বৃহস্পতিবার ● ১৫ নভেম্বর ২০১৮
প্রথম পাতা » নওগাঁ » নওগাঁ-৬ আসন থেকে দুই দলের ১৬জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা : বিএনপিতে দুই ভাইয়ের লড়াই
নওগাঁ-৬ আসন থেকে দুই দলের ১৬জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা : বিএনপিতে দুই ভাইয়ের লড়াই
নাজমুল হক নাহিদ, আত্রাই (নওগাঁ) প্রতিনিধি :: বাজতে শুরু করেছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঢামাঢোল। এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদ নামে পরিচিত নওগাঁ-৬ আসন। এই আসনে বর্তমানে নির্বাচনের হাওয়া খুব জোড়ে-সোড়ে বয়তে শুরু করেছে। এই জনপদের মানুষ চেয়ে আছে কে হয় নৌকার মাঝি আর কে হয় ধানের শীষের রক্ষক তা দেখার জন্য।
নওগাঁ জেলার রাণীনগর ও আত্রাই দুই উপজেলা নিয়ে নওগাঁ-৬ ও জাতীয় সংসদের ৫১ নম্বর আসনটি গঠিত। আসন্ন একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারনায় মুখরিত এই নির্বাচনী এলাকা। এই আসনে মুলত ভোটের লড়াই হবে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র প্রার্থীর মধ্যেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই আসন থেকে বড় দুই দল থেকে ১৬জনসহ আরো একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীরা তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানের আলোচিত বিষয়টি হলো বিএনপিতে দুই ভাই চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবীর ও তারই ছোট ভাই নওগাঁ-৬ আসনের বর্তমান ধানের শীষের কর্ণধার আনোয়ার হোসেন বুলুর মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি।
নওগাঁ-৬ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯ হাজার ৩৯৭ জন। গত ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এ আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন তৎকালীন বিএনপি দলীয় প্রার্থী আলমগীর কবির। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আলমগীর কবির গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি এই জনপদের সর্বহারা নামক সন্ত্রাসী বাহিনীকে মদদ দেওয়ায় এই বাহিনী তাদের গলা কাটা রাজনীতি শুরু করলে তিনি এই সর্বহারাকে নিধন করার জন্য আবিস্কার করেন বাংলাভাই নামক জেএমবি দলকে। জেএমবি দল সেই সময় দিনে-দুপুরে এই সর্বহারাকে নিধন করাসহ এই জনপদে লুটপাট চালাতো। জোর করে কৃষকের ধানের গোলার ধান, গোয়াল ঘরের গরু-ছাগল লুট করাসহ তারা সন্ত্রাসী তান্ডব চালিয়ে ছিলো। এই দুই সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে এই জনপদের মানুষ সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হতে পারেনি। কত মা-বাবা সন্তান হারা হয়েছে, কত স্ত্রী বিধবা হয়েছে আর কত সন্তান পিতা হারা হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। আর তাদের শক্তি জুগিয়ে ছিলো সেই সময়ের প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবীর। সেইসব দিনের কর্মকান্ড এই জনপদের মানুষেরা তাদের ইতিহাসে লিখে রেখেছে ঘৃর্ণার কালি দিয়ে। তিনি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে এই আসনের বিএনপি’র কোন কর্মীরা তার কাছে মূল্যায়ন পায়নি। বিএনপির কোন নেতার বিপদে পাশে দাড়ায়নি। আলমগীর কবীর নামটি এই আসনের মানুষের কাছে এক আতংকের নাম। আবার যদি আলমগীর কবীর এই জনপদে আসেন তাহলে শান্তির আবাস নওগাঁ-৬ আবারও রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হবে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী ও সচেতনমহল।
বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে আলমগীর কবির বিএনপি দল ত্যাগ করে এলডিপি দলে যোগ দেন। এলডিপিতে যোগ দেওয়ার পর প্রায় ১৫বছর তিনি এই আসনের রাজনীতি মাঠ থেকে বিতাড়িত ছিলেন। কোন সাংগঠনিক কর্মকান্ডে এই জনপদে তাকে দেখা যায়নি। আলমগীর কবির বিএনপি দল ত্যাগ করার ফলে রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীরা এক সংকটময় সময় অতিবাহিত করে। বিএনপির সেই দুঃসময়ে দলের হাল ধরেন আলমগীর কবিরের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আনোয়ার হোসেন বুলু। বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসন ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দখলে আসে। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মো: আনোয়ার হোসেন বুলুকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন তৎকালীন ঢাকা মহানগর শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক মো: ইসরাফিল আলম। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবারও নির্বাচিত হন।
বিএনপি থেকে এই আসনের মনোনয়নপত্র দেওয়ার তালিকায় আরো রয়েছেন তাঁতি দল নওগাঁ শাখার সভাপতি আলহাজ্ব এচাহক আলী, আমিনুল ইসলাম বেলাল, সিরাজুল ইসলাম সিরাজসহ মোট ৯জন বিএনপি নেতা।
অপরদিকে আ’লীগ থেকে নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদের শান্তির বাহক ও মিডিয়ায় খুব পরিচিত মুখ নওগাঁ-৬ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম ছাড়াও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নওশের আলী, নওগাঁ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি ওহিদুর রহমানের ছেলে এ্যাড.ওমর ফারুক সুমন, রাণীনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মো: আনোয়ার হোসেন হেলাল, রাণীনগর উপজেলা আ’লীগের সিনিয়র উপদেষ্ঠা, জেলা আ’লীগের সদস্য ও রাণীনগর উপজেলার বড়গাছা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুর রহমান, জেলা আ’লীগের সদস্য ও রাণীনগর উপজেলা আ’লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মো: রেজাউল ইসলাম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শেখ মো: রফিকুল ইসলামসহ।
ইসরাফিল আলম ২০০৮ সালে বিএনপি দলীয় প্রার্থী আনোয়ার হোসেন বুলুকে পরাজিত করে প্রথম বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০১৪ সালের ৫জানুয়ারী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ইসরাফিল আলম। তিনি গত ৯ বছরে এলাকার যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ ভাল অবদান রেখেছেন। নাগর নদীর উপর দুটি ব্রীজ, আত্রাই নদীর উপর একটি ব্রীজ, ছোট যমুনা নদীর উপর দুটি ব্রীজ অত্র এলাকায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের উন্নয়ন হয়েছে। এ ছাড়াও তিনি রাস্তা-ঘাট ও শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। এ ছাড়া নওগাঁর আত্রাই উপজেলায় পতিসরে অবস্থিত রবীন্দ্র কুঠির বাড়ি। বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে পতিসরকে জাতীয় ভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। রাণীনগর-আত্রাইবাসীর প্রানের দাবি ছিল পতিসরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। কিন্তু কোন ভাবেই সেই দাবি পুরুন হয়নি। তবে পতিসরে একটি কৃষি ইনষ্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। এসব উন্নয়নের পরেও ইসরাফিল আলম এমপির প্রতি অনেক অনেক প্রবীণ ও ত্যাগী আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে। ত্যাগী ও প্রবীনদের মূল্যায়ন না করে নির্দিষ্ট কিছু হাইব্রীড জাতের নেতাকর্মীর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন।
রাণীনগর-আত্রাই উপজেলার আইনশৃঙ্খলা বিষয়টি নিয়ে এলাকার লোকজন সব সময় বড় সমস্যায় থাকেন। এই এলাকায় ছিল সর্বহারা নামক জবাই করা দলের অবাধ বিচরন। সর্বহারাদের হত্যা, নির্যাতন ও চাঁদাবাজীর কথা মানুষ এখনো ভুলতে পারিনি। সেই সাথে ছিল বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবির তান্ডব। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে। তাই এই জনপদের মানুষ চেয়ে আছে বড় দুই দলের নীতি নির্ধারকদের দিকে তারা এই রক্তাক্ত জনপদের শান্তির বাহক হিসেবে কাকে মনোনিত করবেন। যাদের মনোনিত করবেন তারা আদৌই কি এই জনপদের মানুষের জন্য শান্তির বাতাস বয়ে আনবে নাকি সর্বহারা আর জেএমবির মতো নতুন কোন বাহিনী এনে নতুন করে এই জনপদের মানুষকে আবারও পিষ্ট করবে।