রবিবার ● ২৭ জানুয়ারী ২০১৯
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » বিশ্বনাথে ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব পালিত
বিশ্বনাথে ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব পালিত
মো. আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ প্রতিনিধি :: সিলেটের বিশ্বনাথে ঝপ ঝপ শব্দের তালে তালে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘পলো বাওয়া উৎসব’ পালিত হয়েছে। রোববার (২৭ জানুয়ারী) উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গোয়াহরি গ্রামের দক্ষিণের (বড়) বিলে এ পলো বাওয়া পালিত হয়। বাঁশ আর বেতের সমন্বয়ে তৈরী করা পলো ও উড়াল-চিটকি-ঠেলা জাল দিয়ে শীত উপেক্ষা করে এক সাথে মাছ শিকার করাই গ্রামবাসীর প্রধান এক আনন্দের উৎসব। তাই আনন্দের ওই উৎসব পালন করতে প্রতি বছর মাঘ মাসের অপেক্ষায় থাকেন গ্রামবাসী। গোয়াহরি গ্রামের ঐহিত্য অনুযায়ী প্রায় দু’শত বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে বাংলা বছরের প্রতি মাঘ মাসের ১ তারিখ এই পলো বাওয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কিন্ত এবছর বিলে পানি বেশী থাকায় ১মাঘের পরিবর্তে ১৪ মাঘ অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। পলো বাওয়াকে কেন্দ্র করে গোয়াহরি গ্রামে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। এতে অংশগ্রহন করেন গ্রামের কয়েক শতাধিক মানুষ।
রোববার সকাল ৮টা থেকে সৌখিন মানুষ বিলের পারে এসে জমায়েত হতে থাকেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিলের পারে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। সকাল সাড়ে ১১টায় হৈ হৈ করে একসাথে পলো-জাল হাতে মাছ শিকারে নেমে পড়েন সবাই। ঝপ ঝপ শব্দের তালে তালে চলতে থাকে পলো পাওয়া। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী এ ‘পলো বাওয়া উৎসবে’ অংশ নেন গোয়াহরি গ্রামের সব বয়সী পুরুয়। গ্রামের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি ঘর থেকে একজন পুরুষ পলো নিয়ে উৎসবে অংশগ্রহন করেন। যাদের পরিবারে পুরুষ সদস্য বাড়িতে নেই, তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে কোন আত্মীয় মাছ শিকারে অংশগ্রহন করেন। এবছর বিলে অধিক পানি ও কচুরিপানা থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় মাছের সংখ্যা কম বলে জানিয়েছেন শিকারীরা। তাই অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হয় ঘরে।
সরেজমিনে গোয়াহরি বিলে গিয়ে দেখা যায়, বিলে তরুণ-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সবাই বোয়াল, রুই, গজার, ব্রিগেড, শোল, বাউশ, কার্পু, তেলাপিয়া’সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করেন। তবে বড় মাছের চেয়ে এবার ছোট মাছের সংখ্যা ছিল বেশী। একেকটি মাছ শিকারের সাথে সাথে চিৎকার করে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করেন শিকারীরা। শিকারীদের ওই আনন্দের সাথে সাথে তাল মেলান বিলের তীরে অপেক্ষমান গ্রামের মুরব্বী, মহিলা ও শিশুরা। দূর থেকে আসা অনেকের আত্বীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বিলের পাড়ে।
এই উৎসবের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় বাবা-চাচা, ভাই-দাদা, মামা-ফুফার সাথে আসা শিশুরা। নিজের আত্মীয়-স্বজনের কেউ মাছ শিকার করলে তাদের আনন্দ আর কে দেখে! বিলের তীরে শিশুরা অপেক্ষা করে কখন নিজের কেউ মাছ শিকার করে এনে তাদের হাতে দেবেন, আর তারা কখন মাছটি বহন করে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। মাছ ধরতে বড়দের পাশাপাশি অনেক শিশুও জাল নিয়ে নেমে পড়ে বিলে। গোয়াহরি গ্রামে নানার বাড়িতে বেড়াতে আসা ৭বছর বয়সী শিশু সালমান সে তার মামার সঙ্গে বায়না ধরে মাছ শিকারে নামতে। তাই ছোট হাতা জাল নিয়ে সে মাছ ধরতে নেমে পড়ে বিলের তীরে। এরপর ছোট একটি মাছ ধরতে পেরে সে খুবই আনন্দে বলে ‘আমার আব্বা আমারে লইয়া আমি ই মাছ খাইমু’।
পলো বাওয়া উৎসবকে কেন্দ্র করে গোয়াহরি গ্রামে গত কয়েকদিন ধরে উৎসবের আমেজ রিবাজ করছিল। এই উৎসব চলবে ১৫দিন পর্যন্ত। গোয়াহরি গ্রামের পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে এই পনের দিন বিলে মাছ ধরায় আটল (নিশেধাজ্ঞা) জারি করা হয়েছে। তবে গ্রামবাসীর ঐতিহ্য অনুযায়ী আগামী ১৫ দিন পর ২য় ধাপে পলো বাওয়া হবে। এই পনের দিনের ভিতরে প্রতি রবিবার ও বৃহস্পতিবার বিলে হাত দিয়ে মাছ ধরা হবে এবং কেউ চাইলে ছোট ছোট জাল (হাতা জাল) দিয়ে মাছ ধরতে পারবেন।
গ্রামের প্রবীণ মুরব্বী হাজী আব্দুল আহাদ বলেন, পলো বাওয়া উৎসব আমাদের গ্রামের একটি ঐতিহ্য। আমাদের গ্রামবাসী পূর্বপুরুষের আমল থেকে এই উৎসব পালন করে আসছেন। বয়সের কারণে এখন আর পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারি না। তবে জীবনে ওই বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ শিকার করেছি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য গোলাম হোসেন বলেন, ‘পলো বাওয়া’ উৎসব আমাদের পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য। দীর্ঘকাল ধরে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমরা গ্রামবাসী এই উৎসব পালন করে থাকি। এই উৎসবের আনন্দ অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে পাওয়া যাবে না।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল মছব্বির, আব্দুল আওয়াল, ক্বারী আবুল হোসেন, সাদিক হোসাইন ও কানাডা প্রবাসী ফয়সল আহমদ জানান, তারা ‘দীঘদিন ধরে প্রবাসে বসবাস করে আসছেন। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দেশে আসতে না পরায় তারা প্রতি বছর পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। পলো দিয়ে মাছ শিকার তাদের কাছে একটি মজার বিষয়। তাই এবার অংশগ্রহন করতে পারায় তারা আনন্দিত।