বৃহস্পতিবার ● ৯ মে ২০১৯
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » পবিত্র মাহে রমজান আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস
পবিত্র মাহে রমজান আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস
নুর মোহাম্মদ রানা :: মুসলমানদের জন্য রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে ফিরে এলো পবিত্র মাহে রমজান। ইসলাম ধর্মের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হল এই রমজানের রোজা। আর তাকওয়া অর্জনের মাস রমজান। রমজানে রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্যই হলো মানুষ দুনিয়ার সব অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকবে। তাকওয়া অর্জনের প্রধান মাধ্যম রোজার বিধান পালনে মানুষ ভোর রাতে নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ম মেনে সেহেরি খায়। সারাদিন আল্লাহ বিধি-বিধান পালনার্থে পানাহার ত্যাগ করে ইবাদাত-বন্দেগিতে ব্যস্ত থাকে। সময় মতো জামাআতে নামাজ আদায় করে। আবার সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করে। রাতে নিয়ম মেনে তারাবিহ নামাজ আদায় করে। কুরআনের বিধান মানতে রমজানের এ নিয়মতান্ত্রিকতাই হলো রোজাদারের জন্য তাকওয়া অর্জনে সারা বছরের প্রশিক্ষণ কর্মশালা। মূলত ‘সিয়াম’ শব্দ এসেছে ‘সওম’ থেকে। এর অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী শরীয়তে সওম হলো- আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে নিয়তসহ সুবহে সাদিকের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, ভোগ-বিলাস ও পাপাচার থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে সিয়াম। একে ফার্সিতে বলা হয় রোজা। আত্মশুদ্ধি, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি গুণ অর্জনের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ হয় রমজানে সিয়াম পালনের মাধ্যমে। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সিয়াম সম্পর্কে বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।’ রোজা এমনই এক ইবাদত। যা দুনিয়ার সব নবি-রাসুলের ওপর ফরজ ছিল। কারণ রোজা মানুষকে তাকওয়ার শিক্ষা দেয়। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা রোজা প্রতিদান দান করবেন। রোজা মানুষের কু-রিপু ও আমিত্বকে জালিয়ে পুড়িয়ে আল্লাহ নৈকট্য অর্জনে সহায়তা করে। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা যুগ যুগ ধরে রোজা বিধান আবশ্যক করে রেখেছেন। পবিত্র রমজান কৃচ্ছ্রসাধনা, ত্যাগ, সংযম এবং পরহিতৈষণার মহান বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে হিজরি সনের নবম মাস মাহে রমজান। এ মাসকে মহান আল্লাহ তায়ালা জাল্লা শানহু সিয়াম পালনের মাস হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণ-অনুক্ষণ আল্লাহ তায়ালার খাস রহমতে পরিপূর্ণ। এ মাস এক অসাধারণ মাস। নিঃসন্দেহে এ মাস স্বতন্ত্র ও মাহাত্ম্যের দাবি রাখে। গোটা মুসলিম জাহানে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজানের কঠোর সিয়াম সাধনা শুরু হয়। দীর্ঘ এক মাসব্যাপী রমজানের কঠোর পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আল্লাহর তাকওয়া অর্জন ও এর সামগ্রিক সুফল সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে বিশ্বব্যাপী মানবতার শান্তি ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে। রমজানের রোজা সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের রিপুকে আল্লাহর তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিত করা হয়। অন্তরের পশু প্রবৃত্তিকে বশীভূত করে মানুষ সর্বোচ্চ প্রশান্ত আত্মা পর্যায়ে উপনীত হয়। প্রকৃত রোজাদার তাই এ মাসে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের পর্যায়ে উপনীত হয়। