বুধবার ● ৬ জানুয়ারী ২০১৬
প্রথম পাতা » পাবনা » প্রাকৃতিক নৌসর্গিকময় পাকশী পর্যটনের সম্ভাবনাময় কেন্দ্র
প্রাকৃতিক নৌসর্গিকময় পাকশী পর্যটনের সম্ভাবনাময় কেন্দ্র
তামিমুল ইসলাম তামিম, ঈশ্বরদী :: নদীতে পাল তোলা নৌকা, স্প্রিড বোট, ষ্টিমার, বড় বড় ট্রলার, মাড়োয়ারিদের আনাগোনা না থাকলেও ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেলস এর বাংলো, বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের কার্যালয়, সজ্জিত ইংল্যান্ডের তৈরি বাষ্প চালিত ন্যারোগেজ ইঞ্জিন এবং মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংশকারী বোমার ধ্বংসাবশেষ এখনও রয়েছে পাকশীর হারানো ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারন করে৷ সেই পাকশী কেন্দ্রীক ঈশ্বরদী আজ নিজ মহিমায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিশ্ব মানচিত্রে৷ এখানেই গড়ে উঠছে বিশ্বের ৩২তম পারমানিবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প৷ এটিই আমাদের দেশের একমাত্র পারমানবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প৷
যেটির মাধ্যমে আমাদের দেশ বিদ্যুত্ উত্পাদনে স্বয়ং সম্পূন্ন হওয়ার পাশাপাশি সারা দেশকে আলোকিত করে তুলবে৷ এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী পাকশী আবারও ফিরে পাচ্ছে তার হারানো গৌরব৷ পাকশী ইউনিয়নের রুপপুর আজ বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেয়েছে নিজ মহিমায়৷ ঈশ্বরদীর আদৌপানত্মো খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে পাকশী ও রেলওয়ে ভূমিকা৷ পর্যটনের উদার সম্ভাবনাময় পাকশী প্রাকৃতিক নৌস্বর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর৷ শতবর্ষি কড়ই গাছের সারি মুগ্ধ করে ভ্রমণ পিষাসুদের মনকে৷
সূত্র মতে, ১৮৬২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতবর্ষে ট্রেন চলাচল শুরুর মধ্য দিয়ে পাকশী পদ্মা নদীর সাড়াঘাট পায় নগরী জীবনের স্বাধ৷ প্রতিষ্ঠা পায় রেলওয়ে স্টেশন৷ পরবর্তীতে কালে পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন রেল স্টেশন স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়৷ ২৪ হাজার ৪’শ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নির্মান কাজ শেষে ১৯১৫ সালের ৪ঠা মার্চ পাকশী হার্ডিজ্ঞ ব্রিজের উপর দিয়ে রেল চলাচল শুরু করে৷ ৭১’এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকন্তানী দোসরদের প্রতিরোধ করতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানী দোসরদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নং স্পানটি বোমার আঘাতে ভেঙ্গে যায়৷ পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে ইন্ডিয়া রেলওয়ের সহযোগীতায় ১২ নং স্পানটি পূর্নঃনির্মান করা হয়৷
এরপর ১৯৭৫ সালের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান তত্কালীন সময়ে পুনরায় রেল চলাচল উদ্বোধন করেন৷ ১৯১০ সালে পাকশীতে পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নির্মাণকাজ শুরু হয়৷ ১৯১৫ সালে এ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্থাপিত হয়৷ ২ কিলোমিটার দীর্ঘ ইয়ার্ড ও স্টেশনটিতে ১৭টি রেললাইন স্থাপন করা হয়৷ মূলত এ সময় থেকে দেশের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের রেল যোগযোগ স্থাপিত হয়৷ সে সময় ঈশ্বরদীর উপর দিয়ে অনেক যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করত৷ দীর্ঘ প্রায় ১’শ বছরে সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে৷ তারই ধারাবাহিকতায় আসত্মে আসত্মে পাকশীকে কেন্দ্র করে ঈশ্বরদীতে মানুষের বসতি বাড়তে থাকে৷
১৯১০ সালে হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে পদ্মার কোল ঘেষে পাকশী শহর প্রতিষ্ঠিত হয়৷ হার্ডিঞ্জ সেতু নিমার্ণ শেষে এ শহরের মধ্যস্থলে প্রতিষ্ঠা করা হয় রেলের বিভাগীয় কন্ট্রোল অফিস৷ এখান থেকে দেশের অভ্যনত্মরে ও ভারতের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনের তদারকি করা হত৷ রেলের কন্ট্রোল অফিসের পাশেই পদ্মা নদীতে ছিল ঐতিহাসিক সাঁড়া ঘাট৷ এ ঘাটে নিয়মিত ভিড়ত দেশী বিদেশী যাত্রী ও মালবাহী জাহাজ ষ্টিমার৷ এ ঘাট থেকে সহজেই নদী পথে ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যেত৷ বর্তমানে সাঁড়া ঘাটে দেশী-বিদেশী জাহাজ স্টিমার না ভিড়লেও ভিন্ন ভিন্ন কারণে পাকশীর আর্কষণ বেড়েই চলেছে৷ বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি হয়েছে ঈশ্বরদী ইপিজেড৷ রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণের কাজ চলছে দূত গতিতে৷ এই প্রকল্প নির্মাণ ও ইপিজেডকে ঘিরে এখানে বিদেশীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ প্রায় সারা বছরই পাকশীতে জেলেদের কর্ম ব্যস্ততা লক্ষ করা যায়৷ পাকশী থেকে দেশের সকল অঞ্চলের যোগাযোগ খুবই সহজ৷ বিমান, রেলপথ, সড়কপথ, নদীপথে পাকশীতে সহজেই আসা-যাওয়া সম্ভব৷ এছাড়াও পাকশীতে রয়েছে রেলওয়ে আর্কষনীয় একাধিক টানেল, মিনি চিড়িয়াখানা ও পাকশী রিসোর্ট যা সহজেই বিদেশী পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়৷ নদীতে পাল তোলা নৌকা, স্প্রিড বোট ও ট্রলার নদী ভ্রমণের কাজে লাগে৷ পর্যটকরা কোথাও না গেলেও ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেলস এর বাংলো এবং বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের কার্যলয়ের সামনে বিভিন্ন রং এর সজ্জিত ইংল্যান্ডের তৈরি বাষ্প চালিত ন্যারোগেজ ইঞ্জিন এবং ইঞ্জিনের পাশে রক্ষিত মুক্তিযুদ্ধে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বিধ্বংসী বোমার ধ্বংশাবশেষ দেখতে যান৷
