শনিবার ● ৩ নভেম্বর ২০১৮
প্রথম পাতা » সকল বিভাগ » অন্যকে ফাঁসাতে বসতঘরে অগ্নিসংযোগ করে ফেঁসে গেলেন নিজে
অন্যকে ফাঁসাতে বসতঘরে অগ্নিসংযোগ করে ফেঁসে গেলেন নিজে
বিশ্বনাথ প্রতিনিধি :: (১৯ কার্তিক ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৯.৫০মি) সিলেটের বিশ্বনাথে পূর্ব বিরোধের রেশ মেটাতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য নিজ বসতঘরে আগুণ দেয় আব্দুল মানিক (২৮) নামের এক ব্যক্তি। সে উপজেলার অলংকারী ইউনিয়নের মিরগাঁও গ্রামের আব্দুল কাদিরের পুত্র।
পুলিশ জানায় শুক্রবার সিলেট আদালতে ১৬৪ ধারায় এমন জবানবন্দি দিয়েছেন আব্দুল মানিকের চাচাতো ভাই মৃত রাশিদ আলীর পুত্র শারীরীক প্রতিবন্ধী মোস্তাক আহমদ (২০)। গত বুধবার ঘর পুড়ানোর মামলার এজাহার নামীয় এক আসামী একই গ্রামের চুনু মিয়ার পুত্র লায়েক আহমদ (২৬)’কে গ্রেফতার পুলিশ। পুলিশের কাছে তার দেয়া তথ্যানুযায়ী গত বৃহস্পতিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিবন্ধী মোস্তাক আহমদকে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। এসময় মোস্তাক আহমদ পুলিশকে জানায়- অগ্নিসংযোগের দিন রাতে গোপন বৈঠক করেন আব্দুল মানিক ও আব্দুল মজিদ গংরা। আর ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজ বসতঘরে আগুণ দেয় আব্দুল মানিক’সহ তার পক্ষের লোকজন। শুক্রবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্ধির পর রাতে প্রতিবন্ধী মোস্তাক আহমদকে তার পরিবারের কাছে সমজিয়ে দেয় পুলিশ।
গত শুক্রবার বিকেলে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকরা সরেজমিন গেলে রহস্যজনক এই অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একই পরিবারের বউ-শাশুড়ির পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। অগ্নিকান্ডের ঘটনার বিষয়টি জানতে চাইলে প্রথমে আব্দুল মানিকের স্ত্রী ফাহিমা বেগম বলেন- এক সাথে ছয়টি পরিবারের বসত ঘরের পেছন দিকে (পূর্বদিক) আগুণ লেগে যায়। কিন্ত পূর্ব পার্শ্বের বাড়িটি রয়েছে প্রতিপক্ষ সাবেক মেম্বার শায়েস্তা মিয়ার। একই ভাবে ঘটনার বর্ণনা জানতে চাইলে আব্দুল মানিকের মা গোলাবি বেগম- বলেন প্রথমে শুধু তাদের ঘরের পেছন দিক থেকে আগুণের সূত্রপাত দেখতে পান। বউ-শাশুড়ির এমন পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে এবং প্রত্যেক্ষদর্শী লোকজনদের বক্তব্যে নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এঘটনা নিয়ে একপি মহল রাজনৈতিকভাবে তবে এঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনে থানা পুলিশের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের মে মাসে মিরগাঁও গ্রামের জামে মসজিদ নিয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুন নুরের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয় গ্রামবাসীর। এনিয়ে মিরগাঁও গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য শায়েস্তা মিয়া, ফারুক মিয়া সহ বেশ কয়েকজনকে আসামী করে প্রবাসী আব্দুন নুরের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়। বিরোধ সৃষ্টির শুরুতে আব্দুন নুরের প্রতিপক্ষ হিসেবে শায়েস্তা-ফারুক-রবাই গংদের সাথে ছিলেন গ্রামের আব্দুল মজিদ ও আব্দুল আজিজ। কিছুদিন পর আব্দুন নুরের পক্ষে আব্দুল মজিদ ও আব্দুল আজিজ গংরা অবস্থান নিলে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে যান শায়েস্তা-ফারুক ও রবাই গংরা। এই বিরোধের জের ধরে চলতি বছরের ৮ আগস্ট আব্দুল মজিদ পক্ষের রজব আলী গংদের সাথে মারামারি হয় শায়েস্তা মিয়া পক্ষের রবাই মিয়া গংদের। ওই দিন হামলায় গুরুতর আহত হন রজব আলী। ওই হামলার ঘটনায় প্রতিপক্ষের ৫জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন রজব আলীর ভাই রিদওয়ান। এই মামলায় রবাই মিয়া সহ অন্যান্য আসামীরা হাজতবাস করেন। উক্ত বিরোধের জের ধরে গত ৮ অক্টোবর বিকেলে কথা কাটাকাটি হয় রবাই মিয়া গংদের সাথে প্রতিপক্ষের লোকজনদের। ওই দিন রাত আনুমানিক ১০টায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ডাকাডাকি হয় রবাই মিয়া ও আব্দুল মানিকের এবং ওই রাতেই অগ্নিকান্ডে আব্দুল মানিকের সবতঘর সহ ৬টি পরিবারের বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে নিঃস্ব হয়ে যান ওই ৬টি পরিবারের সদস্য। ফলে তারা খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছেন ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সদস্যরা।
