সোমবার ● ৪ মার্চ ২০১৯
প্রথম পাতা » আন্তর্জাতিক » ভিসা ছিল না ডা. শেঠীর
ভিসা ছিল না ডা. শেঠীর
সিএইচটি মিডিয়া অনলাইন ডেস্ক :: সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয় ভারতের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবী শেঠীকে। তবে দেবী শেঠীর বাংলাদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা মোটেই সহজ ছিলো না।
এক রাষ্ট্র থেকে আরেক রাষ্ট্রে যাবেন দেবী শেঠী, ভিসা তো লাগবেই। বাংলাদেশে যেতে হবে সেটা দেবী শেঠী জেনেছেন আজ সোমবার ভোরে।
দেবী শেঠী থাকেন ভারতের বেঙ্গালুরুতে। ভোর থেকেই তাকে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রকিয়া সম্পন্ন করতে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে পড়েন কলকাতার উপ-হাইকমিশনের কর্মকর্তারা।
প্রথমবার নিয়মের ঊর্ধ্বে উঠে কনস্যুলার মনসুর আহমেদ বিমানবন্দরে গিয়ে বাংলাদেশের ভিসা প্রসেসের সব কাজ সম্পন্ন করেন। এমন ঘটনা কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের জন্যই ইতিহাসে প্রথম।
এ বিষয়ে কনস্যুলার মনসুর আহমেদ বলেন, কাকডাকা ভোরে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ফোন আসে উপ-হাইকমিশনার তৌফিক হাসানের কাছে।
এরপরই শুরু হয় ব্যস্ততা। উপ-হাইকমিশনের প্রধান তখনই জানান তৃতীয় সচিব কন্স্যুলার শেখ শাফিন হককে। শুরু হয় প্রক্রিয়া। শেখ শাফিন সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করেন আমার সঙ্গে।
ঘুম ঘুম চোখেই আমি বেঙ্গালুরুতে যোগাযোগ করি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠীর সঙ্গে। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ১৫ মিনিট অবধি টেলিফোনে বাংলাদেশ সরকার ও দেবী শেঠীর কলকাতার ডাইরেক্টটরের সঙ্গে আলাপ চলে। কথা হয় দেবী শেঠীর সঙ্গেও।
কনস্যুলার মনসুর আহমেদ আরো বলেন, দেবী শেঠীর ভিসা সংক্রান্ত ফরম পূরণ অনলাইনে আমরাই করি। কিন্তু পাসপোর্ট ওনার সঙ্গে। তাই প্রটোকল ভেঙে ছুটে যাই কলকাতা বিমানবন্দরে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের বেঙ্গালুরু থেকে আসার অপেক্ষা করতে থাকি। দেবী শেঠী স্থানীয় সময় ৮টা ৩০ মিনিটে বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন।
আমরা অপেক্ষায় থাকি তার অবতরণের জন্য। ১০টা ৩০ মিনিটের কিছু পরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন দেবী শেঠী।
ততক্ষণে উপ-হাইকমিশনের পক্ষ থেকে সমস্ত কাজ এগিয়ে রাখি। মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে পাসপোর্টে দেওয়া হয় ভিসার সিল। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ ফ্লাইটে ১২টার দিকে দেবী শেঠীকে তুলে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, একদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের জন্য দুশ্চিন্তা অন্যদিকে চিন্তা ছিলো তাড়াতাড়ি ভিসা প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করার। অবশেষে প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবী শেঠী ঢাকায় পৌঁছান ১২টা ৪৭ মিনিটে।
দ্রুততম সময়ে ঢাকায় তার পৌঁছানোর কৃতিত্ব আমার একার নয়। পুরো উপ-হাইকমিশনের কর্মীদের। বিশেষ করে জাহিদ হোসেন, আলম ও তৃতীয় সচিব কনস্যুলার শেখ শাফিন হকের।
এদিকে গুরুতর অসুস্থ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে দেখে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন ডা. দেবী শেঠি।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ কাদেরপত্নী ইসরাতুন্নেসা কাদেরকে এসময় বলেন, ‘ইউর হাজব্যান্ড ইজ লাকি। হি ইজ নাউ সেভ পজিশন।’ এসময় ইসরাতুন্নেসা কাদের ডা. শেঠিকে কৃতজ্ঞতা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে সাড়া দিয়ে আজ সোমবার দুপুরে বাংলাদেশে আসা এই ভারতীয় কার্ডিওলজিস্ট কাদেরপত্নীকে আশ্বস্ত করে বলেন, আপনি অনেক ভাগ্যবান। তার সব চিকিৎসাই এখানে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আপনার স্বামী এই জটিল মুহূর্তে এখানে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে যে চিকিৎসা পেয়েছেন ইউরোপ-আমেরিকাতেও এর চেয়ে ভালো চিকিৎসা পেতেন না।
সোমবার দুপুরে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) লাইফ সাপোর্টে থাকা ওবায়দুল কাদেরকে দেখেন ভারতের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবী শেঠি। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা।
ডা. শেঠি বেরিয়ে এলে এগিয়ে যান ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইসরাতুন্নেসা কাদের। তিনি স্বামীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান।
এসময় এই কার্ডিওলজিস্ট কাদেরপত্নীকে বলেন, ইউ আর ভেরি লাকি। ইউর হাজবেন্ড ইজ ভেরি লাকি। হি ইজ নাউ ইন সেভ পজিশন।
