বৃহস্পতিবার ● ৭ নভেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » অর্থ-বাণিজ্য » সুন্দরবনে শুঁটকি উৎপাদন করে বছরে ৫শত কোটি টাকার রফতানি সম্ভব
সুন্দরবনে শুঁটকি উৎপাদন করে বছরে ৫শত কোটি টাকার রফতানি সম্ভব
শেখ সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট প্রতিনিধি :: সুন্দরবনের উপকূলের দুবলার চরেচলছে শুঁটকি তৈরির ভরা মৌসুম।এতে কাজ করবে প্রায় ৫০ হাজার জেলে সঙ্গে কমপক্ষে ১০-১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। শীতে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় শুঁটকি উৎপাদন যেমন বেশি হয়, তেমনি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানিও চলে পুরোদমে।এবার দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার শুঁটকি মাছ রফতানির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকি মহালে এই শুঁটকি মহালের সঙ্গে কমপক্ষে ১০-১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। শুঁটকি শিল্পের সঙ্গে ব্যবসায়ীসহ প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক জড়িত রয়েছেন। এভাবে সারাদেশে শুঁটকি তৈরি ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে লাখো নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান জড়িত।তাই উপকূলীয় অঞ্চলের ছোট-বড় সব শুঁটকি মহালগুলোতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলে, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। আর সরকারী সহযোগিতা পেলে এ শিল্পকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে আশা তাদের।সুন্দরবনের লালদিয়া, আশারচর, সোনাকাটা, জয়ালভাঙ্গা চরের, শুঁটকি পল্লীতে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ৬ মাস ধরে চলে শুঁটকি পক্রিয়াজাতকরনের কাজ। শুঁটকিকে কেন্দ্র করে উপকূলীয় হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবীদের আনাগোনায় মূখরিত থাকে এসব চরগুলো। সরেজমিনে দেখা যায়, গভীর সাগর থেকে জেলেরা মাছ নিয়ে দেশের বৃহত্তম মৎস অবতরন কেন্দ্র পাথরঘাটা (বিএফডিসি) ঘাটে ভিড়ছেন।
ব্যবসায়ীরা সেই মাছ কিনে পল্লীতে নিয়ে যাচ্ছেন। এরপর ধুয়েমুছে কাটা-বাছার পর শুঁটকির জন্য বাঁশের তৈরি মাচায় রোদে শুকাচ্ছেন। আবার কেউ বস্তায় ভরছেন শুঁটকি মাছ। প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকানো এই শুঁটকি নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। এখানের উৎপাদিত শুঁটকি দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি হচ্ছে। এ সময় প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি দেখা যায়।এর মধ্যে রূপচাঁদা, ছুরি, লইট্যা, কোরাল, সুরমা, পোপা উল্লেখযোগ্য। মধ্য-উপকূল এবং পশ্চিম-উপকূলের বাসিন্দাদের মধ্যে শুঁটকি খাওয়ার প্রবণতা কিছুটা কম থাকলেও পূর্ব-উপকূলের মানুষজনের কাছে শুঁটকি অত্যন্ত প্রিয়।
মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানানোর প্রথা অনেক পুরোনো হলেও বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন হয় মূলত দেশের উপকূলীয় এলাকাতেই। প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ১০টি ট্রাক অর্থাৎ ৮০ থেকে ৯০ টন শুঁটকি মাছ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যা স্থানীয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লইট্যা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, ফাইস্যা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, ছুরি ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, ছোট চিংড়ি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ছোট পোয়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, রইস্যা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, রূপচাঁদা ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা, লাক্ষা ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা, মাইট্যা ৫০০ থেকে ৭০০, বড় চিংড়ি (চাগাইচা) ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়ে থাকে।বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে শুঁটকি তৈরি হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টন। এর অধিকাংশ প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থাৎ রৌদ্রে শুঁকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। শুঁটকি তৈরিতে ১৬টি কারখানা ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে যেখানে রৌদ্রের পরিবর্তে বিদ্যুতের তাপে মাছ শুকানো হয়। মাছের শুঁটকি তৈরি করা হয়Ñ কুয়াকাটা, দুবলারচর, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ, সোনাদিয়া, রাঙ্গুনিয়া, খুরুশকুল, ঘোরকঘাটা, চকোরিয়া, সেন্টমার্টিন, নাজিরের টেক, সোনারচর, কক্সবাজার, আশারচর ইত্যাদি স্থানে। জনপ্রিয় শুঁটকি তালিকায় রয়েছেÑ ছুরি, লইট্টা, রূপচাঁদা, কোরাল, লাক্ষ্যা, সুরমা, পোপা, ফাইস্যা, কাতরা, বিসা, রিঠা, হাঙ্গর, কাইক্যা, বাচা, চান্দা প্রভৃতি। বিশেষত বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ অঞ্চলের হাওড়-বাঁওড়, নদী-নালা, খাল-বিলের মাছ রৌদ্রে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। প্রাফত তথ্যে জানা যায়, সারা বছর সমুদ্র থেকে মাছ ধরা হলেও শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। আমাদের দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা
এছাড়াও শুঁটকি মহালের মাছের গুড়ি সারাদেশে পোল্ট্রি ফার্ম ও ফিস ফিডের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে। ঢাকার বড় বড় ফিস ফিডের ফার্মসহ দিনাজপুর, নরসিংদী, চট্টগ্রামেও চাহিদা মেটায়। প্রতি মৌসুমে নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল থেকে লইট্টা, পাইশ্যা, পোয়া, ছুরি, মাইট্যা, কেচকি, রূপচাঁদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিদেশে রফতানিসহ ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে।উপকূলে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। এবার দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার শুঁটকি মাছ রফতানির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। সূত্র বলেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬২৩ মেট্রিক টন শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয় (২০১৭-১৮ অর্থবছরে হিসাব) দেশে ৮-১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি করা হয়। সমুদ্র উপকূলের নিকটবর্তী দ্বীপের পলি মাটিতে কৃষি আবাদ বহু মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। সয়াবিনের মতো অর্থকরী ফসল উৎপাদনেও বিপ্লব ঘটেছে উপকূলে। সমুদ্র সৈকতের খনিজ বালু এই জনপদের আরেক সম্ভাবনা। পর্যটন খাতেও উপকূল জুড়ে রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। উপকূলজুড়ে শুঁটকি উৎপাদনের বিরাট সম্ভাবনা থাকলেও পদে পদে রয়েছে বাধা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব আর বাজারজাতকরণে বহুমূখী সমস্যার কথা জানালেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই শিল্প থেকে আরও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি এ শিল্পে জীবিকা নির্বাহ হতে পারে লাখো লাখো মানুষের। এক কেজি শুঁটকি মাছ তৈরিতে প্রজাতি ভেদে প্রায় ৩-৫ কেজি কাঁচা মাছ প্রয়োজন। উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন শুঁটকির জন্য সমুদ্র থেকে মাছ সংগ্রহ করে। অধিকাংশ এলাকায় প্রচলিত নিয়মে সূর্যের আলো ব্যবহার করে শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের জন্য শুঁটকির প্রক্রিয়াজাতকরণকালে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর কেমিক্যাল বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ক্ষতির দিক বিবেচনায় রেখে স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি উৎপাদনের বেশকিছু বেসরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জলিলুর রহমান উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তির ড্রায়ারটির নাম ‘বিএফআরআই ফিশ ড্রায়ার’। এই ড্রায়ারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত গুণগতমানসম্পন্ন শুঁটকি মাছ তৈরি করা সম্ভব। বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের মৎস্য উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. শফিউদ্দিন মশারির জালে ঢাকা ট্যানেল এবং হলুদ-মরিচ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। এই প্রযুক্তির ট্যানেল তৈরিতে ব্যয় অন্য প্রযুক্তিগুলির তুলনায় অত্যন্ত কম ও ব্যবহার পদ্ধতি খুবই সহজ এবং উৎপাদনকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য। প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি শুঁটকিখাতের অন্যান্য সংকটেরও সমাধান করতে হবে। সে কথাই বললেন কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি, কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদসহ শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিমত, নাজিরেরটেক শুঁটকি মহাল থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হলেও, বহু লোকের কর্মসংস্থান হলেও এর সম্ভাবনা বিকাশে সরকারের বিশেষ নজর নেই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে, জেলেদের দাদন মুক্ত করা গেলে এবং শুঁটকি বাজারজাতকরণের সমস্যাসমূহ দূর করতে পারলে উপকূলের শুঁটকি বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদিন জানান, এ বছরে শুঁটকি আহরণের জন্য এক হাজার ৪০টি জেলে ঘর, পাঁচটি ডিপো ঘর ও সাতটি অস্থায়ী দোকান ঘর তৈরির অনুমতি দেয়া হয়েছে। দুবলা জেলে পল্লী টহল ফাঁড়ির আওতাধীন অফিস কিল্লা-মাঝের কিল্লা, মেহেরআলীর চর, আলোরকোল, নারিকেল বাড়িয়া ও শেলারচরে শুঁটকি প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হবে। মার্চ মাস পর্যন্ত শুঁটকি আহরণের কার্যক্রম চলবে।এসিএফ জানান, জেলেরা শুঁটকি পল্লীতে অবস্থানকালে তাদের ঘর তৈরি ও অন্যান্য কাজে সুন্দরবনের কাঠ, গোলপাতাসহ কোনো সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে না। ২৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থ নির্ধারণ করে ঘরের মাপও ঠিক করে দেয়া হয়েছে। শুঁটকি প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত সবকিছুই তাদের নিজ নিজ এলাকা থেকে নিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র গভীর বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ আহরণ করে সুন্দরবনের উল্লেখিত পাঁচটি চর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বনবিভাগের এসব শর্ত কেউ ভঙ করলে তার বিরুদ্ধে বন আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত বছর শুঁটকি খাত থেকে দুই কোটি ৭১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এ বছরে আরো বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বন বিভাগের খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মোঃ মঈনুদ্দিন খান জানান, পাস-পারমিট ছাড়া জেলে ও মৎস্যজীবীরা সুন্দরবনে প্রবেশ করলে এবং জেলেদের কাছ থেকে সুন্দরবন বিভাগের কেউ টাকা আদায় করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে চলতি মওসুমের শুরুতেই নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ।
এ ব্যাপারে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কামাল আহম্মেদ জানান, প্রতি বছর চট্টগ্রাম, সাতক্ষিরা, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, শরণখোলা, মোংলা, রামপাল, দাকোপ থেকে প্রায় ২০ হাজার জেলে দুর্যোগসহ বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করেন। এ খাত থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করলেও জেলেদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র বা চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা নেই। এদিকে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।ছবি সংযুক্ত আছে।