - ‘দা’, দা রাখার জন্য একটি ‘ঝাঁপি’, ‘দড়ি’ এবং এক টুকরো ‘চামড়া’ বা পুরনো ‘বস্তা’। গাছিরা যেই ঝাঁপি ব্যবহার করে তা বাঁশ দিয়ে তৈরি। গাছে উঠার সময় গাছি এই ঝাঁপিতেই ‘দা’ রাখে। কোমরে বেঁধেও নেয় চামড়া বা বস্তা। গাছ কাটার সময়ে তাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্যে গাছি কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এমন দড়ির দুই মাথাতেই বিশেষ কায়দায় গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার সময় গাছি অতি সহজে মুহূর্তের মধ্যেই গিঁট দুটি জুড়ে দিয়েই নিজের জন্যে গাছে উঠার নিরাপদ ব্যবস্থা করে নেয়। গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের শাখা কেটে, চেঁছে পরিষ্কার করা হয়। কাটা অংশের নিচের দিকেই দুটি খাঁজ কাটা হয়। খাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে এক সরু পথ বের করা হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নলী বসানো হয়। এমন নলী বেয়ে হাড়িতে রস পড়ে। নলীর পাশে বাঁশের তৈরি খিলও বসানো হয়। এমন খিলেই মাটির হাড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়। হাড়িতে রস জমা হয়। গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্যে মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। এমন এ হাড়িকে বলে ভাঁড়।আবার কোথাও বলে ‘ঠিলা’। ভাঁড় দেখতে ছোট হয়, আকৃতিটাও ঠিক কলসের মতো। এই খেজুর “রস” মাঝারি আকৃতির দশ থেকে পনেরো ভাঁড় রস জ্বাল দিলেই এক ভাঁড় গুড় হয়ে যায়। এমন এক ভাঁড়ের গুড়ের ওজন ৬ থেকে ৮ কেজির মতো। খেজুরের রস হতেই তৈরি গুড় তা চমৎকার মিষ্টি জাতীয় এক খাবার। এটি সমগ্র বাংলাদেশেও বেশ প্রসিদ্ধ। প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই গুড়। গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয়, ‘মাটির জালায়’ কিংবা ‘টিনের তাপালে’। খুব সকালে গাছ থেকে ‘রস’ নামিয়ে এনে জ্বালানিতেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতেই এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। এমন গুড়ের কিছু অংশ তাপালের এক পাশে নিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি একটি খেজুর ডাল দিয়েই ঘষতে হয়। ঘষতে ঘষতে এই ‘রস’ অংশটুকু শক্ত হয়ে যায়। এই শক্ত অংশকে বীজ বলে। এমন বীজের সঙ্গে তাপালের বাকি গুড় মিশিয়ে দেওয়া হয়। স্বল্পক্ষণের মধ্যেই ‘গুড়’ জমাট বাঁধতে শুরু করে। তখন এমন গুড় ‘মাটির হাঁড়ি’ বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখা হয়। গুড় জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করে। এই খেজুর ‘গুড়’ যারা বানায়, তাদের ঐতিহ্যগত পরিচয় তারা গুড়-শিল্পী বা শিউলি। এই শিউলিরা আদতে খেতমজুর। বর্ষার দিনে অনেক অঞ্চলে চাষা বাদের পর ভূমিহীন খেত মজুরদের কোনও কাজ থাকে না। সুতরাং তারা তো অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটায়। সে সময় শিউলিরা দাদন নেয় মহাজনের কাছ থেকে বহু খেজুর গাছ।বিনিময়ে তারাও মহাজনের নির্ধারিত দামেই তাদের কাছে অনেক সময় গুড় গুলো বিক্রি করতেই বাধ্য হয়। সে গুড় সারা বাংলাদেশেই এখন পাওয়া যায়। একটু জেনে নিই তা হলো, এমন এই খেজুরের গাছ আরবের মেসোপটেমিয়াই আদি জন্ম স্থান হিসেবেই বিবেচিত। এইদেশে যেসব খেজুর চাষ হয় তার নাম Phoenix sylvestris। এ খেজুর গাছের উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ মিটার হয়ে থাকে। গ্রামবাংলার এমন এই জাতটিকে বুনো জাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
লেখক,
নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।