রবিবার ● ১৭ জানুয়ারী ২০১৬
প্রথম পাতা » পাবনা » সংকুচিত হচ্ছে চলনবিলের ভৌগোলিক অবস্থান
সংকুচিত হচ্ছে চলনবিলের ভৌগোলিক অবস্থান
লিপন সরকার, চলনবিল প্রতিনিধি :: ” বাংলার মুখ আমি দেখিয়েছি , তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না ” কবি জীবনানন্দ দাসে’র সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই ” চলনবিলের মুখ আমি দেখিয়েছি , তাই আমি বিশ্বের কোন বিলের সৌন্দয্যয়ে মুগ্ধ নই “কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো যে, দিনের পর দিন সংকুচিত হচ্ছে চলনবিলের ভৌগোলিক অবস্থান ! মানুষের মৌলিক চাহিদা তার সাথে কিছুটা বিলাসিতা,আবার গ্রাম উন্নয়নের নামে রাস্তা ঘাট তৈরীর মাধ্যমে বেমালুম দখল হচ্ছে চলনবিলের নিজস্ব সম্পত্তি৷ নিজের সম্পত্তির পরিধি হারিয়ে দিন দিন বিবস্ত্র-নগ্ন হয়ে পড়ছে চলনবিলের রূপ লাবণ্য৷ আমরা যদি সেই চলনবিলের ঐতিহ্যবাহী সৌন্দয্যয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একটু স্মরণ করি,তাহলে দেখতে পাবো যে, সেই চলনবিলের বুক ভরা অবারিত নকসি কাথার মত মাঠ নেই, সবুজের সমারোহ প্রায় মৃত৷ ঋতু বৈচিত্রের লীলা কীর্তনের ধ্বনি আর কানে বাজে না৷ মাঠের প্রান্তে দীর্ঘ রেখার মতো গ্রামগুলোকে অবারিত জল দানে ধন্য করতো চলনবিল৷ তার বুক পাঁজরে জন্মানো রক্তিমা শাপলা-শালুক তুলতে ভীড় করতো দুষ্ট মুখের দল৷ নয়টি বহমান নদীর ধারায় স্নাত সিক্ত হতো চলনবিলের উত্তপ্ত প্রাণ৷ বর্ষা মৌসুমে চলনবিলের নদীর উন্মাদ স্রোতে ভেসে বেড়াাতো পাল তোলা নৌকা , বরজা নৌকা৷ শারদ পূর্ণিমায় বিলের বুকে ঢেউয়ের মাথায় খেলা করতো রুপালী চাঁদ৷ মাঝির কন্ঠে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালীর দরাজ সূর ভেসে বেড়াতো বিশাল বিলের আনাচে কানাচে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেন উন্মাদনায় দুলতো বিলের সৌন্দর্য৷ চলনবিলের জন্মানো ঝাঁকড়া সাদা চুলের কাশবন সন্ন্যাসীর মতো মাথা দোলাতো৷ এগুলো এখন অনেকটাই স্মৃতির ধূসর গোধূলি৷ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে চলনবিলের সৌন্দর্য এবং সংকুচিত হচ্ছে চলনবিলের ভৌগোলিক রূপ নিশানা৷ বেশ কিছু কারণ এখানে উল্লেখ্য৷ চলনবিলের বুক ক্ষত বিক্ষত করে হৃদ পিন্ড দখল করে নিয়েছে হাটিকুমরুল - বনপাড়া মহা সড়কক৷ যদিও এ সড়কে বিলবাসীর জীবন জীবিকার মান উন্নয়ন হয়েছ৷ তার চেয়ে বেশি ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে বিলের সৌন্দয্য৷ আমার মনে হয়, রক্তাক্ত ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে চলনবিলের গৌরবময় ঐতিহ্য৷ দীর্ঘদিনের সংস্কারের অভাবে এবং অনাগত পলি ও নাব্যতা জমে বিলের নদ-নদীগুলির প্রবাহপথ পরিবর্তন হয়ে মারা গেছে৷ সারা বছর পানি ধরে রাখতে না পেরে বিলুপ্তি হতে চলেছে বিলের জীববৈচিত্র৷তাই অতিথি পাখির কলরবে মুখরিত হয় না বিলের প্রাণবন্ত হৃদয়৷
ক্রমাগত জন মানুষের আধিক্যের কারণে বিলের অধিকাংশ সম্পত্তি দখল হয়ে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি৷ রাস্তা ঘাটের উন্নয়নের নামে চলছে বিলের সম্পত্তি দখল৷ নাটোর জেলার অনেক সম্পত্তি বেহাত করে নিয়েছে সর্বদা সরকার দলীয় ভূমিদস্যুরা৷ আমরা জানি, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে প্রায় ৩৬৮ বর্গ কি.মি. এলাকা জুড়ে চলনবিল অবস্থিত৷ চলন বিল সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ ও পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলা দুটির অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিসত্মৃত৷ এছাড়া সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ থানার তিন চতুর্থাংশই এ বিলের মধ্যে অবস্থিত৷ বিলটির দক্ষিণ-পূর্ব প্রানত্ম পাবনা জেলার নুননগরের কাছে অষ্টমনীষা পর্যনত্ম বিসত্মত৷ এ জেলায় চলনবিলের উত্তর সীমানা হচ্ছে সিংড়ার পূর্ব প্রানত্ম থেকে ভদাই নদী পর্যনত্ম টানা রেখাটি যা নাটোর, পাবনা ও বগুড়া জেলার মধ্যবর্তী সীমানা নির্দেশ করে৷ ভদাই নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত তাড়াশ উপজেলা ও পাবনা জেলা বরাবর উত্তর-দক্ষিণমূখী একটি রেখা টানলে তা হবে বিলটির মোটামুটি পূর্ব সীমানা৷ বিলটির প্রশসত্মতম অংশ উত্তর-পূর্ব কোণে তাড়াশ থেকে গুমনী নদীর উত্তর পাড়ের নারায়ণপূর পর্যনত্ম প্রায় ১৩ কি.মি. বিসত্মৃত৷ সিংড়া থেকে গুমনী পাড়ের কাছিকাটা পর্যনত্ম অংশে এটির দৈঘর্্য সবচেয়ে বেশি, ২৪ কি.মি.৷ ব্রহ্মপুত্র নদ যখন তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনায় রূপ নেয়,সে সময়েই চলন বিলের সৃষ্টি৷ করতোয়া ও আত্রাই নদীর পরিত্যাক্ত গতিপথ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে একটি ব্যাপক বিসত্মৃত হ্রদে পরিণত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি সম্ভবত একটি পশ্চাত্জলাভূমি ছিল৷ চলনবিলের গঠন ঐতিহাসিকভাবেই আত্রাই ও বড়াল নদীর সংকোচনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷ আত্রাই নদী ছিল চলনবিলের প্রধান যোগানদাকারী প্রণালী যা রাজশাহী জেলার উত্তরাংশ ও দিনাজপুর এলাকার জল নিস্কাশন করত৷ বড়াল নদী চলনবিল থেকে জল নির্গমন পথ হিসেবে কাজ করে এবং বিলের পানি বহন করে যমুনা নদীতে ফেলে৷ গঠিত হওয়ার সময় চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১,০৮৮ বর্গ কি.মি.৷ প্রতি বছর গঙ্গা থেকে পলি এসে পড়ার দরুন বিগত দেড়শ বছরে বিলটি দক্ষিণ দিক থেকে অন্ততপক্ষে ১৯.৩২ কি.মি. সরে এসেছে৷ বিলটিতে প্রবাহদানকারী নদীগুলি, যথা গুড়, বড়াল ইত্যাদি এটির আয়তন সংকোচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে৷ বিলটির পানি নিষ্কাশন প্রণালী এবং পলি সঞ্চালের বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখার জন্য গণপূর্ত বিভাগ ১৯০৯ সালে একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে যে, চলনবিল তার পূর্বেকার আয়তন ১,০৮৫ বর্গ কি.মি. থেকে সংকুচিত হয়ে ৩৬৮ বর্গ কি.মি. এ দাড়িয়েছে৷ বিলের সার্বিক উন্নযনের জন্য ঐকান্তিক নিষ্ঠা, নিস্বার্থ সেবা ও অকৃত্রিম কর্মদক্ষতা দরকার ৷
আপলোড : ১৭ জানুয়ারী ২০১৬ : বাংলাদেশ : সময় : বেলা ৩.২০ মিঃ