শনিবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » জাতীয় » বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় কয়েক হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল
বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় কয়েক হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সরকারের নিবন্ধন না পেয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে বাংলাদেশের কয়েক হাজার সংবাদ পোর্টাল। ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদপত্রগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অনলাইন নিউজ পোর্টাল এসোসিয়েশনের (বনপা) সাধারাণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান রনি বেনারকে জানিয়েছেন, “তথ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে শত শত অনলাইনের উদ্যোক্তা উদ্বিগ্ন।”
তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত পহেলা ডিসেম্বর সচিবালয়ে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী সপ্তাহ থেকে অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিবন্ধন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যারা নিবন্ধন পাবে না, তারা এ ধরনের পোর্টাল চালাতে পারবে না।”
মন্ত্রীর এই আকস্মিক ঘোষণার বিষয়ে রোকনুজ্জামান বলেন, “সরকার যে অনলাইন নীতিমালা করেছে, সে অনুযায়ী একটি কমিশন গঠন করার কথা। কমিশন গঠনের পর তারা নিবন্ধন দেওয়ার ব্যাপারে গাইডলাইন তৈরি করবে। তার ভিত্তিতে ওই কমিশন অনলাইনগুলোর নিবন্ধন দেবে।”
তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত কমিশন গঠন হয়নি। এর মধ্যে মন্ত্রী নিবন্ধন শুরু করার ঘোষণা দিলেন। এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। আমরা কথা বলার জন্য তথ্যমন্ত্রী এবং তথ্য সচিবের কাছে সময় চেয়েছি। আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী রবি অথবা সোমবার আমাদের সঙ্গে তাঁদের বৈঠক হবে।”
বাক স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কা
যেসব সংবাদ পোর্টাল নিবন্ধন পাবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সরকারি ঘোষণায় বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন মিডিয়া গবেষক ও অধিকার কর্মীরা।
আর্টিকেল নাইনটিন এর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল বেনারকে বলেন, “সরকারের এই চেষ্টা অজ্ঞতাপ্রসূত এবং তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়।”
তিনি বলেন “ইন্টারনেটের সকল পোর্টাল রেজিস্ট্রেশন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রেজিস্ট্রেশন না দিলেও সেসব বাঙালি দেশের বাইরে থাকেন, তারা সেখান থেকে পোর্টাল চালাবেন। বিদেশি সংবাদপোর্টালগুলো বাংলাদেশে নিবন্ধিত না হয়েও যদি সংবাদ প্রকাশ করতে পারে, তাহলে শুধুমাত্র দেশের অনলাইনগুলো বন্ধ করে দেওয়া যুক্তিতে টিকবে না।”
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বেনারকে বলেছেন, “নিবন্ধনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনলাইনগুলোর কার্যক্রম অন্তত ৬ মাস খতিয়ে দেখার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি কমিটি করা উচিত। সবাইকে সম্পৃক্ত করে যাচাই বাছাই ছাড়া সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।”
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সালীম সামাদ বেনারকে বলেন, “সরকার প্রিন্ট ভার্সনের জন্য আইনী কঠোরতা কমিয়ে অনলাইন নিয়ন্ত্রণে খুব কঠোর হচ্ছে। এতে প্রেস ফ্রিডম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
এসব বিষয়ে সরকারের বক্তব্য জানার জন্য তথ্যমন্ত্রী, তথ্য সচিব এবং তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায় কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনুর কাছে বারবার ফোন করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়ে কোনও জবার পাওয়া যায়নি।
আবেদনের সংখ্যা বিভ্রাট
বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা কত এবং কত সংখ্যক উদ্যোক্তা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে একেকবার একেক কথা বলা হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, “মোট ৩ হাজার ৫৯৫টি নিউজ পোর্টাল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।”
তবে এর আগে গত ১৫ জুলাই সচিবালয়ে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “নিবন্ধনের জন্য সরকারের কাছে আট হাজারের বেশি অনলাইন নিউজ পোর্টালের আবেদন জমা পড়েছে।”
বনপা’র সাধারণ সম্পাদক রনি বলেছেন, “আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবেদনপত্রগুলো যাচাই বাছাই করে দুই দফায় প্রায় দেড় হাজার আবেদনপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দিয়েছি। এছাড়াও সংগঠনের সদস্যদের অনেকেই সরাসরি আবেদনপত্র দিয়েছেন। আমাদের সংগঠনের সদস্যদের আবেদন পড়েছে প্রায় ১৮০০। সংগঠনের বাইরে কতগুলো আবেদন পড়েছে তা জানি না।”
সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি জাতীয় সংসদকে বলেছিলেন, “দেশের অনলাইন সংবাদপত্রের হালনাগাদ কোনও তালিকা সরকারের কাছে নেই। তবে অনলাইন পত্রিকা হিসেবে নিবন্ধনের জন্য দুই হাজার ১৮টি আবেদন পাওয়া গেছে।”
কী করতে যাচ্ছে সরকার?
হাছান মাহমুদ বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কয়েকশ অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখেছে। সরকার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখে আগামী সপ্তাহে অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিবন্ধন দেয়া শুরু করবে।”
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনলাইন মিডিয়া চালু করা হবে। নিবন্ধন ছাড়া কেউ অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালাতে পারবে না। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ অনুযায়ী ইলেকট্রনিক মিডিয়া সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ সেক্টরে কোনো ধরনের অনিয়ম দেখলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
বিদেশি টিভি সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে প্রচারের ক্ষেত্রেও টিভি চ্যানেলগুলোকে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। “পুরো বিষয়টি দেখভালের জন্য একটি রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, সরকার মোবাইল কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স দিয়েছে শুধু মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিচালনার জন্য। অথচ তারা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
“সরকার বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি কাউকে ভিডিও কনটেন্ট করার লাইসেন্স দেয়নি। আমরা এরই মধ্যে এসব বন্ধ করার জন্য টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। আমরা এ সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এ বিষয়ে আইগত ব্যবস্থা নেয়া হবে,” বলেন মন্ত্রী।
এক প্রশ্নের উত্তরে হাছান মাহমুদ বলেন, অনেক সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন চ্যানেল তাদের নিজস্ব অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে ভিডিও কনটেন্ট দেখাচ্ছে। এটিও গ্রহণযোগ্য নয়।
যদিও সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদক এবং টিভি চ্যানেলের মালিকেরা অনলাইন ভার্সন চালু রাখতে আলাদা অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। তাঁরা বছর দুয়েক আগে সরকারকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন।
বনপা’র সাধারণ সম্পাদক বলেন, “যদি এমন হয় যে ৫০ থেকে ১০০টি অনলাইনকে রেজিস্ট্রেশন দিলো, বাকিরা পেল না তাহলে বিষয়টি খুবই হতাশাজনক হবে। আমরা আশা করি সরকার আমাদের হেয় করবে না।”