বৃহস্পতিবার ● ২০ জুন ২০১৯
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » ইভিএম ভোটিং ও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ
ইভিএম ভোটিং ও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ
এম. সাখাওয়াত :: ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) যার অপর নাম ই-ভোটিং পদ্ধতি। ভোট গ্রহণে ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় বলে এটির সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বলে। ইভিএম এ ভোট দিতে ভোটারকে প্রথমে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও পোলিং এজেন্টদের সামনে রাখা ইভিএম যন্ত্র সমুহের কন্ট্রোল ইউনিটে আঙ্গুলের ছাপ/ভোটার নম্বর/এইডি নম্বর/স্মার্ট নম্বর এর মাধ্যমে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। অত:পর গোপনকক্ষে ব্যালট ইউনিট নামক যন্ত্রে বোতাম চাপলেই পছন্দের প্রার্থী/প্রতিকে ভোট সম্পন্ন হয়ে যাবে। বর্তমানে সনাতন পদ্ধতিতে কাগজের ব্যালট নিয়ে গোপন কক্ষে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে সিল মেরে ভোট দেয়া হয়। একই উদ্দেশ্যে মেশিনে বোতাম চেপে ভোট দেয়ার নাম হলো ইভিএম পদ্ধতি। যা সনাতন ভোট প্রদান পদ্ধতির সহজ আধূনিকরুপ। বিশ্বায়নের এ যুগে তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাবে গতিশীল হবে মানুষের চিন্তা চেতনা এটিই স্বাভাবিক কথা। কিন্ত প্রযুক্তি সম্পর্কে অজানা এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে ভুল ধারণা অথবা প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে অনেক সময় এর উল্টো ঘটে। তাই মেশিনটি প্রস্তত করা হয়েছে কিভাবে অথবা আমাদের দেশের ভোটারদের একাংশ যারা মনে করেন এতে সহজে ভোট দিতে পারবেন কি-না অথবা এক প্রতীকে ভোট দিলে অন্য প্রতীকে জমা হবে কি-না অথবা সমগ্র ফলাফল পাল্টে দেয়া যায় কি-না এরূপ কৌতুহল সমাজে বিদ্যমান। দেশের সমাজপতি ও রাজনীতিবিদগণের অধিকাংশ মনে করেন ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের ধারণা পরিস্কার হওয়ার পরই তা বাস্তবায়ন করা দরকার। অন্যদিকে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো যখন মঙ্গলগ্রহে বসাবসের চিন্তা করছে বাংলাদেশও তখন পিছিয়ে নেই। প্রযুক্তি বিশ্বে পাল্লা দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন থেকেক শুরু করে বিশ্বে প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তাছাড়া ভোট গ্রহণ পদ্ধতিতে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম স্থান অর্জন করেছে। মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ফেমবোসা (ফোরাম অব ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বডিজ অব সাউথ এশিয়া) এর চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেকাংশ বেড়ে গেছে। যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট প্রদান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে তাই যন্ত্রটির প্রস্তুত প্রণালী এবং কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে তুলে ধরা হলো। ইভিএম এর তিনটি ভাগ রয়েছে ১. কন্ট্রোল ইউনিট ২. ব্যালট ইউনিট ৩. মনিটর বা ডিসপ্লে ইউনিট। যন্ত্রটির মুল অংশ হলো কন্ট্রোল ইউনিট এটি সফ্টওয়ার এবং হার্ডওয়ার এর সমন্বয়ে