শনিবার ● ১৮ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » আন্তর্জাতিক » কোভিড-১৯ নিয়ে ডক্টর পার্থসারথী রায় এর সাক্ষাৎকার
কোভিড-১৯ নিয়ে ডক্টর পার্থসারথী রায় এর সাক্ষাৎকার
COVID-19 বিশ্বমহামারী আটকাতে WHO যে ক’জন বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছেন* তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (IISER, Kolkata)-এ কর্মরত Associate Professor *ডক্টর পার্থসারথী রায়।*
COVID-19 নিয়ে তার দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন *ভারত এই ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য বুঝতেই পারেনি এবং সম্ভাব্য আক্রান্তদের পরীক্ষা করার দিক দিয়ে এখনও পিছিয়ে রয়েছে*। ‘The Week’ নামক অনলাইন পত্রিকায় দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি এখানে রইলো ~
*প্র:* COVID-19 এলো কোথা থেকে? এব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যায় কি?
উ: এটি একটি জুনোটিক ভাইরাস। মানে প্রাণীদেহের ভাইরাস। সংক্রমণের উৎপত্তি চীনের উহান প্রদেশের বন্যপ্রাণী শরীর। *কোভিড-১৯ জেনেটিক মিউটেশন করতে পারে*। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে পালটে পালটে নেয়। তাই শুধুমাত্র একটি নয়, বিভিন্ন আলাদা আলাদা প্রজাতির প্রাণীদের সংক্রমণের ক্ষমতা রাখে। এক্ষেত্রে ভাইরাসটি এমনভাবে নিজেকে পালটেছে যে, মানবদেহের নির্দিষ্ট কোষের প্রোটিনের সাথে আবদ্ধ হতে পারে। ফলে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারছে।
*প্র:* কোন কোন প্রাণীর COVID-19 সংক্রমন হতে পারে?
উ: গবেষনা বলছে, মানবদেহে সংক্রমণকারী ভাইরাসের সঙ্গে বাদুড় সংক্রমণকারি ভাইরাসের জিনগত মিল ৯৬%, আর প্যাংগোলিন সঙ্গে মিল ৯৯%। বলা যায় এই ভাইরাস বাদুড় থেকে প্যাংগোলিন হয়ে মানুষের দেহে এসেছে। এরপর এই ভাইরাস আর কাকে কাকে আক্রমণ করবে সেটা জানতে আরও গবেষণা দরকার।
*প্র:* WHO কেন বিশ্ব-মহামারী বলছে?
উঃ কোনো একটি অসুখের মারণক্ষমতা এবং সংক্রামক ক্ষমতা দুটো আলাদা জিনিস। *সাধারণত যে ভাইরাসের মারণক্ষমতা অত্যন্ত বেশি সেই ভাইরাস বিরাট একটা সংক্রামক হয় না, অপরপক্ষে যে ভাইরাস অতিরিক্ত সংক্রামক তাতে আবার খুব বেশি মানুষ মারা যায় না।* যেমন ২০০৩-এর সার্স ভাইরাসে মৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল। কিন্তু তাতে বেশি মানুষ সংক্রামিত হননি। এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী সকলকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা রাখে।
*প্র:* আপনি বলতে চাইছেন, করোনা (কোভিড-১৯) মারন ভাইরাস নয়?
উ: একদমই না। কেবলমাত্র বয়স্ক মানুষ এবং আগে থেকে অন্য গুরুতর অসুখে ভোগা মানুষের জন্যই এ মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
*প্র:* WHO তো বলেছে আমাদের এই ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে!
উ: একদমই তাই। আমরা কি আমাদের চারপাশে টিবি বা ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে বেঁচে নেই? এ হল Attenuation process। হীনবল হতে হতে টিকে যাওয়া। যেসব মানুষ সংক্রামিত, তাদের মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসটাও মারা যায়। ফলে অন্যদের সংক্রামিত করার ক্ষমতাও আর থাকে না। তাই ভাইরাসও সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের পরিবর্তন (মিউটেশন) করে টিকে থাকে কিছু কিছু জায়গায়। একে *Endemic* বলে। মাঝে মাঝে এটি আবার ফেটে পড়ার মতো বেশ খানিকটা ছড়ায়। তখন কম ইমিউন, খেতে না পাওয়া, অসুস্থ, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষদেরই কেবল মারা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ভাইরাসগুলোর মারণক্ষমতা কম কিন্তু ফিরে আসার ক্ষমতা প্রবল।প্রশ্ন হল, মানুষ কেন আজও না খেতে পেয়ে অপুষ্টির জন্য মরবে? সরকারগুলি অপুষ্টি আটকাতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
*প্র:* আচ্ছা আপনি কিভাবে WHO কে সাহায্য করেছেন?
