বৃহস্পতিবার ● ৩১ জানুয়ারী ২০১৯
প্রথম পাতা » পাবনা » ঐতিহাসিক স্থান পাকশী থেকে রেলওয়ে অফিস সরিয়ে নেয়ার প্রতিবাদে মানববন্ধন
ঐতিহাসিক স্থান পাকশী থেকে রেলওয়ে অফিস সরিয়ে নেয়ার প্রতিবাদে মানববন্ধন
ঈশ্বরদী প্রতিনিধি :: স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের ঐতিহাসিক স্থান পাকশী থেকে রেলওয়ে অফিস ও শহর উচ্ছেদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করা হলে জীবনের বিনিময়ে হলেও উচ্ছেদকাজ বন্ধ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন সর্বস্তরের পাকশীবাসীরা। আজ বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় ফুটবলমাঠে পাকশী রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে আয়োজিত মানববন্ধন ও বিশাল সমাবেশে বক্তারা এ ঘোষণা দেন। প্রায় তিনঘন্টা ব্যাপি অনুষ্ঠিত মানববন্ধন সমাবেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক,শিক্ষার্থী,হরিজন সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার কয়েক হাজার শংকিত মানুষ অংশ নেন। পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলামের সভাপতিত্বে শ্রমিকলীগের সাবেক কেন্দ্রিয় নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা এম.রশিদউল্লাহ,আওয়ামীলীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম, জেলাপরিষদ সদস্য সাইফুল ইসলাম বাবু মন্ডল, জেলা জাসদ নেতা জাহাঙ্গীর আলম,পাকশী ইউপি চেয়াম্যান এনামুল হক বিশ্বাস, আবু তারেক, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, অধ্যক্ষ পারভেজ খান ও আনজাম হোসেন ডন, হরিজন ফুলিয়া,মনোয়ারা বেগম, নাদিরা বেগম, সাবিনা বেগম, ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন, সুলতান আহমেদ, শ্রমিকলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ রানা, আনোয়ার হোসেনসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার ২১ জন বক্তব্য দেন ।
বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা জাফর সাজ্জাদ খিচ্ছু কর্তৃক ঢাকার পর পাকশী ফুটবল মাঠের খেজুর তলায় ঈশ্বরদী অঞ্চলে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। মেরিন পাড়া কলোনী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া হয় এবং মুক্তি যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। পাকশীতে এলাকাবাসীর বাবা-মাসহ স্বজনদের কবর ও গণকবর,খানকা শরীফসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাপনা রয়েছে যার প্রত্যেকটির সাথে এলাকার মানুষের হাজারো স্মৃতি জড়িত আছে।
বক্তারা আরও বলেন, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিরাপত্তা বাহিনীর ফোর্স বেইজ স্থাপনের লক্ষ্যে পাকশী রেলওয়ের পরিত্যাক্ত জমি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত পাকশী রেলওয়ে শহরের প্রায় সাতশত একর জমি রেলওয়ের কাছে বিজ্ঞান মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে চাওয়া হয়েছে। এ পরিমাণ জমি দেওয়া হলে পাকশীতে অবশিষ্ট কিছুই থাকবেনা। তাছাড়া রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিরাপত্তা বাহিনীর ফোর্স বেইজ স্থাপনের লক্ষ্যে পাকশী রেলওয়ের যে জমি চাওয়া হয়েছে সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর ফোর্স বেইজ স্থাপন করা হলে পাহাড়ের ন্যায় উঁচু ঈশ্বরদী- খুলনা রেললাইন হবে প্রধান বাধা। নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। বক্তারা পদ্মার চরাঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর ফোর্স বেইজ স্থাপন করার পরামর্শও দেন। তারা আগামি সোমবার গোটা পাকশীবাসীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারক লিপি প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ সেতর নির্মাণকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ আমলে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠে রেলওয়ে শহর পাকশী । সে সময় দৃষ্টিনন্দিত সবুজে ঘেরা শালিক পাখির বাসার ন্যায় রেলওয়ে শহরকে ঘিরে অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য়ের কারণে পাকশীকে বলা হতো প্রিন্স অব পদ্মা। সেই পদ্মা পাড়ে সে সময়েই গড়ে ওঠে অপরুপ সৌন্দর্যের নগরী পাকশী। এ নগর থেকেই এক সময় ভারত বর্ষের মধ্যে ট্রেন চলাচল করত। ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষও ছিল এখানে। পাকশীকে ঘিরেই সাঁড়া ঘাটে ভিরত দেশী-বিদেশী জাহাজ স্টিমার। নাবিকরাও অবস্থান করত এ নগরীতে। এ নগরীর হারানো সৌন্দর্যের অবশিষ্ট অংশ এখনও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এখানে এখনও অবশিষ্ট রয়েছে হার্ডিঞ্জ সেতুর প্রধান প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেইলসের বাংলো। ইউরোপের খামার বাড়ির আদলে নির্মিত নয়নাভিরাম বাংলোটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ শহরে। মুক্তিযুদ্ধের চারনভুমি পাকশী শহরে রয়েছে অসংখ্য গণকবর,ঐতিহাসিক খানকা শরীফ,হাসপাতাল,রেলওয়ে কর্মকর্তাকর্মচারিদের বাসা। প্রয়োজনের তাগিদে পর্যায়ক্রমে এখানে স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকার কলেজ,একাধিক স্কুল,মসজিদ,মাদ্রাসা,মন্দির,গীর্জ,এতিম খানা,শারিরীক শিক্ষা কলেজ। এছাড়াও রয়েছে পাবনা জেলার সাংস্কৃতির গোড়া পত্তনকারী হাসেম আলী মিলনায়ন। যেখান থেকে সাংস্কৃতির আলো ছড়ানো হয়ে থাকে সারা বিশ্বে। প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরীরও অভিনয়ের হাতে খড়ি হয়েছে এখান থেকে। স্থাপিত হয়েছে রেলওয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও পুলিশ লাইন। রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার ও চাঁনমারী। ইপিজেড,রুপপুর পরমাণু প্রকল্প, রেলওয়েকে ঘিরে এখানে বর্তমানে হাজার হাজার শ্রমিক,কর্মচারি ও কর্মকর্তাদের বসবাস রয়েছে । এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছিন্নমূল পরিবার। এখানকার বিদ্যালয়ে পিএসসি,জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রও রয়েছে এখানে। এখানে একটি বৃহৎ পুরাতন কবরস্থান ও গীর্জা রয়েছে। প্রায় শতাধিক কোটি টাকা ব্যায়ে শুরু হয়েছে ঈশ্বরদী-রুপপুর পরমাণু প্রকল্পের লিংক রেলওয়ে লাইন স্থাপনের কাজ। প্রায় ১০/১২ বছরের মধ্যে শুরু হবে দ্বিতী হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের কাজ। বন্ধ রয়েছে দেশের বৃহৎ কাগজ কল । এখানে রয়েছে একটি বাজার। সব মিলিয়ে পাকশী নগরীতে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। প্রায় দু’লক্ষাধিক মানুষের আবাসভুমি পাকশীতে বঙ্গবন্ধু,জেলহত্যায় শহীদ চার নেতা ,মওলানা ভাষানী,হোসেন শহীদ সোরয়ার্দী,মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশ বরেণ্য ব্যাক্তিদের পদধুলি পড়া পাকশী নগরীকে কেন্দ্র করে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ভিড় করে এ এলাকায়। সম্প্রতি রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিরাপত্তা বাহিনীর ফোর্স বেইজস্থাপনের লক্ষ্যে পাকশী রেলওয়ের পরিত্যাক্ত জমিসহ পাকশী রেলওয়ে শহরের বাজার,কয়েকটি বসবাসযোগ্য জনবহুল কলোনী,অফিস এলাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের অনুকুলে হস্তান্তরের প্রস্তাব গোটা পাকশী বাসীদের দিশেহারা করে তুলেছে। শংকিত অবস্থায় পাকশীবাসীদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে হচ্ছে। রেলওয়ে অফিসসহ যদি এসব জমি হস্তান্তর করা হয় তাহলে পাকশী ইউনিয়নের দু’টি ওয়ার্ড বিলুপ্ত হয়ে যাবে।সূত্রমতে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের জনবান্ধব সরকার কারও আবাসস্থল কেড়ে নেয়না, বরং সারা দেশেই মানুষকে আবাসস্থল প্রদান করে যাচ্ছে। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিরাপত্তা বাহিনীর ফোর্স বেইজ স্থাপনের লক্ষ্যে পাকশী রেলওয়ের যে সব জমি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে ,সেসব জমিতে নিরাপত্তা বাহিনীর ফোর্স বেইজ স্থাপন করা হলে প্রধান বাধা হবে হার্ডিঞ্জ সেতু সংযুক্ত প্রায় একশ ফুট উঁচু ঈশ্বরদী-খুলনা মেইন রেলওয়ে লাইন, ঈশ্বরদী থেকে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় একশ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মানাধীন রেললাইন এবং প্রায় ১০/১৫ বছর পর নির্মিতব্য দ্বিতীয় হার্ডিঞ্জ সেতু।
এই চর এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর ফোর্স বেইজ স্থাপন করা হলে একদিকে পাকশী রেলওয়ে অফিসসহ কয়েক হাজার কোটি টাকায় নির্মিত নানা প্রকার স্থাপনা রক্ষা পাবে এবং রেলওয়ে বিভাগও স্বচ্ছন্দের সাথে কাজ করতে পারবে। অন্যদিকে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিরবিছিন্ন নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পাকশী এলাকাবাসীর সমস্যাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সুষ্ঠ সমাধানে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ ভ’মিকা রাখবেন বলে পাকশীবাসী বিশ্বাস করে। সে আসা নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর নিকট গোটা পাকশীবাসীর আকুল আবেদন ঐতিহাসিক পাকশী নগরীকে রক্ষায় আপনার জরুরি ও দয়ালু হস্তক্ষেপ এক্ষনই শুরু করা হোক।