বৃহস্পতিবার ● ১১ জুলাই ২০১৯
প্রথম পাতা » জাতীয় » গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি
গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি
পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: আধুনিকতার দাপটে হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার এক সময়ের কৃষাণ কৃষাণিদের ভালো মানের চাল তৈরির প্রধান মাধ্যম ঢেঁকি। গ্রামেগঞ্জে এখন পুরোপুরি লেগেছে আধুনিকতার ঢেউ । কালের বিবর্তনে পুরোপুরি হারিয়ে গেল ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ। গ্রামেগঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় এক সময় ঢেঁকি দিয়ে চাল তৈরি, চিড়া ভাঙা, আটা, পায়েসের চালের গুঁড়ো, খির তৈরির চাল বানানোর সেই ঢেঁকি- আজ হার মেনেছে ইঞ্জিনচালিত মেশিনের কাছে। ধান ভানা, চাল গুঁড়ো করা, বড়ি তৈরি করা, আটা তৈরি চালের গুঁড়াসহ ঢেঁকির যাবতীয় কাজ এখন করছে ইঞ্জিনচালিত মেশিনে।
ঢেঁকি নিয়ে এক সময় জনপ্রিয় গান রচিত হয়েছিল। যেমন গ্রাম বাংলার তরুণী-নববধূ কণ্ঠে শোনাযেত ‘ও বউ চাল ভাঙেরে, ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, নতুন চাল ভাঙে হেলিয়া দুলিয়া, ও বউ চাল ভাঙেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া’ এবং ‘ও ধান বানিরে ঢেঁকিতে পা দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া, ও ধান বানিরে ঢেঁকিতে পা দিয়া’ এ রকম গান আর শোনা যায় না।
ঐতিহ্যবাহী সেই ঢেঁকি পটুয়াখালী জেলা থেকে এখন হারিয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে ঢেঁকি এখন যেন শুধু ঐতিহ্যের স্মৃতি।গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখন আর আগের মত চোখে পড়ে না। এক সময় ঢেঁকি ছিল এ জেলার গ্রাম অঞ্চলের জনপদে চাল ও চালের গুঁড়া তৈরির একমাত্র মাধ্যম। বধূরা ঢেঁকিতে চাল ভাঙতো গভীর রাত থেকে ভোর সকাল পর্যন্ত। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার ঢেঁকি হারিয়ে গেছে, এখন ঢেঁকির সেই ধুপধাপ শব্দ আর শোনা যায় না। আগে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে কৃষক ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে গৃহস্থ ও কৃষাণিদের ঘরে ঘরে ধানের নতুন চাল ভাঙা বা চাল গুঁড়া করা, আর সে চাল দিয়ে পিঠা, পুলি, ফিরনি, পায়েস তৈরি করার ধুম পড়ে যেত। বাতাসে ভেসে বেড়াত পিঠার সুঘ্রাণ। এখন ঢেঁকির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে নবান্নের উৎসবও।
এ যুগের ছেলে মেয়েদের ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে ও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে ঢেঁকি শিল্প কি ছিল। সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আবির্ভাব হয়েছিল, আবার গতিময় সভ্যতার সারাপথে প্রযুক্তি গত কারণে টেঁকি বিলুপ্তি হয়েছে। টেঁকি কাঠের তৈরি কুল, বাবলা, জামগাছ ইত্যাদি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো। সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাত দৈর্ঘ্য। আর পৌনে ১ হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগে সরু। এর মাথায় এক হাত কাঠের ওচা বা দস্তা থাকে। এর মাথায় লাগানো থাকে লোহার গুলা। গুলার মুখ যে নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে সে স্থানকে গড় বলে। ধান বানতে ন্যূনতম ২ জন লোকের প্রয়োজন সে সময়ে কবি সাহিত্যিকরা ঢেঁকি কে নিয়ে অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। আর ঢেঁকি ছাঁটা আউশ চালের পান্তা ভাত পুষ্টিমান ও খেতে খুব স্বাদ লাগত। বর্তমান প্রজন্ম সে স্বাদ থেকে বঞ্চিত। প্রাচীনকালে ঢেঁকির ব্যবহার বেশি হলেও বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে গ্রাম বাংলার ঢেঁকি আজ বিলুপ্তি হয়েছে।
কিন্তু এক সময় গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি কৃষক পরিবারেই ঢেঁকি ছিল। পরিবারের কৃষাণীরা সে সময় দৈনন্দিন ধান, গম ও জব ভাঙার কাজ ঢেঁকিতেই করতেন। পাশাপাশি চিড়া তৈরির মত কঠিন কাজও ওই ঢেঁকিতেই করা হতো। বিশেষ করে সবে বরাত, ঈদ, পূজা, নবান্ন উৎসব এবং পৌষ পার্বণসহ বিশেষ বিশেষ দিনে পিঠা-পুলি খাওয়ার জন্য অধিকাংশ বাড়িতেই ঢেঁকিতে চালের আটা তৈরি করা হতো।সে সময় গ্রামের বধূদের ধান ভাঙানোর গান আর ঢেঁকির ছন্দময় শব্দে সত্যই চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে যেত। তাছাড়া ওই সময় এলাকার বড় বড় কৃষকরা আশপাশের দরিদ্র নারীদের টাকা বা ধান দিয়ে ঢেঁকিতে চাল ও আটা ভাঙিয়ে নিতো। অনেক দরিদ্র পরিবার আবার ঢেঁকিতে চাল ভাঙিয়ে হাট-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সে সময় ঢেঁকিতে ভাঙা পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু চালের বেশ কদর ছিল। কিন্তু আধুনিকতা আর বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন ধান-গম ভাঙা যন্ত্র আবিষ্কারের কারণে গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে গেছে ঢেঁকি ।
এক বৃদ্ধ মহিলা বলেন, আগে মোরা ধান ঢেহিতে (ঢেঁকিতে) পাড় দিয়ে চাউলের গুঁড়িদিয়া পিটা-পুলি-সহ নানানতা বানাইয়া পোলা মাইয়া, স্বামী, লইয়া আত্মীয় স্বজনেরে দাওয়াত দিয়া খাওয়াইতাম। তবে ঢেহি (ঢেঁকি) মোগো একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। কিন্তু সবাই সুক বিচরায়। এহন আবার নতুন নতুন মিশিং(মেশিন) বাইরাইছে সবাই হেইতে চাউল গুড়ি হরে। ঢেহি (ঢেঁকি) আর কেউ কামে লাগায় না। ঐতো দেকলেনই মোগোডা ঐহানে পোইরা রইছে।এই ভাবেই আরাইয়া গেছে ঢেহি(ঢেঁকি)।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী সিকদার বলেন, ঢেঁকি কে নিয়ে বহু গান আমাদের এলাকার মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি। আমাদের মা-চাচিদের ঢেঁকিতে ধান ভাঙতে দেখেছি। কিন্তু ঢেঁকি এখন কোথাও নেই। তাছাড়া সরকারিভাবেও ঢেঁকি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেই।ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প রক্ষায় সকলকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি।