মঙ্গলবার ● ১৫ অক্টোবর ২০১৯
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » শৈলকুপা ইউএনও’র বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগে গৃহনির্মাণ কাজ বন্ধ
শৈলকুপা ইউএনও’র বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগে গৃহনির্মাণ কাজ বন্ধ
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :: ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি টাকা আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। দূর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ প্রকল্পের টাকা থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে। বিধি অনুযায়ী যৌথ স্বাক্ষরের ব্যাংক একাউন্টে এ টাকা জমা থাকার কথা। অথচ ইউএনও অসৎ উদ্দেশ্যে অগ্রণী ব্যাংক, কবিরপুর বাজার, শৈলকুপা শাখায় একক নামে ২০০০১৬৭৯ নং নতুন একটি একাউন্ট খুলে সেখানে টাকা জমা রাখেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের পিআইসিদের অভিযোগের ভিত্তিতে গৃহ নির্মাণ কাজ বর্তমানে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসন। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৮ মে’১৯ তারিখে জেলা ত্রাণ শাখার ৫১.০১.৪৪০০.০২৩.১৬.০৪১.১৯-১৯ নং স্মারকের আদেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় গৃহহীনদের জন্য দূর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ প্রকল্প আসে। প্রকল্পের আওতায় শৈলকুপায় ৩৩ টি ঘর নির্মানের বরাদ্দ হয়। বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমান ৮৫ লাখ ৩১ হাজার ৫২৩ টাকা। তৎকালীন ইউএনও উসমান গনি ব্যাপক খোঁজ খবর নিয়ে প্রকৃত গৃহহীনদের নামের একটি তালিকা তৈরি করে উপজেলা কমিটির সভায় উপস্থাপন ও প্রাথমিক অনুমোদন করায়। সে মোতাবেক পরবর্তিতে উপজেলা কমিটির পাঠানো নামের তালিকা ১ আগষ্ট ২০১৯ জেলা প্রশাসক অনুমোদন দেন। দূর্যোগ সহনীয় বাসগৃহের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়ম অনুযায়ী পিআইও এবং ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষরিত অগ্রণী ব্যাংক কবিরপুর শাখায় ১৫৫৯ নং একাউন্টে গচ্ছিত রাখা হয়। বর্তমান ইউএনও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ৩৩ টির মধ্যে ৩০টি ঘরের পিআইসিদের নামে ২ লাখ টাকা করে পিআইও আব্দুর রহমানের নিকট থেকে চেক ইস্যু করিয়ে নেন। ২২ সেপ্টেম্বর’১৯ তারিখের চেক নং ০৭২১৩০১ থেকে ক্রমানুসারে ০৭২১৩১৪ পর্যন্ত এবং ২৪ সেপ্টেম্বর’১৯ তারিখের চেক নং ০৭২১৩১৫ থেকে ০৭২১৩৩০ পর্যন্ত মোট ৩০টি চেক ইস্যু হয়। পরে নিজের অফিসে ডেকে সুবিধামত সময়ে চেক রিসিভে বেশকিছু পিআইসিদের স্বাক্ষর করাতে বাধ্য করেন ইউএনও। চেক ৩০টির বিপরিতে ৬০ লাখ টাকা ইউএনও নিজের একাউন্টে জমা করেন। ১নং ত্রিবেনী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও উক্ত কাজের পিআইসি আব্দুল করিম জানান, নির্মাণ কাজের স্বচ্ছতা রাখতে তিনি নিজের মত করে সব দেখভাল করবেন বলে পিআইসিদের নিকট থেকে নানামুখি চাপ প্রয়োগ করে চেক রিসিভে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন। তবে ভবিষ্যতে অন্যান্য কাজের বিষয়ে তিনি কিছুটা আর্থিক সুবিধা দেবেন বলেও আশ্বস্ত করেছেন। ৭নং হাকিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান জিকু জানান, কৌশলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কিছু ইউনিয়নের পিআইসিদের ইউএনও নিজের অফিসে ডেকে চেক রিসিভে স্বাক্ষর করে নিয়েছেন। একই মতামত দিয়েছেন একাধিক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন ইউনিয়নের পিআইসগণ। পিআইসিদের অভিযোগ, ইউএনও ব্যক্তিস্বার্থে ও টাকা আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে পিআইসিদের বাদ দিয়ে নিজের মনপুর্ন লোক দিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। তিনি বরাদ্দকৃত ৩৩টি ঘরের বিপরীতে ৮৫ লাখ ৩১ হাজার ৫২৩ টাকার মধ্যে ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে নিজের কাছে রেখেছেন। পূর্বের ও বর্তমান নোটসীট দেখলেই অভিযোগের সত্যতা মিলবে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ পিআইসিরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২ অক্টোবর ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আরিফ উজ-জামান শৈলকুপায় এসে উক্ত প্রকল্পের ফাইল দুটি জব্দ করে জেলায় নিয়ে যান। পর দিন ৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকালে ইউএনও সাইফুল ইসলাম ফাইল ফিরে পেয়ে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাতে ফাইল থেকে মুল নোটসিট বের করে তা ছিড়ে ফেলেন। একই সাথে নিজের মনগড়া আরেকটি নতুন নোটসিট তৈরী করে পিআইও আবদুর রহমানকে দিয়ে জোর পূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে তা ফাইলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে। তবে পূর্বের নোটসিটের সাথে নতুন নোটসিটের অনেকাংশেই গড়মিল রয়েছে বলে জানান উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। তিনি আরো জানান, গোপন তথ্য ফাঁস হলে পিআইও আবদুর রহমানের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে অন্য প্রকল্পের বিষয়ে অবৈধভাবে একটি শোকোজ নোটিশ করেছেন ইউএনও। সচেতন মহলের দাবী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুষ্ঠ তদন্ত হলে ইউএনও’র অনিয়ম ও দূর্নীতির আরো তথ্য বেরিয়ে আসবে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের নিকট বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আরিফ উজ-জামান জানান, সরকারি খাতের টাকা যৌথ একাউন্টে থাকার কথা। দূর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ প্রকল্পের টাকা শৈলকুপান ইউএনও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের একক একাউন্টে জমা রাখাসহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত সরকারি টাকা ইউএনও’র একক নামে প্রবেশ করার প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে প্রকল্পের কাজ সাময়িক বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে শুরু হওয়া গৃহনির্মান কাজ সাময়িক বন্ধের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে যথাস্থানে পৌছে যাওয়া নির্মাণ সামগ্রি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সুবিধাভোগিরা।
চরম অস্তিত্ব সংকটে ও অবহেলিত ‘বাগদি’ সম্প্রদায় এখন বিলুপ্তির পথে
ঝিনাইদহ :: বাগদি একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে এদের বাস। তবে এদেশে বসবাসবাসী বাগদীদের নিজস্ব জমি বা বসত ভিটা নেই। এদেরকে বুনো বা বাগদি সম্প্রদায় বলা হয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে দেখা যায় এ সম্প্রদায়ের মানুষদের। সমাজে অচ্ছুত বলে পরিচিত এ সম্প্রয়ের মানুষ মাছ-কাঁকড়া-কুইচ্যা-কচ্ছপ-খরগোশ শিকার করে, ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে চলে তাদের জীবন। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে চরম অস্তিত্ব সংকটে এ অবহেলিত সম্প্রদায়। অস্তিত্ব সংকট নিয়েও এলাকাতেই এখনও কিছু বাগদী জনপদ টিকে আছে। সরোজমিনে কথা হয় ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার তৈলকূপী গ্রামের বাগদি সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে। ঐতিহাসিকভাবেই বাগদী জাঁতি জলাভূমি প্রতিবেশ এলাকায় বসতি গড়ে তুলেছিল। বিল, বাওড়, নদীর কিনার, নালা ও খালের ধারেই জলাভূমি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সহায় সম্পদে গড়ে ওঠা সেই দু:সাহসী স্বনির্ভর বাগদী আখ্যান এখন আর নেই। জীবন ধারণের জন্য নদি, বিল-হাওড়ে বা কৃষি খামারে নামতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। বিল-বাওড় নদীর ইজারাদার কিংবা খামারের মালিকের হাতে অনেক সময় হতে হয় শারীরিকভাবে নির্যাতিত। এককালে বাগদীরাও নিজস্ব সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম পালন করতেন কিন্তু বাঙালি হিন্দু সমাজের সাথে বসবাসের ফলে তারাও নিজস্ব ধর্ম থেকে বাধ্য হয়েছেন সনাতন হিন্দুধর্মে আত্তীকরণের। বাঙালি হিন্দু সমাজের কঠোর বর্ণপ্রথা বাগদীদের অচ্ছুত ও নিচুজাত বানিয়ে রেখেছে এখনও। এখনও বাগদীদের সাথে কথিত বর্ণহিন্দুর জলচল নেই। বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষকে সাধারণত অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা বুনো নামে চিহ্নিত করে থাকে। তবে বাগদীদের ‘বুনো’ বলাটা বাগদীরা মোটেও সহ্য করতে পারেন না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার চাপে হারিয়ে গেলে ভাগদিদের নিজস্ব সংস্কৃতি। মূলত: বাগদী ভাষার চর্চা এখন এক প্রবীণজন ছাড়া নতুন প্রজন্মের ভেতর নেই বললেই চলে। উৎসবের আমেজ মূলত: হেমন্ত ও শীতকালে। আমন ধান কাটার পরই বাগদী সমাজও আপন জাতিগত আচাররীতিতে টানটান হয়ে ওঠে। বাঙালি কৃষকরা মূলত: অগ্রহায়ন থেকে পৌষের প্রথম দিকে বিল এলাকার আমন ধান কেটে ঘরে তুলেন। আমন মওসুমে বিল এলাকার দেশী আমন ধানের শীষ কেটে কেটে ইঁদুরেরা গর্তে নিয়ে যায়। আর তখন বাগদিরা ইন্দুরগাতি উৎসব পালন করে থাকে। কারণ এই ইঁদুরের গর্ত থেকে তারা ধান সংগ্রহ করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাগদি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উৎসবে অনেকখানি ভাঁটা পড়েছে। সমাজের মূল ধারার বাইরে থাকায় এ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার ভোগ করতেই এদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ বাগদিরা কোনো ধরনের সরকারি সাহায্য ভোগ করতে পারে না। এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়েও ভর্তির সুযোগ তেমনভাবে পাননা। চিকিৎসা বঞ্চিত বাগদি সম্প্রদায়ের কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা চলে শুধুমাত্র নিজস্ব পদ্ধতির ঝাড়ফুঁকে। নোংরা বাস অযোগ্য পরিবেশে তাদের বসবাস। রান্নাবান্নাও চলে এখানে। বাল্য বিবাহ তাদের অন্যতম ঐতিহ্য। অপুষ্ট শিশুগুলোর দুরন্ত দৌড়ঝাঁপ আসলে বুঝতে দেয় না তাদের জীবন করুণ দিকটিকে। এখানকার বয়স্কদের টিকে থাকার বিষয়টি আরও বেদনাদায়ক। এতোকিছুর পরও তাদেরকে ঘিরে নেই কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা।পর্যাপ্ত না হলেও বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসন থেকে তাদের উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে কিছুকিছু উদ্যোগ। উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকেও। এখনই সময় সঠিক উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেয়ার। তৈরি করতে হবে বাগদিদের নিজের মতো করে বাঁচার পরিবেশ। তাহলেই বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে বাগদি নামের একটি দেশের ক্ষুদ্র একটি নৃ-গোষ্ঠী। এ ব্যাপারে কথা হয় কালীগঞ্জ উপজেলার তৈলকূপী গ্রামের ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমানের সাথে তিনি জানান, আমাদের গ্রামে আগে অনেক বাগদি সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। কালের বিবর্তনে তারা অনেকেই জীবন জীবিকার তাগিতে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে গিয়াছে। এখন এই গ্রামে ১৫/১৬ টি বাগদি সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস। আমরা সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি তারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও হিন্দুরাদের কাছে তাদের মূল্যায়ন সেইভাবে আসেনি। বাগদি সম্প্রদায়ের লোকেরা পূজাপার্বন সবই হিন্দুদের নিয়ম নীতিতেই করতে দেখে আসছি। আগে তারা সরকারী কোন সুযোগ সুবিধা না পেলেও এখন কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে যেমন, প্রতিবন্ধি ভাতা, বসষ্কভাতা, গর্ভবতি ভাতা ইত্যাদি। তবে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্টির দিকে সরকারী আরো সুযোগ সুবিধা পেলে তারা অস্তিত্ব সংকট থেকে মুক্তি পাবে।