বৃহস্পতিবার ● ২৪ জানুয়ারী ২০১৯
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১৯০ বছর
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১৯০ বছর
রাজশাহী প্রতিনিধি :: রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১৯০ বছর পূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় স্কুল চত্ত্বরে ১৯০ বছরপূর্তি উৎসব উদ্যাপন কমিটির আয়োজনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, স্কুলের ১৯০তম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে দীর্ঘ দুই বছর ধরে উদ্যাপন কমিটি প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ, ১৯০ বছর পূর্তি উৎসব কমিটি, স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সমিতি, প্রাক্তন ছাত্র কমিটি (ঢাকা) সহ স্কুলের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে শুক্রবার শুরু হবে দুই দিনব্যাপী এ উৎসব। এছাড়াও স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী-১ আসনের সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী ও সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা উৎসবে অংশগ্রহণ করবেন।
দু দিনব্যাপী এ উৎসবের অনুষ্ঠানমালাকে চার পর্বে সাজানো হয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ১৯০ বছরপূর্তি উৎসব উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ড. মোসা. নূরজাহান বেগমের সভাপতিত্বে শুক্রবার প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাজশাহী-১ আসনের সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী, তৃতীয় অধিবেশনে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এএইচএম আব্দুল মোমেন (পিএসসি) ও চতুর্থ অধিবেশনে রাজশাহী সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়াও ১৯০ বছরপূর্তিতে জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে থাকছে আতশবাজীর ব্যবস্থা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রাক্তন ছাত্ররা বলেন, আমরা কলেজিয়েট স্কুলের সকল ছাত্র এক ও অভিন্ন। এত বড় পরিসরে ১৯০ বছরপূর্তি উৎসবটাই তার প্রমান। ব্যক্তিগত মতানৈক্য থাকলেও স্কুলের স্বার্থে আমরা সবাই কলেজিয়েটিয়ান। সেই ধারাবাহিকতায় এই ১৯০ বছরপূর্তি উৎসব আয়োজন বলে জানান তারা। সংবাদ সম্মেলনে স্কুলের প্রধানশিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষক ও প্রাক্তন ছাত্ররা উপস্থিত ছিলেন।
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল দেশের প্রথম ও অতি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঐশ্বর্য্যও ঐতিহ্যকে স্বযত্নে লালন করে আসছে সুদীর্ঘ পৌনে দুইশতাধিক কালব্যাপী। দেশের ইংরেজী শিক্ষার প্রসার লাভের জন্য লর্ড ইউলিয়াম বেন্টিং তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও উৎসাহে ১৮২৮ সালে “বউলিয়া ইংলিশ স্কুল” নামে সর্বপ্রথম এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।
পদ্মানদীর তীরে বড়কুঠির কাছাকাছি খড়ের দোচালা ঘরে টাইল নির্মিত বারান্দায় এর প্রথম কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমদিকে এটি ছিল একটি অবৈতনিক প্রাইভেট স্কুল। সেসময় স্কুলের জন্য কোন সরকারী সাহায্য বরাদ্দ ছিলনা। সুতরাং রাজশাহীতে বসবাসকারী ইংরেজ কর্মকর্তা, আইনব্যবসায়ী এবং নাটোর দিঘাপতিয়া, দুবলহাটি, পুঠিয়া ও বলিহারের জমিদারদের সাহায্য ও সহযোগিতায় স্কুলটি চলতে থাকে।
এদেশের তৎকালীন শিক্ষা বিস্তারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইউলিয়াম অ্যাডাম ১৮৩৫ সালে নাটোরে শিক্ষা জরিপ শেষে রাজশাহী বউলিয়া স্কুল পরিদর্শনের পর সরকারের কাছে স্কুলের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে ধরলে ১৮৩৬ সালে ২০ জুন স্কুলটিকে সরকারীকরণ করা হয়। এটি রাজশাহী জেলা স্কুল হিসেবে অধিগ্রহণ করে রাজশাহীর কৃতিসন্তান সারদা প্রসাদ বসুকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
সেই বছর স্কুলের মোট ছাত্র ছিল ৮৩ জন, যার মধ্যে ৭৮ জন হিন্দু, ২ জন মুসলমান এবং ৩ জন খ্রীষ্টান। ১৮৩৬ সালে ছাত্র সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৮ জন । স্কুলের শিক্ষার মান ছিল অনেক উন্নত।
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১৯৮৬ সালে দেড়শত বছরপূর্তিতে সিকান্দার আবু জাফর লিখেছেন, ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন অখন্ড বাংলায় ১৮৩৬ সালে যে তিনটি স্কুল সরকারি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় তার মধ্যে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল একটি। অন্য দু’টি হচ্ছে কলকাতার হেয়ারস্কুল এবং মুর্শিদাবাদ ইংলিশ হাই স্কুল। ১৮৫০ সালে প্রথমবারের মত উঁচু শ্রেণীর মাথাপিছু ১ টাকা হারে বেতন ধার্য করা হয়। ফলে ছাত্র সংখ্যা কিছু কমে যায়। ১৮৪৪ ও ১৮৪৫ সালে ১জন করে মোট ২ জন এবং ১৮৪৭ সালে তিন জন ছাত্র জুনিয়র বৃত্তি লাভ করে। ১৮৪৯ সালে স্কুলে একটি প্রশস্ত পাকা ভবন নির্মিত হয়। ১৮৫৭ সালে ছাত্র সংখ্যা হয় ১৪৬ জন।