এঘটনায় অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ একটি পরিবারের গৃহকর্তা প্রবাসী আহমদ আলীর স্ত্রী নুরুনন্নেছা বাদি হয়ে গত ১২ অক্টোবর অজ্ঞাতনামা আসামী করে বিশ্বনাথ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা বাদি উল্লেখ করেন গ্রামের মসজিদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দু’পক্ষের মধ্যে বিরুধ চলে আসছে। এনিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে মামলা মোকদ্দমা সৃষ্টি হলে এক পক্ষ অপর পক্ষকে গায়েল করতে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে বিভিন্ন জায়গায় মামলা মোকদ্দমা করে আসছে এবং মামলা পরিচালনার জন্য ফান্ড গঠন করে একটি পক্ষ গ্রামের বিভিন্ন লোকজনদের কাছ থেকে চাঁদা উঠান। একপর্যায়ে এই চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় রজব আলীকে মারধর করেন রবাই গংরা। উক্ত ঘটনায় দারেকৃত মামলায় রবাই ও সেবুল কারাগারে আটক থাকার পর মুক্ত হয়ে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং গত ৮অক্টোবর দিবাগত রাত প্রায় ১০টায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রজব আলী পক্ষের আব্দুল মানিককে পরদিন সকাল ৮টার মধ্যে তার বাড়ির সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেন রবাই। আর ওই দিন রাত ৩টা ২৫ মিনিটে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা বাড়িতে আগুণ লাগিয়ে দেয়। এতে ৬টি বসতঘরের সকল মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রবাই মিয়া সহ ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে এজাহারে বাদি বলেন- রবাই মিয়া হুমকি দেওয়ায় সন্দেহ হচ্ছে তারা (রবাই গংরা) নিজেরা অথবা ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী ধারা বাদির বসতঘরে এই অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
এদিকে, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মামলা দায়েরের পর সন্দেহজনক অভিযুক্ত মিরগাঁও গ্রামের রুস্তুম আলীর পুত্র আসিক মিয়া (২০) কে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর গত বুধবার আরেক অভিযুক্ত চুনু মিয়ার পুত্র লোকমান আহমদ (২৬) কে গ্রেফতার করে পুলিশ। লোকমানকে গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিবন্ধী মোস্তাক আহমদকে আটক করে থানা পুলিশ। এসময় মোস্তাক আহমদ পুলিশকে জানায়- অগ্নিসংযোগের দিন রাতে গোপন বৈঠক করেন আব্দুল মানিক ও আব্দুল মজিদ গংরা। আর ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রবাই গংদের ফাঁসাতে নিজ বসতঘরে আগুণ দেন আব্দুল মানিক’সহ তার পক্ষের লোকজন। গত শুক্রবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির পর ওই রাতে প্রতিবন্ধী মোস্তাক আহমদকে তার পরিবারের কাছে সমজিয়ে দেয় পুলিশ।
১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদানের সত্যতা নিশ্চিত করে বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইন-চার্জ শামসুদ্দোহা পিপিএম বলেন- অগ্নিকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটনে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নিরীহ লোকজনকে যাতে হয়রানীর শিকার হতে না হয় এবং প্রকৃত অপরাধীরা যাতে ছাড় না পায় সেই লক্ষ্যেই আমাদের তদন্তকাজ চলতেছে। শীঘ্রই ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদি।