সোমবার ● ২৪ জুন ২০১৯
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » একজন দন্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামী হয়ে কি ভাবে জমি রেজিষ্ট্রি করে ?
একজন দন্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামী হয়ে কি ভাবে জমি রেজিষ্ট্রি করে ?
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :: ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বহুল আলোচিত হুন্ডি কাজল ১৪ বছরের সাজায় দীর্ঘ দিন ফেরারী হয়েও অবৈধ উপায়ে নিজ নামিয় জমি রেজিষ্ট্রীর মাধ্যমে বিক্রি করে বিক্রিত অর্থ ভারতে পাচার করছেন বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে তিনি ভারতে আলিশান বাড়ী তৈরী করে বসবাস এবং সেখানে ব্যবসা করছেন। কোটচাঁদপুর পৌর শহরের সলেমানপুর গ্রামের শওকত আলীর (পঁচা মিয়া) ছেলে ফারুক আহমেদ ওরফে হুন্ডি কাজল ও তার অর্শিবাদ পুষ্ঠ এজেণ্টরা ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা কোটচাঁদপুরসহ দক্ষিণ পঞ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় অন্তত ৮টি মামলায় ১৪ বছরের দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন হুন্ডি কাজল। এসব অর্থে তার পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা সম্পদ ইতি মধ্যেই বিক্রি করে অর্ধশত কোটি টাকা ভারতে ইতি মধ্যেই পাচার করেছেন। কিছু দিন ঘাপটি মেরে থেকে চুপি সারে গত ১৭/০১/১৯ তারিখে দুটি দলিলের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে সাত বিঘা নিজ নামিয় জমি বিক্রি করে দেন। তার বলাবাড়িয়া ইটভাটার এ জমি ৫০ লক্ষ টাকায় বিক্রি করলেও দলিলে দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ১৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যার দলিল নং- ১৫৯, গ্রহিতা হচ্ছেন-পরশ মনি গার্মেণ্টস এর মালিক মিজানুর রহমান ও তার স্ত্রী তাছলিমা আজাদ, জামির পরিমাণ ৪১ শতক এখানে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। অপর দলিল নং-১৬০, গ্রহিতা কোটচাঁদপুর এলাঙ্গী ইউপি চেয়ারম্যান মিজানূর রহমান খান ও তার স্ত্রী মেহরিন আক্তার, জমির পরিমান ১শ’ ৯৯ শতক ৫০ পয়েণ্ট। জমির মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। চুপি সারে জমি বিক্রয়ের বিষয়টি মাত্র কয়েকদিন আগে চাউর হয়ে পড়লে এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। একজন দন্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামী হয়ে কি ভাবে জমি রেজিষ্ট্রি করে তা নিয়ে এলাকার মহল্লায় মহল্লায় চায়ের দোকান, রে¯ঁÍরা ও হোটেল গুলিতে পুলিশ প্রশাসনসহ সাবরেজিট্রারের ভুমিকা নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। বিষয়টি নিয়ে সাবরেজিষ্ট্রার অঞ্জনা রানী এ প্রতিবেদককে বলেন-আদালত থেকে যেহেতু এ ধরণের আসামীর জমি বিক্রির বিষয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা আমাদেরকে দেয়া হয়নি সেহেতু আমি কোন কিছুই খতিয়ে দেখি নাই, তাছাড়া তাকে আমি চিনিনা। তিনি বলেন, ফারুক আহমেদ কাজল প্রকাশ্যে রেজিষ্ট্রীর দিনে আমার দপ্তরে এসে সনাক্তকারীর মাধ্যমে তিনি জমি রেজিষ্ট্রী করে গেছেন। এব্যাপারে কোটচাঁদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী কামাল হোসেন বলেন-কাজল কোটচাঁদপুরে জমি রেজিষ্ট্রি করতে এসে ছিলো এ ধরনের তথ্য আমার জানা নেই। আর জমি রেজিষ্ট্রি’র বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। তবে যেহেতু সাবরেজিষ্ট্রার একজন দায়িত্বশীল ব্যাক্তি সেহেতু এ ধরনের একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামীর বিষয়ে আমাদেরকে জানানো উচিৎ ছিলো। জমি ক্রেতারা অত্যান্ত প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে সাধারাণ মানুষ সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেনা। তাদের ধরণা পত্রিকায় নাম আসলে তাদের উপর নির্যাতনের খড়ক নেমে আসতে পারে! যে কারণে অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন-পুলিশ প্রশাসন ও সাবরেজিষ্ট্রারকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে জমি রেজিষ্ট্রী করা হয়েছে। অপর দিকে রেজিষ্ট্রী অফিস সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হুন্ডি কাজল রেজিষ্ট্রী আফিসে এসেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। তাদের সাফ কথা বিষয়টি সাবরেজিষ্টার স্যার ভাল জানেন। তবে রেজিষ্ট্রী অফিসের একটি সূত্র জানায় , হুন্ডি কাজল কোটচাঁদপুরে আসেনি। আগে থেকে রেজিষ্ট্রী অফিসের দূর্নীতিবাজ দলিল লেখক বদর উদ্দীনের মাধ্যমে দলিল তৈরী করে সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর থানার গয়েশপুর গ্রামের হুন্ডি কাজলের এক আত্মীয় বাড়ী থেকে দলিলে হুন্ডি কাজলের সহি করে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে সাবরেজিষ্টার ওই দলিল রেজিষ্ট্রী করতে অসম্মতি জানালে তাকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। ফলে তিনি রেজিষ্ট্রী করে দিতে বাধ্য হন। ওই সূত্রের দাবী বিষয়টি তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য উন্মচিত হবে। এ অঞ্চলের অগনিত মানুষের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হলে তাদেরও একই ধারণা হুন্ডি কাজল কখনোই কোটচাঁদপুরে এসে জমি রেজিষ্ট্রী করার সহস করবেনা। তা ছাড়া অফিস চলাকালে সময়ে শত শত মানুষ ওখানে উপস্থিত থাকে। সেখানে হুন্ডি কাজল এসে জমি রেজিষ্ট্রি করবে এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। বিষয়টি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শরিফুন্নেছা মিকি বলেন-হুন্ডি কাজল কোটচাঁদপুরে এসেছিল বলে আমার জানা নেই। এ ধরণের দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোটচাঁদপুরে এসে জমি রেজিষ্ট্রি করবে আমার ধারণার বাইরে। বলতে গেলে আমি ধুয়াসার মধ্যে আছি। বিষয়টি নিয়ে কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র জাহিদুল ইসলাম বলেন, হাজার হাজার মানুষের সাথে এমন প্রতারণার হুন্ডি কাজল ও তার এজেণ্টদের বিচার হওয়া উচিৎ। আমি আশাবাদী দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার অচিরেই তা করবেন। এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মোঃ হাসানুজ্জামান গনমাধ্যম কর্মীদের জানান, হুন্ডি কাজল সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী। এ অবস্থায় তিনি তার কোন সম্পদ বিক্রি করতে পারেন না। যদি করেনও তবে তা হবে অবৈধ ও দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিষ্ট্রার দায়ী থাকবেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেও অভিযোগ দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করবেন।
উল্লেখ্য, হুন্ডি কেন্দ্রিক সমস্যা দীর্ঘ ১৯টি বছর ঝুলে আছে। এ সমাধানে সাবেক স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের দিয়ে যাওয়া কথা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ১৯ বছর ধরে হুন্ডির ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। হুন্ডি কাজলের বর্তমান কোটিপতি হুন্ডি এজেণ্টদের এমন এক সময় ছিলো এরা কেউ কেউ পরের দোকানে কাজ করতো, কেউ কেউ চোরাচালানীর মালামাল ভারত থেকে আনা নেওয়ার জন্য কামলা খাটতো, কেউ দিন মুজুরের কাজ করতো তারা আজ সাধারণ মানুষের টাকা লুটে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছে। অথচ কাজল ও তার এজেন্ডদের কারণে হুন্ডিতে লগ্নি করে কোটচাঁদপুরসহ কমপক্ষে ২০ জেলার হাজার হাজার মানুষ আজ পথে বসেছে। কেউ চাকুরীর পেনশনের টাকা লগ্নি করে কামলা খাটছে, কেউ সম্পদ বিক্রি করে, কেউ ব্যবসার টাকা লগ্লিকরে সব খুঁইয়ে নিঃস্ব হয়ে আজ দিন মুজুরের কাজ করছে। অনেক মেয়ে তালাক প্রাপ্ত হয়েছে। এরই মধ্যে অনেকে অভাবের তাড়নায় আতœহননের পথ বেঁছে নিয়েছে। এমনকি হুন্ডি কেন্দ্রিক হত্যার ঘটনাও ঘটেছে একাধিক। হুন্ডি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কোটচাঁদপুর শহরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ী ঘর ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনার পাশাপাশি ৩ থেকে ৪ দিন ধরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। হরতাল চলেছে বেশ কয়েক দিন। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের আলোচিত হুন্ডি প্রধান ফারুক আহমেদ কাজল ও তার প্রায় দুই শতাধিক নিয়োগকৃত এজেন্ডদের নিয়ে গঠন করা হুন্ডি ব্যবসা শুরু হয় ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে। লগ্নিকারীদের ১লাখে ১০হাজার টাকা লাভ দেয়া হত। ১৯৯৯ সালের প্রথম থেকে ১লাখে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষনা দেয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পঙ্গু পালের মত মানুষ ছুটে আসে কোটচাঁদপুরে হুন্ডি এজেন্টদের মাধ্যমে কাজলের হুন্ডি ব্যাংকে টাকা লগ্নি করতে। এ ভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ২০০০ সালের প্রথম দিকে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। টাকা হারিয়ে লগ্নিকারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ সুযোগে সুযোগ সন্ধানি কিছু ব্যাক্তি শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ী ঘরে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। বিষয়টি নিয়ে হাজার হাজার লগ্নিকারীরা কোটচাঁদপুরে আন্দোলনে নেমে আসে। টাকা উদ্ধারের দাবিতে চলে একের পর এক হরতাল অবরোধের মত কর্মসূচি। এমন ঘটনায় দেশব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ওই সময় ছুটে আসেন কোটচাঁদপুরে স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি কথা দিয়ে যান লগ্নিকারীদের টাকা ফেরত দেওয়াসহ হুন্ডি কাজল ও তার এজেন্টদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। কিন্তু তার পরও তিন তিন বার আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলেও লগ্নিকারীদের কোন কাজে আসেনি। এলাকার স্বচেতন মহল মনে করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপই পারে হাজার হাজার অসহায় মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাসহ এ সমস্যার সমাধান দিতে।