সেই সময় কোন শিক্ষা বোর্ড ছিল না। অভিবক্ত বাংলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রবেশিকা (বর্তমান এস.এস.সি.) পরীক্ষা হত। ১৯৫৮ সালে স্কুলটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে। সেই বছরই মেধাবী ছাত্র মোহিনী মোহন চক্রবর্তী প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১০ টাকা মেধা বৃত্তি লাভ করে। এসময় ছাত্র বেতন বৃদ্ধি করা হয় ২ টাকা। সে বছর স্কুলে ছাত্র ছিল ২১৫ জন। এক পর্যায়ে বিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবনটি পদ্মানদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। ফলে ভাড়া করা একটি বাড়িতে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলতে থাকে। পুঠিয়ার রাজা যোগেন্দ্র নারায়নরায়ের আর্থিক সহায়তায় ১৮৬২ সালে বিদ্যালয়টির বর্তমান জায়গায় কয়েকটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়।
১৮৭৩ সালে বউলিয়া সরকারি ইংলিশ স্কুলের সঙ্গে মহাবিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণী সংযোজিত হয়। সম্ভবত তখন থেকেই এর নাম করণ হয় “রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল”। ১৮৭৪ সালে পুঠিয়ার মহারাণী শরৎসুন্দরী দেবীর আর্থিক সহায়তায় স্কুলের অতিরিক্ত দুইটি নতুন ভবন নির্মিত হয়। ১৮৭৫ সালের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৩৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৯ জন পাশ করে। তৎকালীন সময়ে এটি স্কুলের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ১৮৮৪ সালে কলেজের শ্রেণী দু’টিকে পৃথক করে বর্তমান রাজশাহী সরকারি কলেজে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তখন স্কুলটি কলেজ প্রশাসনের অধীনে চলতে থাকে।
বাংলার গভর্ণর ফুলার সাহেবের আর্থিক সহায়তায় এবং রাজনীতিবিদ খান বাহাদুর এমাদুদ্দিন সাহেবের সক্রিয় সহযোগিতায় ১৯০৭ সালে ফুলার হোস্টেলটি নির্মিত হয়। ঐ বছরই বিদ্যালয়ের জন্য পৃথক হিন্দু হোস্টেল নির্মাণ করা হয়। ১৯১২ সালে বাংলার গভর্ণর প্রথমবারের মত স্কুলটি পরিদর্শনে আসেন। সেসময় ছাত্র সংখ্যা ছিল ৫০০ জন। ১৯২৬ সালে হিন্দু হোস্টেলটি রাজা প্রমথনাথ (পি.এন) হোস্টেলে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯৩০ সালে বৃটিশ বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে স্কুলের ছাত্র সংখ্যা হ্রাস পেয়ে প্রায় ৩০০ জনে নেমে আসে। এই বছর স্কুলের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সংযোজন ঘটে। এগুলোর মধ্যে বয় স্কাউট দল গঠন, জুনিয়র রেডক্রস সংগঠন ও প্রথমবারের মত স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশনা।
১৯৩৬ সালে স্কুলের ছাত্ররা জ্যাকশন শিল্ড ও ১৯৪০ সালে ব্রাবোন শিল্ড জয় করে খেলাধুলাতেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। ১৯৪০ সালে স্কুলের লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সালেই সায়েন্স গ্যালারী নির্মিত হয়। যা ১৯৯২ সালে পরিত্যাক্ত ঘোষিত হওয়ায় ভেঙে ফেলা হয়। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত স্কুলটি রাজশাহী শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে এবং ল্যাবরেটরী স্কুল হিসেবে কাজ করে।
১৯৬৯ সালে স্কুলটি পুনরায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পরিদপ্তরের উপ-পরিচালকের নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে। ১৯৫৯ সালে প্রদেশের অন্যান্য স্কুল গুলির মধ্যে এই স্কুলটিকে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। ১৯৬২ সালে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি দোতলা বিজ্ঞান ভবনও একটি ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মিত হয় যা কলেজ থেকে স্কুলটি কে সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলে।
১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মত প্রভাতী শাখা খোলা হয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রভাতী শাখায় ৩য় থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী এবং দিবা শাখায় ৭ম থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান কর্মসূচী চালু ছিল। ১৯৯১ সালের মে মাস থেকে সরকারি এক আদেশে বিদ্যালয়ে পুরোপুরি ‘ডাবলশিফট’ কার্যক্রম শুরু হয় এবং তখন থেকেই প্রভাতী শাখায় ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি শ্রেণীতে দু’টি করে এবং দিবাকালীন শাখায়ও ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি শ্রেণীতে দু’টিকরে শাখায় পাঠদান কার্যক্রম চালু আছে।
স্কুলের জমির পরিমাণ ০.৯৭২৫ একর। এই জমি কিভাবে প্রাপ্ত সেসম্পর্কিত কোন রেকর্ড বা তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় নাই। এর মধ্যে কিছু জমি (পরিমাণ জানা যায়নি) শহরের রাস্তা সম্প্রসারণের সময় সরকারি আদেশে ছেড়ে দিতে হয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার প্রেক্ষিতে স্কুলের স্বার্থে এখন স্কুল প্রাঙ্গনে বেশ কয়েকটি নতুন বহুতল ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৩৬ সালে স্কুলের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়। ছাত্র শিক্ষক ও স্থানীয় হিতৈষী জনগণের প্রচেষ্টায় সে আমলের প্রায়লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে অনুষ্ঠানটি সাড়ম্বরে পালিত হয়। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারী মাসের ২৪ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১৫০ তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হয়। এ বর্ষপূর্তি উৎসবে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র (ম্যাট্রিক১৯৪৬) ফেডারেল ইন্সুলেন্স কোম্পানী, বাংলাদেশ এর তৎকালীন চেয়ারম্যান মরহুম এ.এইচ.এম. আব্দুল মতিন প্রদত্ত প্রায় ৮২ হাজার টাকায় (প্রথমে ৫৪ হাজার পরে ২৮ হাজার) “আব্দুল মতিন মেধাবৃত্তি” চালু করা হয়।