বৃহস্পতিবার ● ১৬ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » কুষ্টিয়া » কুষ্টিয়ায় ৪২ হাজার দুস্থ পরিবারের নামে, ১৩০০ টন চাল ডিলারদের গুদামে
কুষ্টিয়ায় ৪২ হাজার দুস্থ পরিবারের নামে, ১৩০০ টন চাল ডিলারদের গুদামে
শামসুল আলম স্বপন, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি :: করোনাভাইরাসে কর্ম হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করা কুষ্টিয়ার ৪২ হাজার দুস্থ পরিবারের নামে বরাদ্দ এক হাজার ২৮১ টন সরকারি চাল ১২ দিন ধরে পড়ে আছে ডিলারের গুদামে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী জেলার কয়েক লাখ শ্রমজীবী ও হতদরিদ্র পরিবারে চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার।
হতদরিদ্ররা ত্রাণের আশায় দিনভর ধরনা দিচ্ছেন সরকারি দফতরে। জেলার সাড়ে ৫ লাখ শ্রমজীবী ও হতদরিদ্র মানুষ মাঝে সরকারিভাবে এ পর্যন্ত মাত্র ৪০ হাজার প্যাকেট খাদ্য সহায়তা বিতরণ করেছেন জেলা প্রশাসন। অথচ বিতরণ না করে ডিলারদের গুদামে মজুদ করে রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ সরকারি চাল।
এমন সংবাদের ভিত্তিতে দুই ডিলারের গুদামে অভিযান চালায় পুলিশ ও র্যা ব সদস্যরা। তারা দুই গুদামেই শত শত বস্তা সরকারি চাল দেখতে পান। ডিলাররা দাবি করেন, সরকারি নিয়ম মতে তারা এপ্রিল মার্সের ২ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে চাল উত্তোলন করেছেন। কিন্তু তাদেরকে এখনই চাল বিতরণ করতে নিষেধ করেছেন।
মৌখিকভাবে তাদেরকে এপ্রিলের ২০ তারিখের পরে চাল বিতরণ করতে বলেছেন। এসব চাল উত্তোলন করে গুদামে মজুদ করে রাখা হয়েছে। একই কথা বলেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা।
তাই অভিযানে হাতেনাতে ধরেও কোনো পদক্ষেপ না নিয়েই ফিরে আসতে হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। ১১ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ডিলারের গুদামে কয়েকশ বস্তা সরকারি চাল মজুদ করে রাখা হয়েছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। সেখানে ডিলারের ঘরে ১৯০ বস্তা সরকারি চাল মজুদ দেখতে পান তারা।
ডিলার রাসেল আহমেদ বলেন, আমার কোনো দোষ নেই। ৫ এপ্রিল চাল উত্তোলন করেছি। কিন্তু অনুমতি না দিলে কীভাবে বিতরণ করব। অভিযানের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিংকন বিশ্বাস ও উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিনসহ খাদ্য বিভাগের লোকজন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তারা গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যদের অবগত করেন ডিলারের কোনো অপরাধ নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আপাতত ফেয়ার প্রাইসের চাল বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। ২০ তারিখের পরে এসব চাল বিতরণ করা হবে। এসময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিংকন বিশ্বাস জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিমাণ সরকারি সহায়তাসহ ওএমএসের চাল বিতরণ করা হচ্ছে।
পরবর্তীতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এমন চিন্তা করে জেলা প্রশাসক কিছুদিন পরে এই চাল বিতরণ করতে বলেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর খাদ্যবান্ধব বিশেষ প্রকল্প ফেয়ার প্রাইসের ১০ টাকা কেজির চাল পাবেন ইউনিয়নভিত্তিক কার্ডধারী দুস্থ পরিবার। খাদ্যবান্ধব এই কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীরা বয়স্কভাতা,
বিধবাভাতা কিংবা ওএমএসসহ কোনো সুবিধা নিতে পারবেন না। কুষ্টিয়ার ৬ উপজেলায় বর্তমানে কার্ডধারী দুস্থ পরিবারের সংখ্যা ৪২ হাজার ৭২৩ জন। একই ঘটনা ঘটেছে ১৩ এপ্রিল রাতে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের ভাই ইউনিয়নের ফেয়ার প্রাইস চালের ডিলার কামাল মণ্ডলের গুদামে বিপুল মজুদ করে রেখেছে।
খবর পেয়ে রাতেই অভিযান চালায় কুষ্টিয়া র্যা ব-১২ এর সদস্যরা। সেখানে যেয়ে র্যা ব সদস্যরা চারশত বস্তা সরকারি চাল মজুদ অবস্থায় দেখতে পান। স্থানীয় ডিলার কামাল মণ্ডল জানান, ২ এপ্রিল তিনি চাল উত্তোলন করে গুদামে নিয়ে আসেন। কিন্তু জেলা থেকে তাকে বিতরণের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। তাই ১২ দিন ধরে তার গুদামে এই চাল পড়ে আছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনোয়ার হোসেন জানান, এতে খাদ্য বিভাগের কিছুই করার নেই। জেলার কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তে বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে এখন বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়ার ৬ উপজেলায় ১০৮ জন ডিলারের মাধ্যমে ইউনিয়নভিত্তিক কার্ডধারী এসব দুস্থ পরিবারের মাঝে এসব চাল বিতরণ করা হয়।
এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৯ হাজার ১২৫ কার্ডধারী দুস্থ পরিবারে মাঝে চাল বিতরণ করেন ২৪ জন ডিলার, কুমারখালী উপজেলায় ১৪ হাজার ৩৪২ পরিবারে বিতরণ করেন ৩৩জন ডিলার। খোকসা উপজেলায় ৪ হাজার ২৩৫ পরিবারের মাঝে বিতরণ করেন ৯ জন ডিলার,
ভেড়ামারা উপজেলায় ৮ হাজার ১৩৯ পরিবারে ১৫জন ডিলার, মিরপুর উপজেলায় ৪ হাজার ১১০ পরিবারে বিতরণ করেন ১৩ নজন ডিলার এবং দৌলতপুর উপজেলায় ২ হাজার ৭০২ জন কার্ডধারী দুস্থ পরিবারের মাঝে চাল বিতরণ করেন ১৪ জন ডিলার। প্রতিবছর মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বছরে ৫ বার ১০ টাকা কেজিতে প্রতি পরিবারে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। সরকারি সিদ্ধান্ত মতে,
প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে এসব চাল ডিলারদের উত্তোলন করে সপ্তাহের রোববার মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার তিনদিন কার্ডধারী উপকারভোগীদের মাঝে বিতরণ করতে হবে। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, জেলার সব ডিলারদের দুই-তিনদিনের মধ্যে চাল বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কোনো ডিলার দ্রুত সময়ের মধ্যে চাল বিতরণ না করলে তার কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। চাল নিয়ে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না।