উ: এটি উহানে যখন ছড়াতে শুরু করল, হু পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছে। আমার সঙ্গেও কথা বলেছে।
*প্র:* কী বুঝতে চাইছিল হু?
উ: অসুখটার গতিপ্রকৃতি মূলত। কতগুলো রকমফেরে নিজেকে ছড়াতে পারে; যদি মিউটেট করে তাহলে কেমন আকার নেবে; একে বলে জিনোটাইপ সংক্রান্ত বোঝাপড়া।
*প্র:* জিনোটাইপ জানার দরকার কেন?
উ: পৃথিবীতে COVID-19-এর টীকা আর ওষুধ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। মুশকিল হল *নির্দিষ্ট টীকা বা ওষুধ কেবল নির্দিষ্ট জিনোটাইপ এর ওপরেই কাজ করতে পারে,* অন্যান্যদের ক্ষেত্রে নয়।
*প্র:* কতগুলো COVID-19 জিনোটাইপ এখনো পাওয়া গেছে?
উ: গোটা পৃথিবীতে মোট উনত্রিশটা। দুর্ভাগ্যবশত ভারতে আমরা মাত্র দুটো পেয়েছি, বাকি জিনোটাইপগুলো খোঁজার চেষ্টাও হচ্ছে না ঠিকমতো। এখানে শুধু মানুষের মুখে লকডাউনের মতো মুখরোচক কথার ফুলঝুরি ছুটছে।
*প্র:* এই দুটো জিনোটাইপ নিয়ে যদি একটু বলেন–
উ: আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। যেখানে WHO সারা বিশ্বের একটা বড় অংশ থেকে নমুনা পরীক্ষা করে উনত্রিশটা করোনা ভাইরাস জিনোটাইপ খুঁজে পেয়েছে, ভারতে আমরা মাত্র দুটো নমুনা থেকে দুটোই মাত্র জিনোটাইপ পেয়েছি। ভারতে এই ভাইরাস সম্বন্ধে বোঝাপড়া এখনো সেভাবে কিছুই গড়ে ওঠেনি। ফলে এই সংক্রমণকে আটকানোর ব্যাপারেও একেবারে বিশবাঁও জলে পড়ে আছি আমরা।
*প্র:* তাহলে কী মলিকিউলার বায়োলজিস্টরা এই লকডাউনকে সাপোর্ট করেন না?
উ: আমি শুধু আমার কথাটাই বলতে পারি। আমার মতে এই লকডাউন পিরিয়ডকে কাজে লাগিয়ে যদি সংক্রমণ খুঁজে পাওয়ার কোনো চেষ্টাই না করা হয়, যদি সম্ভাব্য আক্রান্তদের পরীক্ষাই না করা হয় তাহলে কোনো লাভ নেই। আমরা কি তা করছি? না! আক্রান্তদের বাড়িতেই আটকে রেখে দিচ্ছি, তাতে তাদের বাড়ির লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। যদি অসুস্থতার লক্ষ্মণগুলো দেখা যায় তবেই হাসপাতালে যাচ্ছেন। কিন্তু 65% লোকের তো কোনো রোগ-লক্ষণই দেখা দেবে না। লকডাউন শেষ হলে এই লোকগুলোই বয়স্ক এবং অন্যান্য রোগে ধুঁকতে থাকা মানুষদের সংক্রামিত করবে আর ভাইরাসটি আবার মাথা চাড়া দেবে।
1918 সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিতে ঠিক এইভাবে দ্বিতীয় বারের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।
*প্র:* তাহলে সরকার কেন লকডাউন ঘোষণা করলো?
উ: সেটা তো সরকারই জানেন। হয়তো খানিকটা ভয় থেকে আর খানিকটা টেস্ট এড়াবার জন্য। WHO বারবার জোর দিয়েছে যত বেশি সম্ভব টেস্ট করা যায় তার ওপর। ভারতের উচিত ছিলো এই রোগের *ফাউন্ডার পপুলেশন* (যারা প্রথম এই রোগকে এদেশে নিয়ে আসে) কে আলাদা করে আইসোলেশনে রাখা।
*প্র:* তাহলে স্পেন, ইতালি আমেরিকা নিয়ে কী বলবেন?
