বৃহস্পতিবার ● ৯ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » করোনা মহামারী- যে প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে এসেছে : সাইফুল হক
করোনা মহামারী- যে প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে এসেছে : সাইফুল হক
সাইফুল হক :: করোনা ভাইরাস কোভিড- ১৯ নামে যা চিহ্নিত তার ভয়াবহ সংক্রমণে প্রায় গোটা বিশ্ব এখন এক বিভীষিকা মোকাবিলা করছে। এই পরিস্থিতি ও এ থেকে উদ্ভুত এই রকম বৈশ্বিক সংকট মানবজাতি আগে আর দেখেনি। জাতিসংঘের মহাসচিব একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আজ যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখন আক্রান্ত দেশ ও অঞ্চল ২০৪টি; মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ; আর গত ৮৬ দিনে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটেছে ৫৬,১৬৯ জনের। অচিরেই আক্রান্তের সংখ্যা যে দ্বিগুণ হয়ে যাবে এবং মৃত্যুর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে- এই আশঙ্কা রয়েছে।
শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও অঞ্চলসহ গোটা দুনিয়ার ছোট বড় অধিকাংশ শহর-নগর-দেশ এখন লকডাউনের আওতায়। ডাক্তার-চিকিৎসাসেবীসহ জরুরী পরিসেবা ব্যতিরেকে জনগণের বড় অংশই এখন ঘরবন্দি। সংক্রমনের বিস্তৃতি ঠেকাতে ঘরে থাকাকেই প্রধান ব্যবস্থাপত্র হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাকেই মূল নিদান হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। মানুষের ইতিহাসে সমগ্র পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনের পর দিন এভাবে ঘরে ফেরা, ঘরে থাকার অভিজ্ঞতাও এই প্রথম। আপনজনদের সাথে এইভাবে সময় কাটানোর এমনতর বাধ্যতামূলক সুযোগও এর আগে তেমন আসেনি। শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের জন্য এই যে একটি বাসযোগ্য ঘর প্রয়োজন, প্রয়োজন নিরাপদ আশ্রয়ের- করোনাকালে এটি আরো মূর্ত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু মানব সভ্যতার কথিত রমরমা অবস্থায়, বিশ্ব যখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তখনও বিশ্বময় জনগণের এক উল্লেখযোগ্য অংশের ঘর নেই, নিরাপদ আশ্রয়ের ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই- তারা কোথায় যাবে, কোথায় তারা মাথা গুজবে ? অভূতপূর্ব এই সংকটকালেও রাষ্ট্র ও সরকারসমূহ কি তাঁদের দায়িত্ব নিচ্ছে ? দায়িত্ব নেবার বিশ্বাসযোগ্য কোন পদক্ষেপ এখনও দৃষ্টিগোচর নয়। আর বাংলাদেশের মত দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষ শ্রমজীবী-মেহনতি-দিনমজুর; দিন এনে যাদের দিন খেতে হয় তারা কি করবে, খাবারের নিশ্চয়তা না দিয়ে তাদেরকে কিভাবে ঘরবন্দী রাখা যাবে ? মহামারী হিসাবে করোনা সংক্রমনের শ্রেণী পক্ষপাত না থাকলেও করোনার এই দুঃসময়ে সমাজে শ্রেণী বিভাজনও আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শ্রমজীবী-মেহনতি-গরীবদের কাছে ইতিমধ্যে করোনা আতঙ্কের চেয়ে ক্ষুধার আতঙ্ক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মিডিয়ায় দেখলাম ঢাকাতেই একজন রিক্সাচালক বলছেন আমরা করোনায় মরবো না, মরবো না খেয়ে। বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই নাজুক হতে শুরু করেছে। অধিকাংশ শ্রমজীবী-মেহনতি স্বল্প আয়ের পরিবারসমূহের কাছে এখনও সরকারের খাদ্য সহায়তাসহ কিছুই পৌঁছায়নি।
গত পাঁচশ বছরেও মানবজাতি অনেকগুলো ভয়াবহ মহামারীর সম্মুখীন হয়েছে। চতুর্দশ শতকে ‘ব্লাক ডেথ’ নামক মহামারীতে ইউরোপের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কেবল গত পঞ্চাশ বছরেই অনেকগুলো মহামারীতে কয়েক কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এসব মহামারীর অধিকাংশই ছিল বিশেষ বিশেষ দেশ ও অঞ্চলভিত্তিক। টিকা, ভ্যাকসিনসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারের মধ্য দিয়ে এসব মহামারী পুরোপুরি দূর করা না গেলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের চেহারা-চরিত্র-রীতিতে, বৈশ্বিক; সংক্রমনের বিস্তৃতি ঘটছে প্রধানত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জ্যামিতিক হারে। বিশ্বায়নের সমগ্র ব্যবস্থা সংক্রমনকে দ্রুত দুই/তিন মাসের মধ্যে গোটা বিশ্বে নিয়ে গেছে; সংক্রমন বিশ্বজনীন চেহারা নিয়েছে। কোভিড- ১৯ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকগুলো দেশের চরম সংরক্ষণবাদী অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলকে কোন আমলে নেয়নি। এখনও পর্যন্ত মহাপরাক্রমে সংরক্ষণবাদী কথিত এসব উন্নত দেশেও করোনা ভাইরাস ধারণার চেয়েও দ্রুত গতিতে তাদের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে।
প্রথমদিকে কোভিড- ১৯ ভাইরাসের উৎপত্তি বিস্তারের জন্য নানাভাবেই চীনকে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই সেদিন পর্যন্ত আক্রমণাত্মকভাবে একে ‘চীনা ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই এটা প্রমাণিত হয়েছে যে চীনাদের কোনরকম সংশ্রব ছাড়াই পৃথিবীর বহু দেশে ও অঞ্চলে এই ভাইরাসের সংক্রমন ঘটেছে। চীন একেবারে শুরুতে এই ভাইরাস নিয়ে দ্বিধা-দোদুল্যমানতায় থাকলেও পরবর্তীতে চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়কে বারবার সতর্ক করার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনসহ অনেকেই এই ব্যাপারে স্বাস্থ্যগত জরুরী পদক্ষেপ নেবার পরিবর্তে একদিকে ‘দেখি না কি হয়’ এই মনোভাব নিয়ে উদাসীনতা প্রদর্শন ও মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে আর অন্যদিকে চীনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে বরং চীন বিরোধী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রচারণায় যুক্ত থেকেছে চীনের দুর্দশায় খানিকটা মজা নেবারও চেষ্টা করেছে।
এই ভাইরাসের সংক্রমন প্রতিরোধে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার নিদেনপক্ষে দুই আড়াই মাস সময় পেয়েছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টা কাজে লাগানো হয়নি। ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে’- এরকম ফাঁকা আওয়াজ আর রাজনৈতিক বুলিবাগিতায় হেলাফেলায় সময় বয়ে গেল। ইতিমধ্যে গোটা ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা দুনিয়ায় সংক্রমণ মহামারীর রূপ নিল। কথিত চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন আর অগ্রগতির ফানুষ রাতারাতি কেমন চুপসে গেল। এভাবেই প্রবৃদ্ধি-মুনাফা আর উদ্দাম ভোগ-বিলাসীতার জগৎটা হঠাৎ কেমন থমকে গেল, কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যু আতঙ্কে আচ্ছন্ন করল, পুঁজিবাদী সমৃদ্ধি আর উন্নয়নের প্রতীক বড় বড় নগরগুলো কিভাবে মৃত্যুপুুরীতে পরিণত হল। এক অজানা শত্রু, অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে যেয়ে সমগ্র রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের কি জেরবার অবস্থা না চলছে; একটি ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে যেয়ে গোটা মানবজাতি তার সভ্যতা, তার উন্নয়নের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন এখন এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী তার অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