গঠিত। কন্ট্রোল ইউনিটে পোলিং কার্ড এবং অডিট (স্মার্ট) কার্ড ছাড়াও একটি মেমোরি কার্ড ব্যবহার করা হয়। অডিট (স্মার্ট) কার্ডটিতে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের আঙ্গুলের ছাপ এবং পাসওয়ার্ড থাকবে। পোলিং কার্ডে ভোটারদের ভোট জমা হবে। এসডি কার্ড বা মেমোরি কার্ডে ভোটকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের বায়োমেট্রিকসহ সকল পরিচিতি সংরক্ষিত থাকবে। একজন ভোটার প্রথমে পোলিং অফিসারের নিকট গিয়ে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করবে অতঃপর সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের নিকট রাখা কন্ট্রোল ইউনিটে নিজের আঙ্গুলের ছাপ অথবা ভোটার নম্বর অথবা স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা পেপার লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিবেন। এতে করে ভোটার নিজের ছবি ও পরিচয় মনিটরে দেখে নিশ্চিত হবেন। অতঃপর ভোটার গোপনকক্ষে গিয়ে ব্যালট ইউনিটে যে প্রতীকে ভোট দিতে চান তার বাম পাশের কালো বোতাম চাপার মাধ্যমে তার পাশে থাকা বাতি জলে উঠবে। তারপর সবুজ বোতামে চাপ দিলেই ভোট নিশ্চিত হবে। ব্যালট ইউনিটে ভোটার কর্তৃক চিহ্নিত প্রতীকের পাশের বোতামে চাপ দেয়ার কারণে তার পছন্দের প্রতীক ব্যতিত সকল প্রতীক মুছে যাবে। ভোটার ভুল করে তার পছন্দের প্রতীক ব্যতিত অন্যটিতে চাপ দিলে সবুজ বাটন চাপার আগে লাল বাটন চেপে বাতিল করে পুণরায় পছন্দের প্রতীকে চাপ দিলেই ভোট নিশ্চিত হয়ে যাবে। তাই আধুনিক প্রযুক্তি সমন্বিত এই ইভিএম ব্যবহারে কি কি সুবিধা রয়েছে তা তুলে ধরা প্রয়োজন। ১. ইভিএম এর একটি ব্যালট ইউনিটে ৪০০০ জন ভোটার ভোট দিতে পারবেন। ২. শুধু বাটন চাপ দিলেই যেহেতু ভোট দেওয়া যায় তাই অক্ষর জ্ঞানহীন ভোটারগণও সহজে ভোট দিতে পারবেন। ৩. বাইওমেট্রিক পদ্ধতি থাকায় একজনের ভোট অন্যজন দেয়ার সুযোগ নাই ৪. মেশিনটিতে একটি পূর্ব প্রোগ্রামিং করা মাইক্রো চিপ থাকে যা প্রতিটি ভোটের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে প্রদর্শন করে ৫. ইভিএম ব্যবহারে কোটি কোটি সংখ্যক ব্যালট ছাপানোর জন্য কাগজের খরচ পরিবহনের খরচ, লোকবলের খরচ কমে যাবে ৬. একই মেশিনের শুধু প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে অন্য নির্বাচনেও ব্যবহার করা সম্ভব। ৭.এই প্রক্রিয়ায় কোন ভোট বাতিল হবে না। ৮. ভোটারের তথ্য প্রায় দশ বছর পর্যন্ত এ মেশিনে অবিক্রিত অবস্থায় সংরক্ষণ থাকবে। মেশিনটি ব্যাটারী চালিত তাই ইলেকট্রিক সক খাওয়ার সম্ভাবনা নাই। ৯. একজন ভোটারের ভোট দেওয়ার পর ১ থেকে ১২ সেকেন্ড পর্যন্ত ব্যালট ইউনিট সয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর থাকে ফলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ইচ্ছে করলেও একজন ভোটারকে একাধিক ভোট প্রদানের সুযোগ দিতে পারবেন না। ১০. কোন কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের ক্লোজ বাটনে চাপ দিলেই দখলকারীরা আর কোন ভোট দিতে পারবে না। তাছাড়া অডিট (স্মার্ট) কার্ড সরিয়ে ফেললেই মেশিনটি চালু করা যাবে না। ১১. ভোটার ইচ্ছা করে একাধিক ভোট দিতে চাইলেও ১ম বারের পর যতবারই বাটন চাপুন না কেন তা মেশিন গ্রহণ করবে না। ১২. ভোট গ্রহণ কার্যক্রম এর শুরতেই মেশিনটিতে কোনরূপ ভোট দিয়ে রাখা হয়নি মর্মে পোলিং এজেন্টদের