বৃহস্পতিবার ● ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » এ লজ্জা ব্যক্তির এবং রাষ্ট্রের
এ লজ্জা ব্যক্তির এবং রাষ্ট্রের
মাসুদা ভাট্টি :: বাংলাদেশে অনেক ছোট ঘটনা যেমন আমাদের জাতীয় জীবনকে নাড়া দেয়, তেমনই অনেক বিশাল ঘটনা জাতীয় জীবনে যার বড় ধরনের প্রভাব ফেলার কথা, তেমন ঘটনাও আড়ালে চলে যায় কোনও ধরনের আলোচনা ছাড়াই। আজকে ঠিক সে রকমই একটি বিষয়ের ওপর পাঠকের দৃষ্টি ফেরাতে চাইছি। তবে বিস্তারিত বলার আগে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় নিয়ে অল্প কিছু কথা বলতে চাই।
ইউরোপ এখন পুরোপুরি পর্যুদস্ত মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সিরিয়া থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে। এই কিছুকাল আগেও ইউরোপের দেশে-দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা অনেকটাই নির্ভর করতো তারা সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রমবর্ধমান ইমিগ্র্যান্ট বা অভিবাসীদের বিষয়ে তাদের অবস্থান কেমন, তার ওপর। আর্থিক সংস্কার বা রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যান্য নীতির সঙ্গে অভিবাসন-নীতির ওপর নির্ভর করতো তাদের জনপ্রিয়তা। কিন্তু গত বছর ইউরোপের যে ক’টি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সে সবের প্রতিটিতেই মূল আলোচ্য বিষয় ছিল এই শরণার্থীদের সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলটির নীতি কি সেটা। বলাই বাহুল্য, আগামী দশক জুড়ে এই শরণার্থী ইস্যুটি প্রাথমিক ও অন্যতম মৌলিক ইস্যু হিসেবে আলোচিত হবে। এর কারণ, বহুবিধ। তবে প্রাথমিকভাবে এই শরণার্থীদের ধর্মবিশ্বাস যে তাদের সম্পর্কে অবস্থান নির্ণয়ে প্রধান নিয়ামক তাও ইতোমধ্যে আমরা সবাই জানি। সিরিয়ায় যা ঘটছে, তার দায় কার—এ নিয়ে বহুবিধ বিচার-বিশ্লেষণ রয়েছে কিন্তু মোটাদাগে আমরা জানি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ এর পেছনে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে। এমনকি একথাও এখন আর গোপন নেই যে, আমাদের জীবতকালের সবচেয়ে বড় বিপদ আইসিস-এর সৃষ্টিও হয়েছে এই মার্কিন তত্ত্বাবধানেই। ফলে আজকে যখন সিরিয়া থেকে লাখ লাখ মানুষ কেবল বেঁচে থাকা জন্য অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে, তখন তাদের আশ্রয় ও সাহায্য দেওয়ার সবচেয়ে বড় দায়টি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ইউরোপকেই এই চাপ সহ্য করতে হচ্ছে।
এমনিতে ইউরোপের অভিবাসন পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকেই যাচ্ছিল বিশেষ করে মুসলমান অভিবাসীদের ইউরোপের সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার প্রতি অনুদারতা ক্রমশ এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে মূলধারা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। পৃথিবীর নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে ইসলাম যেহেতু একটি বিশাল ‘ফ্যাক্টর’ সেহেতু ইউরোপীয় মুসলমান অভিবাসী জনগোষ্ঠীর পক্ষে নিজেদের ইউরোপীয় মূল ধারায় সম্পৃক্ত করাটাও বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করছিলো। অনেক গবেষকই অবশ্য বলতে চাইছেন যে, ধর্ম হিসেবে ইসলাম কখনও অন্য ধর্মের সঙ্গে ‘মিলে’ এবং ‘মেলায়ে’ চলার অনুমোদন দেয় না, ফলে ইউরোপের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ নিজেদের ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করেই রেখেছিল। সর্বশেষ ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধাবস্থার সুযোগে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আইসিসের সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠার ফলে ইউরোপ জুড়ে যে ভীতির সৃষ্টি হয়, সে ভীতির আগুনে ইউরোপ থেকে তরুণ মুসলমানদের অনেকের আইসিসে যোগ দিয়ে ঘি ঢালার কাজটি করেছে। এর ফলে মুসলিম কমিউনিটিকে মূলধারা আর বিশ্বাস করতে পারছে না। আর মুসলিম কমিউনিটির মূলধারার ওপর থেকে বিশ্বাস হারানোর কারণ অনেক কিন্তু সেগুলো পশ্চিমা বিশ্লেষকরা স্বীকারই করতে আগ্রহী নন। ফলে এই