সোমবার ● ২ ডিসেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » সিরাজগঞ্জের তাড়াশে টিআর-কাবিখা প্রকল্পে হরিলুট
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে টিআর-কাবিখা প্রকল্পে হরিলুট
সোহেল রানা,সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি :: সিরাজগঞ্জে তাড়াশে টেস্ট রিলিফ (টিআর)-কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের লক্ষ লক্ষ টাকা হরিলুট হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। কোন কোন প্রকল্পে বরাদ্দের অর্থের পুরোটাই আবার কোন প্রকল্পে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ কাজ করে বাকী টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা.আব্দুল আজিজ ও তার ভাই আবু সাঈদ, ভাগ্নে আব্দুস সবুর ওরফে মিল্টন, তাড়াশ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নুর মামুনসহ গুটিকয়েক নেতা এবং জন প্রতিনিধিরা নানা কৌশলে এ লুটপাট করেছে। তবে কাজ না হলেও কাগজে-কলমে শতভাগ কাজ দেখানো হয়েছে-এক্ষেত্রে কেউ কোন কার্পণ্য করেনি। এদিকে, প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচন হবার পর প্রথম বরাদ্দের টিআর-কাবিখা কাজে ব্যাপক অনিয়ম হওয়ায় তৃনমুল নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সুত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দ্বিতীয় কিস্তিতে তাড়াশ উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজের অনুকুলে টিআরের ৪৩টি প্রকল্প ও কাবিখার ৯টি প্রকল্প, সাধারন বরাদ্দে টিআরের ২৩ এবং কাবিখার ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কাগজে কলমে প্রতিটি প্রকল্পে ১০০% কাজ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে ইতোমধ্যে রিপোর্টও প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু সরেজমিনে পুরোই উল্টো চিত্র দেখা যায়। উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরগাতী দেলবারের বাড়ী হতে কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু গত দেড় বছরে ওই রাস্তায় এক টুপড়ি মাটিও ফেলানো হয়নি। এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন, তাইবুর রহমান ও সবুর জানান, রাস্তাটি দীর্ঘদিন ধরে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শুনেছি মেরামতের জন্য এমপি টিআর বরাদ্দ দিয়েছে কিন্তু কোন কাজ করা হয় নাই। পুরো টাকাই আত্মসাত করা হয়েছে। একই ইউনিয়নের সেরাজপুর রহমানের বাড়ী হতে আলহাজ¦ আজগর আলী বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য এমপি কোটায় টিআরের ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও সেখানে কোন কাজ করা হয় নাই। ওই গ্রামের আজগর আলী জানান, আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে টাকা দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেছি। এখানে টিআরের কোন কাজ হয় নাই।
তবে প্রায় সাতমাস আগে স্থানীয় ইউপি সদস্য লেবু দুই ট্রাক মাটি ফেলে দিয়েছিল। বারুহাস ইউনিয়নের কাজিপুর পুর্বপাড়া সাহেব আলীর বাড়ী হতে লয়মুদ্দীনের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য টিআরের ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও কোন কাজ হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল জানান, রাস্তাটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৪০দিনের কর্মসুচীর টাকা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে কাজের সেক্রেটারী শরিফুল ইসলাম জানান, এমপির ভাগ্নে মিল্টন প্রথমে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে কিছু কাজ করেছি। এখনো ১০ হাজার টাকা বাকী আছে। পরে এমপির ভাগ্নে মিল্টন ৫ হাজার টাকা দেয়। আর কোন টাকা দেয় নাই।
প্রকল্পের সভাপতি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক জানান, আমি প্রকল্পে সম্পর্কে কিছু জানিনা। কোথাও সই দেই নাই। কত টাকা বরাদ্দ তাও জানিনা। শুনেছি এমপির ছোট ভাই আবু সাঈদ ও মিল্টন টাকা দিয়েছে এলাকার যুবলীগ নেতা রফিকুল কাজ করেছে। তবে কত টাকা দিয়েছে তাও আমার জানা নেই। একই ইউনিয়নের তাড়াশ-রানীর হাট রাস্তা সংলগ্ন আতাউরের বাড়ী হতে আলহাজ¦ গাজী সাইদুর রহমানের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এক কোদাল মাটিও সেখানে ফেলা হয়নি।
আতাউর রহমান জানান, বিভিন্ন স্থানে ধর্না দিয়ে রাস্তাটি মেরামত করতে পারি নাই। পরে নিজেই এলাকাবাসীর সহায়তা রাস্তাটি মেরামত করেছি। যদি বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে তবে পুরো টাকাই আত্মসাত করা হয়েছে। বিনসাড়া-কুসুম্বি পাকা রাস্তায় লালমিয়ার বাড়ি হতে ঝিনাই গাড়ির পার পর্যন্ত রাস্তা মেরামতে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও কোন কাজ করা হয় নাই। বিনসাড়া গ্রামের স্বেচ্ছাসেবলীগের ওয়ার্ড সভাপতি শহীদুল ইসলাম জানান, বিগত ৫ বছরের মধ্যেও এ রাস্তায় কোন মাটি বা মেরামত হয়নি। কুসুম্বি আয়সা নাজাতুল্লাহ স্কুল এন্ড কলেজ উন্নয়নে ৫০ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া থাকলেও বাস্তবে কোন প্রকার কাজ হয়নি। কুসুম্বি আয়সা নাজাতুল্লাহ স্কুল এন্ড কলেজের কর্তৃপক্ষ জানান, কাজতো দুরের কথা আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ আছে কিনা এ বিষয়টি আমরা জানি না।
পালাশী মাদ্রাসা ভরাটে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু কোন কাজ করা হয়নি। শুধু এমপির অনুকুলে বরাদ্দের প্রকল্পগুলো নয় উপজেলার প্রতিটি প্রকল্পের অবস্থা একই রকম। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা বলছেন, টিআরের সব টাকা সংসদ সদস্যের সহায়তা তার ভাই আবু সাঈদ ও ভাগ্নে মিল্টন সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সহায়তা আত্মসাত করেছে। প্রথমবারের মতো ডা. আব্দুল আজিজ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে টিআর-কাবিখার অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িয়ে পড়ায় তৃনমুল নেতাকর্মীদের নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। অবিলম্বে এ সকল দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি বরাদ্দকৃত প্রকল্পগুলো সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়নের দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা নূর মামুন বলেন, প্রাথমিকভাবে সুষ্ঠভাবে কাজ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হওয়ায় বিল প্রদান করা হয়েছে। যেহেতু অভিযোগ ওঠেছে তাই পুনরায় প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করার পর প্রকল্পগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবো। এর বেশি কিছু এখন বলা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্যের ভাই আবু সাইদ জানান, প্রকল্পের কাজ হবে কি হবে না-সেটা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস বুঝবে? এতে আপনাদের সমস্যা কি? আপনাদের কোন সমস্যা হলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
এবিষয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকা তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইফ্ফাত জাহান মোবাইলে জানান, প্রকল্পের তদারকি করেছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নূর মামুন। প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে বলে আমার বাসায় এসে স্বাক্ষর নিয়ে বিল প্রদান করেছেন। তবে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, অভিযোগ থাকলে তদন্তপুর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
এবিষয়ে সংসদ সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ জানান, টিআর-কাবিখা প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে কোন অনিয়ম দুর্নীতি হলে তদন্তপুর্বক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।