এসময় কাদেরপত্নী ডা. শেঠির প্রতি ও মেডিকেল বোর্ডের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইসরাতুন্নেসা কাদের বলেন, ‘ডাক্তার বলেছেন উনার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আপনারা সবাই দোয়া করবেন। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।’
মেডিকেল বোর্ডের সদস্য বিএসএমএমইউ-এর উপাচার্য ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, বিএসএমএমইউর চিকিৎসার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ডা. দেবী শেঠি।
ডা. দেবী শেঠী সেতুমন্ত্রীর করা সব রিপোর্ট দেখেন। এনজিওগ্রাম দেখার পর কিছুক্ষণের জন্য তাকে পর্যবেক্ষণে রাখেন।
পরে তিনি (ডা. শেঠী) বলেন, তার যা চিকিৎসা প্রয়োজন সবটাই করা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি চিকিৎসা ইউরোপ-আমেরিকাতেও হয় না। এখন চাইলে আপনারা তাকে শিফট করতে (দেশের বাইরে) পারেন।
ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া জানান, ওবায়দুল কাদেরের অবস্থার উন্নতি হলেও শঙ্কামুক্ত নন। তার শারীরিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তার রক্তে ইনফেকশনের ঝুঁকি আছে। রক্তে ইনফেকশনের মাত্রা ১৮০০ ছিল, যা বেড়ে ২৬০০ হাজার। তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক আছে।
কনক কান্তির ভাষ্য, ‘উনারা (ডা. দেবী শেঠি ও সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা) বললেন যে বিভিন্ন রকম জটিলতা হতে পারে। এখন যেহেতু রিলেটিভলি অনেক সেফ পজিশনে আছে (ওবায়দুল কাদের) আপনাদের যদি এ রকম কোনো চিন্তাভাবনা থাকে (বিদেশে নেয়ার) তা হলে দিস ইজ দ্য অপটিমাল টাইম টু শিফট হিম।
পরে যদি এর চেয়ে আরও জটিলতা তৈরি হয়, তখন শিফট করাটা রিলেটিভলি মোর রিস্কি। তিনি (ডা. দেবী) বলেন, এখন যদি আপনারা নিতে চান তা হলে আমারও অ্যাডভাইস হবে যে আজকে দিনে উনাকে শিফট করার।’
কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘যেহেতু আমরা একটা জিনিস চিন্তা করে রেখেছিলাম একটা জটিলতার কথা। তার (ওবায়দুল কাদের) কোনো জটিলতা তেমন হয়নি। একটা সামান্য কিছু জটিলতা এবং তাকে (দেবী শেঠি) যেহেতু আমন্ত্রণ করা হয়েছে, সেহেতু আমরা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, যেটা মাউন্ট রয়েল এলিজাবেথ থেকে আনা হয়েছিলো সেটাকে আমরা রেখে দিয়েছিলাম।
তাদেরকে আমরা বলেছি, আপনি যতদ্রুত সম্ভব তাকে স্থানান্তর করতে পারবে। উনার মন্তব্য পাওয়ার পর আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তথ্যটি দিলাম এবং তিনিও বললেন, ঠিক আছে তা হলে তাদের নিয়ে যেতে বল।’
এর আগে ওবায়দুল কাদেরের সবশেষ শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন ডা. দেবী শেঠিসহ মেডিকেল বোর্ড। এ সময় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে ঢাকায় আসা তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলও ছিল।
ওবায়দুল কাদেরকে দেখার পর ডা. দেবী শেঠি তাকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া।
তিনি জানান, ওবায়দুল কাদেরের অবস্থা উন্নতির দিকে। এই মুহূর্তে তাকে বিদেশ নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে কোনো ঝুঁকি নেই। ডা. কনক কান্তি জানান, ওবায়দুল কাদেরকে মাউন্ট এলিজাবেথে নেয়া হচ্ছে।
ওবায়দুল কাদেরের সবশেষ শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেছেন ডা. শেঠি। সোমবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ডা. দেবী শেঠি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজে ওবায়দুল কাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে বিকেলে প্রধানমন্ত্রীকে সেই বিষয়ে অবহিত করেন ডা. শেঠি।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন ওবায়দুল কাদেরের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হচ্ছে। ছবিতে দেখা যায়, ওবায়দুল কাদেরের নাকে মুখে নলসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি লাগানো রয়েছে।
এ ধরনের ছবি প্রকাশিত হওয়ায় বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা যেমন চটেছেন তেমনি প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।এই খবরটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছেছে। ছবিটি কখন, কিভাবে, কে তুলেছে, কে এই বা পোস্ট দিয়েছে তা জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
নাম প্রকাশ না করে মেডিকেল বোর্ডের এক চিকিৎসক বলেন, ‘আইসিইউতে রোগী জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকেন। এ অবস্থায় ছবি তোলা তো অনেক দূরের কথা, দেখা করতে গেলেও মুখে মাস্ক, পায়ে জুতা ও শরীরে গাউন দিয়ে ঢেকে তবেই যেতে হয়। কিন্তু তাকে দেখতে গিয়ে মন্ত্রী, সাংসদ ও রাজনীতিবিদদের অধিকাংশই সংক্রমণের কথা ভাবেননি।