করোনা ভাইরাসের এই থাবাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মত শিল্পোন্নত দেশসমূহের গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, ন্যুজ্বতা আর বেহাল দশার আসল চেহারার খানিকটা সামনে নিয়ে এসেছে। এই ধরনের সম্ভাব্য মহামারীজনীত দুর্যোগ মোকাবেলায় বিদ্যমান মুনাফানির্ভর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা যে নিতান্তই ভংগুর এবার চোখে আগুন দিয়ে তা দেখিয়ে দিল। কেবল যুদ্ধাস্ত্র তৈরীসহ সমর অর্থনীতিতে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে বিনিয়োগ ও মুনাফা তার কত শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ-এসব প্রশ্ন এখন আটলান্টিক মহাসাগরের দু’পারেই জনমনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্যসহ ব্যক্তি ও পরিবারের এসব ন্যূনতম নিরাপত্তাই যদি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ফাকা উন্নয়নের আলোকছটা দিয়ে কি হবে; চরম বৈষম্যমূলক একরৈখিক কথিত উন্নয়নের জোয়ার তো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক শ্রেণুজীব, বীজানুর আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারছে না। এক কোটিরও কম মানুষের দেশ ছোট্ট কিউবা স্বাস্থ্যসেবায় গোটা বিশ্বে অনুকরণীয় অসাধারণ উদাহরণ তৈরী করে চলেছে। সুস্থ্য জীবন-সুস্থ্য মানুষ যে মানবজাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ মার্কিনীদের টানা অবরোধের মধ্যে থেকেও কিউবা গত ছয় দশক ধরে তা প্রমাণ করে চলেছে। এই মুহুর্তে বিশ্বের ৫৭টি দেশে কিউবার ডাক্তার আর চিকিৎসাসেবীরা তাদের আন্তর্জাতিক বিপ্লবী দায়িত্ব পালন করে চলেছে। চীনেও উহানের মানুষের সচেতনতা, দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলার সাথে যুক্ত হয়েছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও হস্তক্ষেপ; যে কারণে করোনা যুদ্ধে এখন তারা অনেকটাই বিজয়ী।
করোনা ভাইরাস সংক্রমনকে বিদ্যমান উন্নয়ন নীতি কৌশল আর কথিত সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রকৃতির পুঞ্জিভূত প্রতিশোধের বহিঃপ্রকাশ হিসাবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। বহু শতাব্দী ধরে, বিশেষত: শিল্প বিপ্লবের পর থেকে উন্নয়নের কথা বলে প্রাণ, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যকে যেভাবে বিনাশ করা হয়েছে; মাটি, পানি, বাতাসকে যেভাবে বিষাক্ত করা হয়েছে; সমরশিল্পের বিকাশের জন্য যেভাবে গত কয়েক দশক ধরে প্রাণঘাতি জীবানু অস্ত্র বা জৈব মারণাস্ত্র তৈরী করা হচ্ছে তার সাথে কোভিড- ১৯সহ সাম্প্রতিক দশকসমূহের মহামারীর জীবানুর সম্পর্কের কথাই নানাভাবে বেরিয়ে আসছে। বর্তমান সংকট থেকে প্রচলিত উন্নয়ন দর্শনের পরিবর্তনের প্রশ্নটা অনেক গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে।
গত তিন মাসেই প্রকৃতিতে প্রাণ, জীববৈচিত্র্য, বায়ুমণ্ডলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে কার্বন নিঃসরণ এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে; বাতাসে দুষণ হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। বর্জ্য হ্রাস পেয়েছে। প্রকৃতির নানা প্রজাতি প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। এই পরিবর্তন ধরে রাখতে না পারলে আবার ঘোর বিপদ। এই পর্ব রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শেষ করি ‘বিশ্ব প্রকৃতির সাথে ভাব করার একটা মস্ত সুবিধা এই যে, সে আনন্দ দেয়, কিন্তু কিছু দাবি করে না। সে তার বন্ধুত্বকে ফাঁসের মত বেঁধে ফেলতে চেষ্টা করে না, সে মানুষকে মুক্তি দেয়, তাকে দহন করে নিতে চায় না’।