ফলাফল সিট প্রিন্ট করে দেখানো হবে। ১৩. ভোট প্রদানের শুরতে এজেন্টদেরকে পরীক্ষামূলক ভোট প্রদান পদ্ধতি দেখানোর পরে মেমোরি ক্লিয়ার বাটন চেপে মেমোরিতে থাকা সকল অস্থায়ী তথ্যদি মুছে ফেলা হবে। ১৪. কোন আসনে ১২ এর অধিক প্রার্থী হলে অতিরিক্ত ব্যালট ইউনিট যোগ করা যাবে এভাবে ষাটটি প্রতীক পর্যন্ত সংযোগ করা সম্ভব। ১৫. একজন ভোটারের ভোট দিতে সর্বোচ্চ ১৪ সেকেন্ড সময় লাগতে পারে বিধায় ভোটারদের দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে না।
বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশের ৩০০টি আসনের মধ্যে ঢাকা-০৬ এবং ১৩, চট্টগ্রাম-০৯, রংপুর-০৩, খুলনা-০২, সাতক্ষীরা-০২ আসনের ১৪৪ টি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বর্তমান মাননীয় নির্বাচন কমিশন এবং সচিব মহোদয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় পর্যায়ের প্রতিটি সদর উপজেলা এবং গত ০৫ আগস্ট২০১৯অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১২৭টি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করে একটি সফল নির্বাচন করা হয়েছে । ২০২০ সালে আসন্ন সকল পৌরসভা নির্বাচনে ইভিএম এর মাধ্যমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে মর্মে নির্বাচন কমিশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন। ২৪ জুন ২০১৯ তারিখে বগুড়া ০৬ আসনে জাতীয় সংসদ উপ-নির্বাচনে ১৪১ টি ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন ইভিএম ব্যবহার এর মাধ্যমে হবে জেনে ভোটারদের মাঝে ব্যাপক কৌতুহল সৃস্টি হয়েছে । প্রতিবেশী রাষ্ট ভারতে ১১ হতে ২৩ মে২০১৯ পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনে ইভিএম যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। যন্ত্র ভুলের উর্দ্ধে নয়। তবে সেই ভুলগুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধন করার মাধমে ইভিএম এর গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পাবে। যা ডিজিটাল বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আর একধাপ এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ডিজিটাল বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সারা বিশ্বে যেমন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে তেমনিভাবে ইভিএম এর মাধমেও তা অর্জন করা সম্ভব। তবে ব্যাপক প্রচার এবং এটি পরিচালনাকারীর প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে সমন্বয় করা আবশ্যক। অন্যথায় নির্বাচন কমিশন কাংক্ষিত লক্ষ অর্জন করতে ব্যর্থ হলে দেশ বিশ্বের মাঝে আর্থিকভাবে ও প্রযুক্তিগত যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং ইমেজ সংকটেও পড়তে পারে। তাই দেশকে এগিয়ে নিতে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সেই সাথে সমগ্র জাতি প্রযুক্তি বিদ্যার সত্যতার চ্যালেঞ্জকে বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে নিতে চায়। তাই প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম যিনি পরিচালনা করবেন তার স্বচ্ছতার মাধ্যমে যেন প্রতিফলিত হয় সমন্বিত প্রচেষ্টার কাঙ্খিত সফলতা এটিই ভোটারদের চাওয়া পাওয়ার আকাংখার কেন্দ্রবিন্দ।
লেখকঃ এম. সাখাওয়াত, প্রাবন্ধিক ও সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব।