মঙ্গলবার ● ১২ নভেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » পাবনা » চলনবিল অঞ্চলে অবাধে চলছে শামুক নিধন
চলনবিল অঞ্চলে অবাধে চলছে শামুক নিধন
পাবনা প্রতিনিধি :: পাবনার চাটমোহর নয় চলনবিল অধ্যুষিত প্রায় সকল এলাকাতেই চলছে অবাধে শামুক নিধন যজ্ঞ। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এ বিলে অতীতে পচুর পরিমাণে মাছ শামুক ঝিনুক জলজ উদ্ভিদ লতা পাতা থাকলেও এখন তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। মাছের এবং হাঁসের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে চলনবিলের শামুক। কয়েক বছর যাবত বিল থেকে ব্যাপক হারে নির্বিচারে শামুক নিধন শুরু হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে চলনবিলের জীববৈচিত্র যে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক দশকে চলনবিলের মধ্য দিয়ে অসংখ্য সড়ক মহাসড়ক নির্মিত হওয়াসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের কারণে চলনবিলের প্রাণবৈচিত্র যখন হুমকির মুখে এমন সময় পরিবেশের ভারস্যাম্য রক্ষাকারী শামুকের অবাধ নিধন ভাবিয়ে তুলছে পরিবেশবিদদের।
চাটমোহরের ছাইকোলা ইউনিয়নের ধানকুনিয়া গ্রামের ফেরদৌস (১৪)। পিতা ইসরাইল সরকার। বোয়াইলমারী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ফেরদৌস জানান, বাবা কৃষি শ্রমিক। অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। কাজ না থাকলে বিল থেকে সারাদিন শামুক তোলেন। বিকেলে পাইকাররা এসে তা কিনে নিয়ে যান। ফেরদৌস বলেন, “লেখাপড়ার অবসরে আমি নিজেও শামুক উত্তোলনের কাজ করি। মাত্র সোয়া বিঘা জমি আমাদের। দুই ভাই এক বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ভাই ফিরোজ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বেকার অবস্থায় আছেন। বাড়ির খানেআলা চার জন। স্কুলে যাবার ভাড়া, বাড়ির হাট বাজার এবং নিজের হাত খরচ চালানোর জন্য চলনবিলে শামুক উত্তোলন করি।”
আসাদুলের বয়স দশ এগারো বছর। ধানকুনিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। পিতা গোলজার হোসেন। শামুক তুলে রাস্তার ধারে বিলের পানিতে ডিঙি নৌকা ঠেকিয়ে পাইকারের অপেক্ষায় রাস্তায় বসেছিলো আসাদুল। পাইকারের আসতে দেরি হওয়ায় অনেকটা বিরক্ত আসাদুল বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল। পাইকার আসলে শামুক বিক্রির টাকা নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে হয়তো বাড়ি ফিরবে সে ও তার বাবা। আসাদুল বলে, “ডিঙি নৌকা নিয়ে বাবার সাথে শামুক তুলতে যাই খলিশাগাড়ি বিলে। আমি ডিঙি নৌকা নিয়ন্ত্রণ করি আর আমার বাবা চিকন বাঁশের মাথায় লাগানো জাল দিয়ে নৌকার উপর থেকে শামুক তুলে নৌকার ডওরায় রাখেন”।
ছাইকোলা ইউনিয়ন ধানকুনিয়া গ্রামের গোলজার মোল্লা জানান, ভাদ্র থেকে কার্তিক এ তিন মাস হাতে তেমন কাজ থাকে না। কৃষি কাজ না থাকায় এ সময় শামুক তোলার কাজ করেন তিনি। সকাল ৬টার দিকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করেই বেড়িয়ে পড়েন শামুকের সন্ধানে। চাটমোহরের পাশর্^বর্তী বোঁথর, রামনগর, সোনাহার পাড়া, নটাবাড়িয়া, ঝাঁকড়া, কাটেঙ্গা, চামটা, দয়রামপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের পাশর্^বর্তী জলাশয়ে চলে যান। একেক দিন একেক এলাকায় যান। শামুক বিক্রি করতে বিকেলে ফিরে আসেন চাটমোহর- ছাইকোলা সড়কের বোয়াইলমারী বিলের উত্তর পাশের রাস্তায়। রাস্তার সাথে নৌকা ভিড়িয়ে ডালি ভরে ভরে রাস্তার উপর বস্তায় প্যাকেট করেন শামুক। তিনি জানান, রোদ বৃষ্টিতে ভিজে এতো কষ্ট করে শামুক তুলে আনলেও পাইকাররা ন্যায্য মূল দেন না। কখনো সোয়া দুই টাকা আবার কখনো আড়াই টাকা কেজি দাম দেন তারা। মোকামের অজুহাতে তারা তাদের ইচ্ছামতো দাম কমান এবং বাড়ান।
শামুকের পাইকারী ক্রেতা চাটমোহরের হরিপুর গ্রামের নির্মল চূর্ণকারের ছেলে নিখিল চূর্ণকার জানান, পাইকাররা চলনবিল এলাকার ধানকুনিয়া, বোয়াইলমারী, বনপাড়া, রাজাপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহিত শামুক কিনে চাটমোহর ভাদুনগর, রেলবাজার ও বনপারা-হাটিকুমরুল সড়কের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যান। পরে ট্রাক যোগে এসব শামুক চলে যায় খুলনা এলাকার চিংড়ি ঘেরে।
চাটমোহর ডিগ্রী (অনার্স) কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ের প্রভাষক এবং বিভাগীয় প্রধান পরিবেশবিদ ড. এফ এম মুক্তি মাহমুদ বলেন, অবাধে শামুক নিধনের ফলে খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙ্গে যাবে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন অনেক জলজ কীটপতঞ্জ শামুক খেয়ে ফেলে এবং এভাবে পানি পরিশোধনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার এমন অনেক প্রাণী আছে যাদের অন্যতম খাদ্য শামুক। শামুক নিধন ক্রমাগত চলতে থাকলে এসকল প্রাণীর খাদ্য সংকট দেখা দিবে।
এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ বলেন, প্রাণী জগতসহ সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় শামুক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে তাই পরিবেশের বিপর্যয় রোধ কল্পে অবাধে শামুক নিধন রোধ করা প্রয়োজন।