শুক্রবার ● ২২ জানুয়ারী ২০১৬
প্রথম পাতা » প্রকৃতি ও পরিবেশ » হারিয়ে যাওয়া পাতকুয়ার সেকাল-একাল
হারিয়ে যাওয়া পাতকুয়ার সেকাল-একাল
বদিয়ার রহমান, লালমনিরহাট প্রতিনিধি :: আমি কি বালতিতে করে জল তুলিনি’ জীবনানন্দ দাসের কবিতায় বালতিতে করে জল তোলা’র এই অনুষঙ্গটি বিশেষ এক ভাবের দ্যোতনা প্রকাশ করে৷ কিন্তু বাস্তবে ‘ বালতিতে জল তোলার প্রসঙ্গ আসলে চোখের সামনে ভেসে উঠে হাজার বছরের আবহমান বাঙালীর পানীয় জলের উত্স পাতকুয়ার ছবি৷ বাঁশের কোঠায় ঝুলানো লম্বা রশির মাথায় বাঁধা বালতিতে রশি টেনে কারো মুর্ত রুপ৷ মাটির উপরি স্তর থেকে স্বচ্ছ জলের স্তর পর্যন্ত গভীর খোড়া গোলাকার কুপ,- এই কুপ থেকেই কুয়া৷ বাংলায় ‘ পাত’ শব্দটি ‘ছোট’ অর্থে ব্যবহার হয়৷ এই পাত-এর সাথে কুয়া শব্দটি যোগ হয়ে পাতকুয়া শব্দটি এসেছে৷ ‘পাতকুয়া’র সমর্থক শব্দ ইদারা৷ এর অপভ্রংশ রুপ ‘ ইন্দিরা’৷ সাধারনত পানীয় জলের অগভীর কুপ-ই পাতকুয়া৷ এই অগভীর খোড়া গোলাকার গর্তের ভেতরে বালি-পাথর ও সিমেন্টের তৈরী গোলাকার পাট, কখনো বাঁশের তৈরী খাঁচা বেষ্টনী হিসেবে ব্যবহার হতো৷ তাই পাতকুয়া কোথাও কোথাও পাটকুয়া, মজার ব্যাপার হলো খুব কম সংখ্যক মানুষের মুখে কুয়া শব্দটি শোনা যেত৷ এই কুয়া, কুয়া নয়,’চষা হয়েই উচ্চারিত হত সর্ব সাধারনের মুখে মুখে৷ ভৌগলিক দিক থেকে বাঙালির সংসার ছিল জলময়৷ একটা সময় ছিল নদী বিধৌত বাংলা যেন ছিল একটা জলাধর৷ এই উম্মুক্ত জলাধর ছেড়ে ভারত উপমহাদেশের বাঙালি অধ্যুসিত বাংলার মানুষ করে থেকে পানযোগ্য পাতকুয়ার ব্যবহার শুরু করে তার ইতিহাস এখনো প্রচ্ছন্ন৷ তবে প্রজা হিতৈষী সম্রাট অশোকের সময়ে প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার্তে পাতকুয়া ইতিহাস জানাযায়৷ এই পাতকুয়ার ভিতরে পোড়ামাটি কিংবা পাথর বালুর তৈরী পাটের বেষ্টনী দিয়ে তৈরী কুয়া ছিল দুর্লভ৷ এটা কেবল রাজ-রাজরা কিংবা ধনীক শ্রেণীর মানুষের বাড়ীতে দেখা যেত৷ পরবর্তীতে মোঘল আমলে বাদশাহদের প্রষ্টপোষকতায় এবং বাংলার নবাব শেরশাহের আমলে মুসাফির ও পথিকদের জন্র মহাসড়কের পাশে এবং বসত এলাকার পাড়ায় পাড়ায় অধিক সংখ্যক মানুষের জন্য একটি করে পোড়া মাটির ব্যাষ্টনী সমৃদ্ধ কুয়া নির্মিত হওয়ায় ইতিহাস পাওয়া যায়৷ এরপর প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে বিংশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত ব্যবহারের দিক থেকে পাতকুয়ার ইতিহাস সমৃদ্ধ ইতিহাস৷ পাটের বেষ্টনী সমৃদ্ধ এ সময়ের পাতকুয়া অভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হত৷ নিম্ন শ্রেণীর মানুষ সুপেয় পানির জন্য ধনীক শ্রেণীর পাটে বেষ্টনী পাতকুয়ার ধারে ভীর জমাতো৷ আশির দশকে ডিস্ট্রিক বোর্ডের অধীনে জেলার জনবহুল অঞ্চলে এবং জেলা সদরে পাটের বেষ্টনীর পাতকুয়া বসানো হয়৷ নব্বই দশকের প্রথম থেকেই নলকুপের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে পাতকুয়ার ব্যবহার কমে আসে, চাপা পড়ে পাতকুয়ার কৌলিন্য৷ স্মৃতিচারণ করলেন পাটগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছাত্তার-আমার নিজের বাড়ীতে পাটের বেষ্টনীতে পাতকুয়া ছিল৷ একবার প্রচন্ড বৃষ্টিতে কুয়াটি ভিতর দিক থেকে ঢলে পড়লে দীর্ঘদিন খোলা জায়গার পানি ব্যবহার করতে হয়েছে৷ এরপর এটি আর সংস্কার করিনি৷ নলকুপ ব্যবহার করে আসছি তখন থেকে৷ সাধারনত তিন ধরনের বেষ্টনী ব্যবহার হত পাতকুয়ায়৷ স্বচ্ছল অভিজাত পরিবারের মানুষেরা ভারতের রাণীগঞ্জে বীমপাট নামে এক ধরনের মুল্যবান মসৃন পাট ব্যবহার করতো৷ এই পাটে শ্যাওলা জমতো না৷ পানি দুষিত হওয়ার সুযোগ ছিল কম৷মধ্যম শ্রেণীর মানুষেরা কুয়ায় পাথর-বালি ও সিমেন্ট তৈরী পাট ব্যবহার করতো৷ গরীব অস্বচ্ছল পরিবারের লোকেরা বাঁশের তৈরী খাঁচা বেষ্টনী হিসেবে ব্যবহার করতো৷ বাঁশ পঁচে গন্ধ উঠত, এতে পানি দুষিত হলেও এই পাতকুয়ার পানিই ব্যবহার করতো মানুষ৷ অন্য কোন উপায় ছিল না৷ আজকের তৃতীয় প্রজন্মের কাছে বালতি দিয়ে জল তোলার দৃশ্য ‘-’ রুপ কল্পনা, বাংলায় পাতকুয়ার ব্যবহার এখন নেই৷ পাটগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অভিজাত কিছু পরিবারে পোড়া মাটির পাটের বেষ্টনীতে কিছু পাতকুয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে৷ তবে এগুলোর পানি অনেকেই গরুকে দেয়া খাবারের পানি হিসেবে ব্যবহার এবং সখের বশে বছরে এক আধদিন গোসলের কাজে ব্যবহার করলেও নিজেদের খাবারের পানি হিসেবে ব্যবহার করেন না৷ তবে কুয়ার পানিতে আর্সেনিক নামক সেঁকো বিষ সহনীয় মাত্রায় থাকায় পাটে বেষ্টনী পাতকুপের পানিকে নিরাপদ বলছেন পানি বিশেষজ্ঞরা৷ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলীর বাড়ীতে কোঠায় ঝোলানো রশিতে বাঁধা বালতিতে জল তোলার দৃশ্য চোখে পড়ে গেল কয়েকদিন আগে৷ কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলীর সাথে৷ তিনি জানালেন ‘ত্রিশ বছর আগে কুয়াটি নির্মান করেছি৷ তবে গত প্রায় বিশ বছর ধরে কুয়ার পানি পান করছিনা৷ রান্নায়ও ব্যবহার করছিনা৷ বাড়ীর বাহিরের এ কুয়ার পানি গরু-বাছুরের গাঁ ধোয়ানো ও খাওয়ানোর কাজে ব্যবহার করছি৷’ আপলোড : ২২ জানুয়ারী ২০১৬ : বাংলাদেশ : সময় : রাত ১১.২০মিঃ