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। আর সত্যিকার সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সমাজ থেকে সব অন্যায়, অনাচার, ব্যভিচার ও সন্ত্রাস দুরীভূত হয়। গোটা ব্যক্তিজীবনে নিরাপদ ও নির্বিঘেœ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা লাভ করা যায়। ইসলাম ধর্মে প্রত্যেক সবল মুসলমানের জন্য রমজান মাসের রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। মাহে রমজানের এই পূর্ণময় সময়ে সিয়াম সাধনা বা রোজাব্রত পালন মানবজীবনকে পূতপবিত্র ও ইসলামি নীতিনৈতিকতায় গড়ে তোলার এক অপূর্ব সুযোগ। এ মাসে যারা একনিষ্ঠভাবে রোজা রেখে নিজেকে আত্মশুদ্ধির পর্যায়ে নিয়ে যায়, তার চূড়ান্ত ফল মহান প্রভু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও অপার করুণার দৃষ্টি। মানুষের আত্মশুদ্ধির একটি বলিষ্ঠ হাতিয়ার সিয়াম সাধনা করা। এ মাসের রোজা রাখার মধ্য দিয়ে একজন মুসলমান তার পাশবিক প্রবৃত্তিকে সংযত এবং নিজের আত্মিক অন্তর্গত সত্তাকে জাগ্রত ও বিকশিত করে তোলার পরিপূর্ণ সুযোগ লাভ করে। মানুষের হৃদয়ে যে পশুসুলভ ভাব রয়েছে, তা তার আত্মিক সত্তাকে জাগ্রত করতে অন্তরায়। মানুষ যখন এই দুষ্টশক্তির ওপর আত্মিক ও বিবেকের রাজত্ব সৃষ্টি করতে পারে, তখনই সে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়।
রোজা সাধনার মাধ্যমে মানুষ এক অমিয় সুধা লাভ করতে পারে। এর ফলে মানুষ জাগতিক লোভলালসা, সম্পদ, টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি অর্জনের ধ্বংসকারী ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সুযোগ লাভ করে। হৃদয়কে নির্মল বা আত্মশুদ্ধির অস্ত্রের মূল শক্তি সঞ্চারিত হয় রোজা পালনের মাধ্যমে। মানুষ কোনো মন্দ কাজ কিংবা দোষত্রুটির কর্ম সাধন করে, তখন তার হৃদয়ে কালিমা বা মরিচার জং ধরে। এই পাপের মরিচা থেকে হৃদয়কে শুদ্ধি তথা পরিষ্কার করনে একমাত্র পন্থা হলো আল্লাহকে স্মরণ করা। মানুষ যতই আল্লাহর জিকির, ইবাদত, নামাজ, রোজা পালন করবে, ততই তার হৃদয় পরিশুদ্ধ হতে থাকবে এবং সে পাপ কালিমা থেকে মুক্ত হবে।
এছাড়াও মাহে রমজান হচ্ছে, সবরের মাস। মানুষ তার কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, কর্মে ও চলাফেরা যাবতীয় পর্যায়ে সবরের মাধ্যমে রোজা সাধনার পরিপূর্ণ লাভ করে। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবর করলে সব ধরনের পাপ, পানাহার, স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকেন। এটি সমবেদনা জানানোর মাস। এই মাসে প্রত্যেক মোমিন বান্দাদের রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাস ধৈর্য ধারণের মাস। ধৈর্যের বিনিময়ে নির্ধারিত রয়েছে সুশীতল ছায়ানীড় জান্নাত। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর অসীম দয়া ক্ষমা ও পরিত্রাণ প্রাপ্তির জন্য মাসব্যাপী রোজা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যাতে আত্মসংযমের মাধ্যমে বান্দারা আত্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিশুদ্ধি অর্জন করতে পারে। প্রকৃত রোজা পালনকারীরা এই মাহে রমজান নামক রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দরিয়ায় অবগাহন করে এগারো মাসের পুঞ্জীভূত পাপ কালিমা থেকে মুক্তি ও পবিত্র হতে পারে। যারা সতর্ক ও জ্ঞানী, তারা এই সুবর্ণ সুযোগ সঠিকভাবে ব্যবহার করে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে এবং দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তাদের নিরাশ করেন না। রোজা পালনকারী সব ধরনের গোনাহের কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে মহান আল্লাহর নির্দেশে নবীর প্রদর্শিত পথে চলার এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে থাকে। পবিত্র মাহে রমজানুল মোবারক রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস। যা কিছু কল্যাণকর তার সঙ্গে এই মাসের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এ মাসে নাযিল হয়েছে পবিত্র আল-কোরআন। যা মানবজাতির জন্য পথ প্রদর্শক। অপরাধমুক্ত, সুশৃঙ্খল ও সুন্দর জীবন-যাপন এবং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে কোরআন নাযিলের এই মাস রমজানে কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মানব জীবনকে সুন্দর পরিপাটি ও শান্তিময় করার দিকনির্দেশনা জানার পাশাপাশি কোরআনের সকল করণীয় বিধিবিধান মানতে হবে। এই পবিত্র রমজান মাস আমাদের কাছে মহান আত্মশুদ্ধির মাস। এই মাসেই সংযত ও নিষ্ঠাবান হওয়ার যে শিক্ষা রয়েছে, আমরা যেন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমল করতে পারি। তাই পবিত্র এই মাসে মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্যলাভে আমরা সবাই সচেষ্ট হব, আত্মশুদ্ধি অর্জন করব। লেখক : প্রবন্ধিক ও সাংবাদিক।