শুক্রবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » করোনা কালের দুর্যোগ-অর্থনীতির অশনী সংকেত
করোনা কালের দুর্যোগ-অর্থনীতির অশনী সংকেত
সাইফুল হক :: প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস কোভিড- ১৯ খুব দ্রুতই বৈশ্বিক চেহারা নিয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসে আর কোন ভাইরাস এত দ্রুত মহাদেশ থেকে মহাদেশে, সাগর আর মহাসাগরের কূলে কূলে এভাবে আছড়ে পড়েনি। রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের নানা ধরনের অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ আইন, বায়োমেট্টিকস ও ডিজিটাল নজরদারির সকল ধরনের বাধা – নিষেধ উপেক্ষা করে আশঙ্কার চেয়েও দ্রুতগতিতে সংক্রমনের বিস্তার ঘটিয়েছে। বিশ্বায়নের সাথে এই সংক্রমন বিস্তারের যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে তা অত্যন্ত স্পষ্ট। বিশ্ব অর্থনীতির সাথে বেশী বেশী সম্পৃক্ত এবং আন্তঃরাষ্ট্র ও আন্তঃমহাদেশীয় অর্থনীতি-রাজনীতির পিঠস্থান নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ, রোম, টোকিও, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি নগর-মহানগরসমূহ দ্রুতই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কোভিড- ১৯ এর সাথে কর্মসংস্থান, আয়, দারিদ্র্য ও না খাওয়া অবস্থার সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও করোনা সংক্রমনের অভিঘাতে এখন স্বাস্থ্যগত দুর্যোগের পাশাপাশি অর্থনৈতিক দুর্যোগও ক্রমে ভয়াল চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হতে চলেছে।
করোনা ভাইরাসের প্রতিক্রিয়ায় ইতিমধ্যে শক্তিশালী অর্থনীতি বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালী, জার্মানী, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে সামষ্টিক অর্থনীতি গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। খানিকটা তছনছ হতেও শুরু করেছে। করোনা ঝুঁকি মোকাবেলা ও অর্থনীতির সাইকেল সচল রাখতে সরকারসমূহকে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে এই এপ্রিলেই এক কোটি লোকের বেকার হয়ে যাবার পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহেও এর মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হতে শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে ৫৫০ কোটি ডলারের জরুরী তহবিল ঘোষণা করেছে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ফিলিপাইনের মত দেশসমূহের পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক।
করোনা সংক্রমন প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের প্রতিক্রিয়ায় এসব দেশে কর্মহীনতা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, না খাওয়া এর মধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে। সংক্রমনজনিত পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে এসব দেশসহ দুনিয়ার অনেক অঞ্চলে খাদ্য সংকট-দূর্ভিক্ষাবস্থার মত মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টিফানো জর্জিয়েভা বলেছেন করোনা মহামারীর প্রভাবে ১৭০টি দেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে। আর অক্সফাম সতর্ক করে বলেছে, এই পরিস্থিতি নতুন করে ৫০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেবে। আর করোনার প্রভাবে সারা দুনিয়ার ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের মত ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে।
করোনা মহামারী ইতিমধ্যে উৎপাদন (বিশেষতঃ শিল্প উৎপাদন), বিপণন, সরবরাহ, বিনিয়োগ, পুনঃর্বিনিয়োগ এর ধারা ও গতিকে অনেক দেশেই রুদ্ধ ও উল্টো-পাল্টা করে দিয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির এই স্বাভাবিক চেইন দুর্বল ও ভঙ্গুর হতে শুরু করেছে। দ্রুত মুনাফা নির্ভর পুঁজিবাদের কথিত মুক্তবাজার কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল আবারও নানা দিক থেকেই সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