বিপুল শরণার্থীকে নিয়ে ইউরোপের এই দোনামোনা আচরণ এবং অনেক রাষ্ট্রের প্রকাশ্যেই বৈরিতা (উদাহরণ: হাঙ্গেরি) আসলে একদিকে ক্রমবর্ধমান ইসলাম-বিদ্বেষ, অন্যদিকে মূলধারা থেকে মুসলমানদের ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ইউরোপের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যে জুজুর ভয়টি দেখানো হচ্ছে, এই শরণার্থীদের মাঝে মিশে রয়েছে আইসিস নামধারী ভয়ঙ্কর শত্রুপক্ষ, যারা এই সুযোগে ইউরোপে ঢুকে অশান্তির সৃষ্টি করবে। এরই মধ্যে জার্মানিতে কয়েকজন আইসিস যোদ্ধার শরণার্থী হিসেবে প্রবেশের প্রমাণও পাওয়া গেছে বলে দাবি করছে সে দেশের গণমাধ্যম। প্রশ্ন হলো, নিজেদের নিরাপত্তায় ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকার যদি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হয় তাহলেও কিন্তু দেশের গরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন সরকারগুলো পেতেই পারে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, এই ইউরোপেই দেশে দেশে শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষের সরকারগুলোর এই বৈরিতার বিরুদ্ধে মিছিল, সমাবেশ এবং সেমিনার। বিভিন্ন প্রেশার গ্রুপ ইউরোপে কাজ করছে শরণার্থীদের যেন আশ্রয় দেওয়াসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য। এরা সংখ্যায় কম নয়, আমরা দেখতে পাই যে, একেকটি র্যালি বা জমায়েতে যে পরিমাণ মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তা বিশ্ববিবেকের বিজয়ই সুনিশ্চিত করে, মানবতাকে আশাবাদী করে তোলে। আর এখানেই মনে হয় যে, বাঙালি হিসেবে আমাদের বিবেক আসলে আমরা বন্ধক দিয়ে রেখেছি ধর্মান্ধতা ও স্বার্থপরতার কাছে। কেন এতবড় অভিযোগ তুলছি এবার সে বিষয়টিই আলোচনা করছি।
সম্প্রতি ভারত সরকার এক ঘোষণায় জানিয়েছে যে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যারাই ভারতে প্রবেশ করেছে তাদের সবাইকে সে দেশে বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হলো। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়া এবং তারও পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম ভারত এরকম একটি ঘোষণা দিল। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে, এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের কোনও পত্রপত্রিকায় তেমন কোনও লেখা চোখে তো পড়েইনি, এমনকি এত যে টেলিভিশন টকশো হয়, যার বিষয়গুলো অধিকাংশ সময়ে বিরক্তিকর রকমের ‘বোরিং’ বলে অনেককেই বলতে শুনি, সেসব টকশোয়েও এই বিষয়টি আলোচনার যোগ্য বলে কেউ মনে করেনি (আমার জানা মতে, যদি কেউ করে থাকেন তাহলে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)। অথচ এই কিছুদিন আগেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম তথা মূলধারার গণমাধ্যমে হায়-মাতম লক্ষ করা গেছে। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যুকে আমি কি অমানবিক মনে করি না? অবশ্যই মনে করি। কিন্তু এই অমানবিকতার দায় মূলত মিয়ানমারের, বাংলাদেশ এখানে কেবল বিষয়ের প্রতি মানবিক হতে পারে কেবল, কোনওভাবেই এই অমানবিকতার শিকার হওয়ার জনগোষ্ঠীর সার্বিক দায়-দায়িত্ব নিতে পারে না। আমি কোনওভাবেই রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে ৪৭-এর পর বাংলাদেশ থেকে ক্রমশ হিন্দু জনগোষ্ঠী উধাও হয়ে যাওয়া (আমি উধাও হয়ে যাওয়া এ কারণে বলছি যে, সমস্ত রকমের সংখ্যার, গবেষণার এবং তথ্যের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বীকার করে না যে, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা আসলে ক্রমশ উবে যাচ্ছে। মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুর সংখ্যা কমে যাওয়ার চিত্র যে কেউ চাইলেই মিলিয়ে দেখতে পারেন আদমশুমারি থেকেই, এটা মোটাদাগের, অন্যান্য সুক্ষ্ম উপাত্তের কথা না হয় নাই-বা বললাম)। ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে এই যে এতবড় একটি ঘোষণা দিল এবং এর ফলে বাংলাদেশকে কিন্তু একই সঙ্গে পাকিস্তানের কাতারভুক্ত করে ফেলল, এ নিয়ে আমাদের সত্যিই কোনও মাথাব্যথা আছে?
