সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০১৯
প্রথম পাতা » ঢাকা » জামায়াতের সরিষাতেই ভুত
জামায়াতের সরিষাতেই ভুত
সিরাজী এম আর মোস্তাক, ঢাকা :: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে সরিষাদানা ব্যবহার করে ভুত তাড়ায়, তাতেই ভুত রয়েছে। সম্প্রতি দুজন নেতা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এটি স্পষ্ট হয়েছে। তাদের বিদায়ী বক্তব্য, জামায়াতের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছে। এদের একজন জনাব ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ১৯৭১ সালে জামায়াতের প্রাক্তন নেতাদের ভূমিকার জন্য বর্তমান নেতৃবৃন্দকে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের পক্ষে ডিফেন্স টিমের প্রধান কৌশুলি ছিলেন। তিনি ট্রাইব্যুনালে দন্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতাদের নির্দোষ প্রমাণে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। তিনি চেষ্টা করেছেন, মাওলানা সাঈদীসহ দন্ডপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দ ১৯৭১ সালে জঘন্য অপরাধে জড়িত ছিলেননা। এজন্য তিনি বহুবার মিডিয়ার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে দেশের সাঈদীভক্ত জনতা অনুপ্রাণিত হয়েছে। তারা সাঈদীকে ফাঁসির রায়ের বিরূদ্ধে ফুঁসে উঠেছে এবং আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে চাঁদে দেখেছে। এ ঘটনায় শত শত নারী-পুরুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং বহু আহত ও পঙ্গু হয়েছে। এতে সাঈদীর ফাঁসির দন্ড কমে যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। এটি ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাকের সফলতা। এখন তিনিই সুর পাল্টিয়ে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে পরামর্শ দিয়েছেন- ১৯৭১ সালে প্রাক্তন নেতাদের প্রচলিত অপরাধ স্বীকার করতে এবং প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে। এতে ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাকের আইনি লড়াই এবং চেতনাগত পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়েছে। এ ডিফেন্স টিমের জন্যই জামায়াত নেতাদের ফাঁসি হয়েছে। এটি জামায়াতের ভুতযুক্ত সরিষাদানা।
ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক যেজন্য জামায়াতের ভুত সাব্যস্ত হয়েছেন, এর বহু সমর্থক এখনো তা ধারণ করেন। এটি জামায়াতের ব্যর্থতা। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে কিছু ভ্রান্তি রয়েছে। ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক একাংশ প্রকাশ করেছেন মাত্র। জামায়াত নেতৃবৃন্দের উচিত, এসকল ভ্রান্তি দূর করা।
এখানে জামায়াতের দু’একটি ভ্রান্তি তুলে ধরছি। এর সমর্থকগণ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘোষিত ৩০লাখ শহীদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে ইসলাম বিদ্বেষী মনে করেন। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু ভুলবশত ৩লাখ শহীদের পরিবর্তে ৩মিলিয়ন বলেছেন। তাদের এ ধারণা পবিত্র কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। পবিত্র কোরআনে বহু আধিক্যবাচক আয়াত রয়েছে। আল্লাহ পাক সুস্পষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করেও আধিক্য বুঝিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানকারী লাখো শহীদের সংখ্যা ঘোষণার শিক্ষাটি বঙ্গবন্ধু পবিত্র কোরআন থেকেই নিয়েছেন। তিনি পবিত্র কোরআনের আলোয় আলোকিত একজন কোরআনপ্রেমী মুসলমান ছিলেন। তিনি যতবার জেলে গেছেন, প্রয়োজনীয় বস্ত্রের সাথে একটি কোরআন কাছে রেখেছেন। (বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। তিনি ৩০লাখ শহীদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ঘোষণা করলেও এর তালিকা করেননি। তিনি ৩০লাখ শহীদের পক্ষ থেকে মাত্র ৭জনকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দিয়েছেন; যেন মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানকারী সকল শহীদই শ্রেষ্ঠ মানের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃত হন। তিনি জীবিত যোদ্ধাগণকে শহীদের চেয়ে নিন্ম স্তরের পদবি দিয়েছেন। তিনি ১৯৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালির পক্ষ থেকে মাত্র ৬৬৯ জনকে বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাব দিয়েছেন। তাঁর শাসনামলে এ ৬৭৬ খেতাবধারী শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা ব্যতিত আর কোনো তালিকা ছিলনা। এ তালিকা ব্যতিত সবাইকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারভুক্ত করেছেন। তাঁর সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিলনা। তিনি চাকুরিতে প্রবেশে বয়স সীমাবদ্ধ করেননি। বঙ্গবন্ধু বহু বৃদ্ধকে ডেকে চাকুরি দিয়েছেন। এটিই বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা এবং ইসলামের দিক-নির্দেশনা বটে। এবিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা, জামায়াতের ব্যর্থতা।
ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক যে ট্রাইব্যুনালে ছিলেন, এতে আন্তর্জাতিক শব্দ থাকলেও এর বিচারক ও অপরাধী সবাই বাংলাদেশি। হানাদার পাকিস্তান বা অন্য দেশের বিচারক ও অপরাধী কেউ নেই। বাংলাদেশের বিচারকগণ এ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বসে ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাকের ডিফেন্স টিমের সহায়তায় শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদেরই অভিযুক্ত করেছেন। তারা প্রমাণ করেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত জঘন্য অপরাধসমূহ শুধু বাংলাদেশিরাই করেছে। পাকিস্তানিরা অপরাধী নয়। এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত হয়েছে, ১৯৭১ এর ইতিহাসে যাই থাকুক; বর্তমান বাংলাদেশীরাই যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধী প্রজন্ম। পাকিস্তানিরা নয়। ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক পেশাগত স্বার্থে জামায়াত নেতাদের নিরপরাধ বললেও, তাঁর পদত্যাগকালীন বক্তব্যে প্রকৃত সত্য ফুটে উঠেছে। জামায়াত ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাককে দিয়ে ভুত তাড়াতে গিয়ে, নিজের সরিষার ভুতেই আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং এর নেতৃবৃন্দের উচিত- সকল ভ্রান্তি নির্ণয় ও দলীয় ভুত চিহ্নিত করে, তা থেকে দলকে রক্ষা করা।
এই লেখাটি লেখকের নিজস্ব মতামত : লেখাটির যে কোন মতামতের জন্য সিএইচটি মিডিয়া কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।