অর্থনৈতিক এই মন্দা ১৯৩০ এর ‘মহামন্দা’ বা ২০০৮ এর অর্থনৈতিক ধ্বসকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। ১৯৩০ এ ‘নিউ ডিল’ এর কথিত ‘ষ্টিমুলাস প্যাকেজ’ এর আওতায় মন্দার সর্বগ্রাসী ধ্বস সামলে দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে আবার প্রাণের সোচ্চার করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে এসে বিশাল বিশাল ‘বেল আউট’ কর্মসূচি ও আর্থিক প্রণোদনায় বিলিয়ন-বিলিয়ন অর্থ ঢেলে অর্থনীতিতে আবার গতি সঞ্চার করতে হয়েছিল। কথিত ‘মুক্ত বাজার ব্যবস্থার’ উপর ছেড়ে দিয়ে এই গভীর মন্দার নিদান ঘটেনি। এই দুই গভীর মন্দার মাঝেও যখনি বাজার অর্থনীতি সংকটে ডুবেছে তখনই ঘুরে-ফিরে রাষ্ট্রকেই আবার এসে ত্রাতার ভূমিকা নিতে হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার সমালোচনা করার পরও পুঁজিবাদী বিশ্বকে আবার এক ধরনের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার মধ্যেই উঠে দাঁড়াতে হয়েছে।
করোনা ভাইরাসজনীত সংক্রমন মোকাবিলায় বড় বড় পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে এখন অভূতপূর্ব ‘লকডাউন’ চলছে। লক্ষ লক্ষ কারখানা, শিল্প-বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, শেয়ার মার্কেটসহ অর্থনৈতিক প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ, ইন্টারনেটসহ নানা ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি, আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, ম্যাশিন লার্নিং, উন্নত ও ক্ষীপ্রগতির সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভৃতির মাধ্যমে একদিকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম খানিকটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে। কিন্তু করোনাকাল দীর্ঘায়িত হলে সমগ্র অর্থনৈতিক সংকট যে গভীর থেকে আরো গভীরতর হবে তা অনুমান করা মোটেও কঠিন নয়।
এমনিতেই পুঁজি তার সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন বা প্রবৃদ্ধি ছাড়াই মুনাফার পথে হাঁটছিল। এসবের মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে ক্রমান্বয়ে পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটছিল। এখন কি হবে ? কলকারখানা-শিল্প প্রতিষ্ঠান, পণ্যের উৎপাদন-বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়, অভ্যন্তরীণ, আন্তর্দেশীয় বা আন্তর্মহাদেশীয় বাণিজ্য হ্রাস পেলে একদিকে যেমন দেশজ উৎপাদন হ্রাস পাবে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে হাতে নগদ টাকা না এলে পণ্য বা সেবার চাহিদা সংকুচিত হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকানড খর্বকায় হয়ে যাবে, সৃষ্টি হবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বহুমুখী সংকট।
অক্সফাম এর এক তথ্য অনুযায়ী ২০০৬-২০১৫ অব্দি শ্রমজীবীদের আয় বেড়েছে বছরে মাত্র ২ শতাংশ। আর এই সময়কালে কোটিপতিদের সম্পদ বেড়েছে ছয়গুণ। পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করতে যেয়ে আগ্রাসী পুঁজি পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্ব আরো জোরদার করেছে। জাতিসংঘের সংস্থা আইপিবিইএস এর ২০১৯ এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাক শিল্প বিপ্লবের যুগের তুলনায় বিশ্বে ১০ লক্ষ অতিক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রজাতি এখন বিলুপ্তির পথে। দীর্ঘকাল ধরে প্রকৃতির যে জৈব-অজৈব রক্ষাকবচ মনুষ্য প্রজাতিকে সুরক্ষা দিয়ে আসছিল তা এখন গুরুতর হুমকির মুখে। প্রচলিত ধারার শিল্প-সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের সাথে এর যে সম্পর্ক রয়েছে তা সচেতন কারই অজানা নয়। সার্স, মার্স, ইবোলা ও করোনা ভাইরাসসমূহ যে এই পরিস্থতিতে তার জন্ম ও বিস্তৃতি ঘটাতে পারছে তা নিয়েও সন্দেহের বিশেষ কোন অবকাশ নেই। করোনা পরবর্তী দুনিয়া তার শিল্পায়ন ও উন্নয়ন দর্শন ও কৌশল নির্ধারণে এসব অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেবে কিনা সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসাবে থাকছে।
