রবিবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » ব্রাম্মণবাডিয়া-লকডাউন কিছু জরুরী প্রশ্ন : সাইফুল হক
ব্রাম্মণবাডিয়া-লকডাউন কিছু জরুরী প্রশ্ন : সাইফুল হক
সাইফুল হক :: ব্রাম্মণবাডিয়ায় লকডাউন উপেক্ষা করে গতকাল শনিবার সকালে খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নেতা মওলানা জোবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাযায় লক্ষাধিক মানুষ অংশ নেয়ায় প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় দিনভর সংগত কারনেই বিভিন্ন মহলের গভীর উৎকন্ঠা আর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদেই যে বাধাহীন ভাবে এই জমায়েত অনুষ্ঠিত হতে পেরেছে তা না বোঝার কারন নেই।সরকার চাইলেও যে এই জমায়েত বন্ধ করতে পারত এরকম নয়।
সরকারের ঘোষণা ও লকডাউন উপেক্ষা করে অনেক গারমেন্টস কারখানা খোলা ছিল না ? করোনা সতর্কতাকে পাত্তা না দিয়ে এখনো হাজার হাজার গারমেন্টস শ্রমিক বকেয়া বেতন - ভাতার দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ করছে না? লকডাউন ভেংগে জীবন আর জীবিকা বাঁচাতে সারাদেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী - দিনমজুরদেরকে বাইরে বের হতে হচ্ছে না ? হাট- বাজার, বন্দর আর গঞ্জে হাজার হাজার মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে না ? তারা কি বলছে না, “করোনায় মারা যাবার আগে আমরা তো না খেয়েই মারা যাব”; এটা কি নিছক কথার কথা!
প্রধানমন্ত্রী গতকাল (শনিবার ১৮ এপ্রিল-২০২০) জাতীয় সংসদে বাস্তবতা তুলে ধরে বলেছেন “মানুষ ঘরে থাকার নির্দেশণা মানতেই চায় না”। ঘরে থাকার নির্দেশনা মেনে চলার জন্য কয়েক কোটি মানুষের খাদ্য ও নগদ টাকার যোগান দরকার। এখনো অব্দি এই রকম অধিকাংশ পরিবারের কাছে তেমন কিছু পোঁছায়নি। সকলের দাবি সত্বেও পরিস্থিতিকে “জাতীয় দুরযোগ” ঘোষণা করে যুদ্ধকালীন অবস্থার মত সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সমন্বিত কোন পদক্ষেপ নেই। বিরোধীদের যৌক্তিক দাবিসমূহকেও উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সারাদেশ করোনা ঝুঁকিপূর্ণ - এই রকম ঘোষণা দিতেই ৪০ দিন লেগে গেল।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের ‘ বডিল্যাংগুয়েজ’ কি বলে ? তারা কি মানুষকে সচেতন করতে, বোঝাতে ব্য অনুপ্রাণিত করতে পারছেন?কোভিড -১৯ এর মত একটা অদৃশ্য ভয়ংকর শত্রুকে পরাজিত করতে যে আগ্রাসী কর্মকান্ড দরকার তাও অনুপস্থিত। লকডাউন কার্যকরি করতে জনসমাজের বিভিন্ন অংশের সাথে সরকারের যে সংলাপ প্রয়োজন তার তো ছিটেফোঁটাও নেই।একটা জরুরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানুষকে বাধ্য ও যুক্ত করতে সরকারের যে নৈতিক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা দরকার তাওতো একেবারে তলানিতে।
ব্রাম্মনবাডিয়ায় মওলানা জোবায়ের এর জানাযা কেন্দ্র করে করোনার সামাজিক সংক্রমণ এডাতে স্থানীয় প্রশাসন জানাযার আয়োজকদের সাথে আলোচনা সহ কার্যকরি ভূমিকা নিতে পারেনি সত্য,কিন্তু প্রচেষ্টা নিলেও যে তারা খুব সফল হতেন তা বলা যায় না।জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ব্রাম্মনবাডিয়া - ৩ আসনের সাংসদ উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বক্তব্যে বাস্তবতা উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন “এটার জন্য আমরা সকলে দায়ী। রাজনীতি, প্রশাসন, সামাজিকসহ সব জায়গা থেকে আমরা দায়ী” (প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল)।
জানাযার আয়োজক ও ভক্তদের কূপমন্ডুকতা, পশ্চাৎপদতা ও আবেগ নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম তোলপাড়। কিন্তু এই ভক্তরাসহ দেশের মানুষের এক বড় অংশ করোনা ভাইরাসকে ‘আল্লাহর গজব হিসাবে দেখছেন’।তারা বিশ্বাস করে ‘জমিনের বালা জমিনে যাবে,আসমানের বালা আসমানে যাবে’।তাদের এক বড় অংশ শহুরে শিক্ষিত মানুষদের মত এসব সংক্রমণ নিয়ে এতটা চিন্তিত নন।
এই মানুষদের সাথে রাষ্ট্র, সরকার, জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রযুক্তির সম্পর্কটা কি,আমাদের কথিত নাগরিক সমাজ,বুদ্ধিজীবী বা শিক্ষিত ও সচেতন মানুষদের সাথে,অধিকাংশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন- সংগঠনের সাথে এদের সম্পর্ক কি,তাদের সাথে সংলাপের ধরনটাই বা কি….এসব জরুরী প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে বোধ করি আমরা জানাযায় অংশ নেয়া মানুষের মন-মানসিকতার তল খুঁজে পাব না।আর মানুষ তাদের বিশ্বাস, ভক্তি আর আবেগের কারনে কিভাবে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে ইতিহাসের এই আবশ্যিক অভিজ্ঞতাও বিবেচনায় রাখা দরকার।
একটা চরম কতৃত্ববাদী দমনমূলক শাসনে পশ্চাৎপদ কূপমন্ডুক নিয়তিবাদী মনন কিভাবে গডে উঠে,প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কিভাবে তার শেকড় এর বিস্তার ঘটায়, শাসক দলসমূহ ক্ষমতায় টিকে থাকতে যখন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করে- এসব দরকারী প্রশ্ন বাদ দিয়ে ব্রাম্মণবাডিয়া,সাতক্ষীরা, বগুড়া বা চট্টগ্রামকে বোঝা যাবে না।এ সবের ফয়সালা যত দেরী হবে ততই আমরা নতুন নতুন ব্রাম্মণবাডিয়ার মুখোমুখি হব।
লেখক : কমরেড সাইফুল হক, সাধারন সম্পাদক, বংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।