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা কিন্তু ইউরোপে আসা সিরীয় শরণার্থীদের নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন, এটা আমাদের মানবিক বোধেরই পরিচয় নিঃসন্দেহে। প্রশ্ন হলো, দেশের এই ক্রমশ নিঃশ্চিহ্ন হতে চলা হিন্দু বন্ধুদের ক্ষেত্রে আমাদের বিবেক বা মানবিকতা কেন অতিকায় ডায়নোসারের মতো লুপ্ত হয়ে যায়? হতে পারে রোহিঙ্গা বা সিরীয় শরণার্থীদের মতো (দয়া করে আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না, আমি রোহিঙ্গা ও সিরীয় শরণার্থীদের কোনওভাবেই খাটো করছিনে) ওরা মুসলিম নয়, কিন্তু ওরা কি মানুষও নয়? অনেক ব্যক্তিগত আলোচনায় আমাদের অনেক আলোকিত ব্যক্তিদের বলতে শুনেছি, ‘এদেশের হিন্দুরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যপরায়ণ নয়, ওরা এখানে আয় করে আর ভারতে বাড়ি কেনে।’ কিন্তু ১৯৭১ সাল প্রমাণ করে যে, এদেশের হিন্দুরা আসলে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের চেয়ে বাংলাদেশকে কিছু কম ভালোবাসে না। তাদের আত্মাহুতির প্রতিদান আমরা দিচ্ছি তাদের এদেশ থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে। আরও বড় কথা হলো যেহেতু মুহিক্তযুদ্ধে হতাহত হওয়া অনেক হিন্দু পরিবারই এদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়ায় আজকে অনেক কুলাঙ্গারই সংখ্যা দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে থাকে যে, এদেশে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়নি কিংবা দুই লাখ নারী পাকিস্তানের দ্বারা ধর্ষিত হয়নি। কিন্তু আজকে যখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায় তখন এদেশ থেকে বাধ্য হয়ে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের ভারত ‘শরণার্থী’ হিসেবে সে দেশে আশ্রয় দেয় এবং আমাদের বিবেকের কোনও দংশন তো দূরের কথা, কোনও হেলদোলও হয় না। অথচ, আক্রান্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্টও শরণার্থীদের আহ্বান জানায় দেশে ফিরে আসার, তিনি তাদের প্রতিশ্রুতি দেন নিরাপত্তার, দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার। আমার সবচেয়ে দুঃখ লাগে এটা দেখে যে, ভারতের এই পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনও প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখানো হয় না। অথচ, একটা সীমান্তে একটা গরু মরলেও সরকার রীতিমতো ক্ষুব্ধতা জানাতে দ্বিধা করে না। আমি জানি, এই বাক্যের পরেই আমাকে ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে আক্রমণ করা হবে, কিন্তু আমি আবারও বলতে চাই যে, ফেলানী হত্যার বিষয়টি এর আগের বাক্যের সঙ্গে কোনওভাবেই সম্পর্কিত নয়। আমার কাছে মনে হয়, ভারত যখন ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে যাওয়া শরণার্থীদের আশ্রয় ও বৈধতা দেয় তখন, তা কেবল আমাদের ব্যক্তিগত লজ্জার বিষয় থাকে না, হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের জন্যও একটি চরম লজ্জাকর ঘটনা। দুঃখজনক সত্য হলো, আমাদের লজ্জা পাওয়ার বোধটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ভালোই হবে এখনও যতটুকু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এদেশে তাদের ‘হাতে গোনা অধিকার’ নিয়ে টিকে আছে, তারাও এক সময় এদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হলে। কারণ তখন বিবেকের তাড়নায় আমাকেও আর এ রকম কোনও লেখা লিখতে হবে না। আসুন আমরা সবাই সেরকম দুর্দিনের প্রতীক্ষা করি!!
লেখক: কলামিস্ট : [email protected]
আপলোড : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০ ১৫ : বাংলাদেশ : সময় : রাত ৯. ১০ মিঃ