করোনা মহামারীতে সর্বগ্রাসী দুরাবস্থা কর্মসংস্থানের বিশাল সংকট, বিপুল বেকারত্ব, দারিদ্র ও না খাওয়া পরিস্থিতিকে যে ক্রমে মারাত্মক করে তুলবে তা স্পষ্ট। রপ্তানী ও রপ্তানী বাণিজ্যের আয়ে বিপুল ধস, অভিবাসন সংকোচন, পর্যটন খাতের বিপুল নিমনগামীতা প্রভৃতি অসংখ্য খাতে নানা ধরনের সংকটের জন্ম দেবে। জিডিপি’র নিমনগামীতা দেখিয়ে এই পরিস্থিতি পুরো ব্যাখ্যা করা যাবে না।
আর পুঁজিতান্ত্রিক গদবাঁধা পথে জিডিপিকে জীবনমান পরিমাপের সূচক হিসেবে বিবেচনা করারও কোন সুযোগ নেই।
দুনিয়া যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নামে এক প্রযুক্তিগত বিপ্লবের আয়োজনে ব্যস্ত তখন এই ভাইরাসজনীত পরিস্থিতি মোকাবেলা করে উৎপাদন চেইন অক্ষুন্ন রেখে সামাজিক জীবন ধারা টিকিয়ে রাখতে কৃত্রিম, বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক অটোমেশন, ইন্টারনেট, জৈব প্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রভৃতি নানা প্রযুক্তি ইতিমধ্যে অনেকখানি কার্যকরি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সমতাভিত্তিক মানবিক সমাজ নির্মাণে এই প্রযুক্তিকে কিভাবে কাজে লাগানো হবে তার উপর করোনা পরবর্তী অর্থনীতি ও রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করবে। করোনা পরবর্তী যুগে কারা এগিয়ে থাকবে তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন দক্ষিণ কোরীয় দার্শনিক বায়ুং চুন হান। তার ভাষ্যে “করোনা পরবর্তী সময়ের জয়ী রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে জাপান, কোরিয়া, চীন, হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর। ইউরোপের প্রতি মানুষ আর আগের মত বাধ্যগত থাকবে না”।
করোনা দুর্যোগ বস্তুত গোটা বিশ্ব অর্থনীতির পুনর্গঠন-পুনর্বিন্যাস এর প্রশ্নকে জরুরীভাবে সামনে নিয়ে আসছে। উৎপাদন, বিপনন, সরবরাহ, বন্টন তথা অর্থনীতিতে রাষ্ট্র ও সরকারের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালনের চাহিদা আরো বাড়িয়ে তুলবে। কথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি বা বাজারের স্বেচ্ছাচারীতার উপর নির্ভর করে যে রাষ্ট্র ও সরকারসমূহ বসে থাকতে পারবে না তাও অনেকখানি স্পষ্ট। সামরিক খাতসহ অনেকগুলো খাতের বাজেট সংকুচিত করে তা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, আবাসনসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মনযোগ ও বরাদ্দ বৃদ্ধির গণদাবিকে নিশ্চিতই আরো জোরদার করবে।
পুঁজি ও মুনাফা কেন্দ্রীক বিশ্বায়নের পরিবর্তে মানবিক বিশ্বায়নের আকুতিকে আরো সামনে নিয়ে আসবে। শিল্প-বাণিজ্যের নয়া উদারীকরণ-অবাধ বাণিজ্যকরণের পথ এড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট, প্রাণ, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যের প্রাণস্ফুরণের মধ্য দিয়ে মানুষের সামাজিক অস্বিত্ব ও জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা ও মানোন্নয়ন ঘটানোই করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে, করোনা ভাইরাসের মত এরকম ‘নৈতিকতাবোধ বর্জিত’ শ্রেণীহীন অজানা ভাইরাসসমূহ যে মানুষের গোটা অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলবে সে আশঙ্কা আজ আর মোটেও অমূলক নয়।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নিউ ইস্কাটন, ঢাকা।