কন্টিকারীর জঙ্গল আর তার ফুল, সাথে রয়েছে শত বছর পুরোনো সারি সারি কড়ই গাছ৷ যেন প্রকৃতির এক বিস্তীন্ন সৌন্দর্যঞ্চল পাকশী৷ সে ফুলে এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতি৷ সামনে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ৷ বিষ্ময় নিয়ে শত বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশের একমাত্র বৃহত্ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রানত্ম হতে ভ্রমন পিপাসুরা ভীড় জমায় হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালনশাহ সেতু এলাকায়৷ দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালনশাহ সেতুর অপরূপ দৃশ্য এবং ইতিহাস আর কিংবদনত্মী নিয়ে পাবনার মানচিত্রে স্ব-গর্বে দাঁড়িয়ে থাকা পাকশি ভ্রমন পিপাসু মানুষেরা রূপ সৌন্দর্য অবলোকন করছেন৷ বিভাগীয় রেল শহর, জোড়া সেতু এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে পাকশিতে বহু অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে৷ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলীয় বিভাগীয় অফিস পাক্শীতে হওয়ায় এখানে দর্শনার্থীর ভিড় বরাবরই বেশি৷ লালনশাহ সেতু নির্মাণের পর এ ভিড় আরও বৃদ্ধি পায়৷ লালন শাহ সেতু নির্মাণের কারণে এখানে প্রকল্প অফিস, ফরেন কনসালটেন্স অফিস, অফিসার্স রেসিডেন্টসিয়াল এরিয়া, রেস্ট হাউজ সহ নানা রকম অবকাঠামো গড়ে ওঠে৷ যা পাক্শির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দর্শনার্থীদের চাহিদাকে বাড়িয়ে দেয়৷
অপরদিকে ১’শ ৮৮ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠা পাকশী পেপার মিলটিও এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে৷ কাঁচামালে স্বয়ং সম্পূনর্্ন দেশের বৃহত্তম এক মাত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান পাকশী পেপার মিলটি নানা কারনে আজ বন্ধ থাকলেও সেটিও পুনরায় চালুর উদ্দ্যোগ রয়েছে সরকারের৷
এছাড়াও এ পাকশীতেই বেপজা ১৯৯৮ সালে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদার খ্যাত পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে মনোরম পরিবেশে প্রায় ২৭০ একর জমি নিয়ে পদ্মা নদীর তীরবর্তী সুদ্রশ্য প্রকৃতির এই সৌন্দর্যমন্ডিত পরিবেশে ঈশ্বরদী ইপিজেড তার যাত্রা শুরু করে৷ এটিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ই জানুয়ারী ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন৷ বর্তমানে ১৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্পূন্ন চালু অবস্থায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন৷ এছাড়াও চালুর অপেক্ষায় রয়েছে আরোও ছয়টি প্রতিষ্ঠান৷
অন্যদিকে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান রুপপুরে পারমানবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নিমর্ান করার জন্য রাশিয়ান সরকারের সাথে দফায় দফায় অলোচনার এক পর্যায়ে তিনি মারা গেলে প্রকল্পটির আশা বন্ধ হয়ে যায়৷ কিন্তু বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আশার পর পুনরায় আবার এই প্রকল্পটি চালু করার উদ্যোগ নেই৷ তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্পটি চালু করার জন্য কয়েক দফা রাশিয়ান দলে সাথে আলোচনা করে সু-দীর্ঘ ৪৬ বছর পর এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় ও বাংলাদেশের একমাত্র দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন রুপপুর পারমানবিক বিদু্যত্ কেন্দ্রটি ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈশ্বরদীতে এসে লাখো মানুষের জনসমাগমের মাধ্যমে বিশ্বের ২৯তম পারমানবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র হিসেবে রুপপুর বিদ্যুত্ প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন করেন৷ ২ হাজার মেগাওয়াড ক্ষমতা সম্পন্ন এই বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি উত্পাদনে গেলে সারা বাংলাদেশের বিদ্যুত্ সমস্যার একটা আমুল পরিবর্তন হবে৷ বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বিদ্যুত্ চাহিদা রয়েছে ৭ হাজার মেগাওয়াট, যার মধ্যে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন সক্ষম৷ রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রটির উত্পাদিত ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে যোগ হলে প্রতি বছর এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উদ্বৃত্ত্বের রেকর্ড অর্জন করতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ৷ এই প্রকল্পটি উত্পাদনে গেলে লোডশেডিং থেকে জাতী মুক্তি পাবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা৷ ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে এই প্রকল্পটি সম্পূন্ন করা হবে৷ সর্বপরী পাকশী এ অঞ্চালের মানুষের কাছে আধাঁর ঘরের মানিকের মতই আলোকিত৷