উ: না না ইতালি, আমেরিকা বা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে এক করে ফেলবেন না। ওই দেশগুলোর বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ। ইতালির ৬৫℅লোক ষাটোর্ধ্ব। তাই মৃতের সংখ্যাও ওই দেশগুলোতে বেশি। ইতালির বর্ণাঢ্য টুরিসম ব্যবসার ক্ষতি হবার কথা ভেবে ওরা বিদেশি টুরিস্টদের আটকায়নি।
*প্র:* কিন্তু ওরাও তো এখন লকডাউন ঘোষনা করেছে–
উ: সেটা টেস্টিং এর জন্য। ওরা সাময়িক লকডাউন করেছে সন্দিগ্ধ আক্রান্তদের টেস্ট করার জন্য। আর হাসপাতাল, বেড ভেন্টিলেশন এই ব্যবস্থাগুলো ঠিকঠাক করে গড়ে তুলতে, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য দরকারি সুযোগসুবিধা দিতে। লকডাউন সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু দেয় যাতে ঠিকঠাক টেস্টিং আর এই স্বাস্থ্যসেবার পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়।
*প্র:* আপনার কি মনে হয় ভারত এগুলি কিছুই করেনি?
উ: একদমই করেনি। ইতালি প্রতি দশ লক্ষে পাঁচ হাজার জনের টেস্ট করিয়েছে ভারত মাত্র আঠারো। যদি আমি টেস্ট না করাই, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, আই সি ইউ- এর ব্যবস্থা না করি, স্বাস্থকর্মীদের বন্দোবস্ত না করি তাহলে লকডাউনের লাভটা কি?
*প্র:* কিন্তু আমাদের হাতে তো প্রয়োজনীয় সংখ্যায় টেস্ট কিট নেই?
উ: এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। আমাদের দেশে দশ হাজার এরকম ল্যাব আছে যেখানে টেস্টিং সম্ভব।
*প্র:* এটা কীভাবে সম্ভব?
উ: আক্রান্ত হয়েছে এমন একজনের রক্তের নমুনা লাগবে আমাদের আর যাদের সম্ভাবনা আছে হবার তাদের রক্ত লাগবে। আমরা জিন মিলিয়ে দেখে নিতে পারব। এটা হাজার টাকা বা তারও কমে হতে পারে। ঘটনাচক্রে দু’সপ্তাহ আগেই আমরা IISER এ এই টেস্টটার খরচ হিসেব করছিলাম, যা দেখলাম তাতে মোটামুটি সাতশো টাকার কাছাকাছি লাগবে।
*প্র:* কিন্তু এই টেস্ট কতটা ভরসাযোগ্য?
উঃ মার্কেটে যে ভুলভাল অনিশ্চিত কীট চলছে তার থেকে অনেক বেশি। আমি *শুনে অবাক হলাম, সরকার টেস্ট প্রতি সাড়ে চার হাজার টাকা ঠিক করেছে*। আর কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানিকেই এর বরাত দেওয়া হয়েছে। ভেবে অবাক লাগে এই দুর্দিনেও কেমন কিছু লক্ষ-কোটিপতিদের পয়সা কামিয়ে নেবার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
*প্র:* আপনারা সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন?
উঃ সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই। আমাদের ল্যাবগুলো বিশ্বের অনেক দেশের ল্যাবের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। এমনকি WHO আমাদের রিসার্চ এর ওপর ভরসা করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত না কেন্দ্র না কোনো রাজ্য সরকার, কেউ আমাদের সাথে আলোচনা করেনি।
*প্র:* কিন্তু ভারত তো WHO এর গাইডলাইনই ফলো করছে–
উ: *WHO বলেছে আইসোলেটেড রাখো এবং টেস্ট করো*। কোত্থাও বলেনি লকডাউন করতে। *ভারত লকডাউন করেছে কিন্তু টেস্টিং করছে না*। যদি টেস্ট না করা হয় আমরা ভাইরাসের আলাদা আলাদা ভ্যারাইটি আর আলাদা আলাদা মিউটেশনগুলোর কথা জানতেই পারব না।”
উল্লেখ্য ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল কোলকাতায় বস্তি উচ্ছেদের প্রতিবাদে পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি করার অপরাধে মমতা সরকারের পুলিশ এই বিজ্ঞানী কে গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও তার মুক্তির দাবীতে নোয়াম চমস্কি সহ বিশ্বখ্যাত দার্শনিক বিজ্ঞানীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পত্র দিলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। সূত্র : Khairul Khan, Muhammad Hilaluddin টাইম লাইন থেকে সংগ্রহীত।