শনিবার ● ২৫ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » খাপড়া ওয়ার্ড থেকে রানা প্লাজা
খাপড়া ওয়ার্ড থেকে রানা প্লাজা
সাইফুল হক :: এদেশে প্রথম নৃশংস জেল হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি জমানায় ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে। জেলকোডের গণতান্ত্রিক সংস্কারসহ রাজবন্দীদের অধিকারের দাবীতে আন্দোলনরত কারাবন্দীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৭ জন বামপন্থী নেতা সংগঠককে হত্যা করা হয়;মারাত্মক আহত হন অনেকেই।পরবর্তীতে অনেককেই গুরুতর নির্যাতনের ক্ষত নিয়েই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়।শেখ মুজিব তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও এই জেল হত্যাকান্ডের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন।
এরপর ঠান্ডামাথায় আর এক নৃশংস জেলহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ; প্রাণ হারান মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা।
জেল ব্যবস্থা শাস্তি আর দমনমূলক হলেও রাষ্ট্রের দিক থেকে সবচেয়ে নিরাপদ প্রতিষ্ঠান বলেই বিবেচিত। সেই জেলখানাও এদেশে নিরাপদ থাকেনি,নিরাপদ নয়।অন্যদিক থেকে জেল এক ধরনের নিরাপত্তা হেফাজত ও বটে।
কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে আনুষ্ঠানিক জেল ছাড়াও রাষ্ট্রের উদ্যোগে জানা অজানা এই ধরনের অনেক অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা হেফাজতখানা গড়ে উঠেছে। এসব নিরাপত্তা হেফাজত যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবে মোটেও নিরাপদ নয় সরকারি আর বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীসহ ভুক্তভোগীদের এই ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০০৭ এ ফখরুদ্দিন - মঈনুদ্দিনের শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা কর্মীদের এই ব্যাপারে মোটামুটি একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে।
গত কয়েক দশক ধরে আবার জিজ্ঞাসাবাদের নামে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে রিম্যান্ড ব্যবস্থা। আর এই রিম্যান্ডের নামে মানসিক আর শারীরিক নির্যাতন এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।ঔপনিবেশিক বৃটিশ বা পাকিস্তানি জমানায়ও রিম্যান্ডের নামে এই ধরনের নিপীড়ন - নিগ্রহ দেখা যায়নি।
ইতিমধ্যে পদ্মা, মেঘনা,যমুনা, বুডিগংগা,শীতলক্ষ্যা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে,বহুবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নিপীড়নের এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি,বরং দিনকে দিন তাতে আরও নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে রাষ্ট্র গঠন করেছিলাম সে রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণার তিন অংগীকার ছিল - সাম্য,মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। অথচ বাংলাদেশ আজ বলা চলে সে ঘোষণার ১৮০ ডিগ্রি উল্টো দিকে হাটছে। যে রাষ্ট্রের হবার কথা ছিল সাম্যভিত্তিক,গণতান্ত্রিক আর মানবিক আজ ৫০ বছর পর সেই রাষ্ট্র হয়েছে চরম অমানবিক, অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক, সাম্প্রদায়িক, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বিদ্বেষী, দমন আর নিপীড়নমুলক। পাকিস্তানি জমানাকেও হার মানিয়ে এখন একদেশে দুই সমাজ - দুই অর্থনীতি চালু হয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য হলেও এখন সাধারণ নিয়মে পরিনত হয়েছে। এই ধরনের কোন কোন হত্যাকাণ্ডে এক ধরনের সামাজিক সমর্থনও জুটছে।ভুত নাকি পিছনে হাটে।বোঝা যাচ্ছে আমরাও পিছনে হাটছি।
এসবের পাশাপাশি বেড়ে চলেছে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। স্পেক্টারম গারমেন্টস ধস, তাজরিন গারমেন্টস এর অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ধসসহ এরকম অসংখ্য অগ্নিকান্ড,ভবন ধসের ঘটনায় হাজার হাজার শ্রমজীবী -মেহনতি মানুষের মৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষের প্রাণ হারানোর মত মর্মান্তিক সব ঘটনাতো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং পরষ্পর সম্পর্কিত।রানা প্লাজা ধসে মর্মান্তিক মৃত্যুতে যে নারী শ্রমিকের পা টুকু প্রবলভাবে বেরিয়ে এসেছে তা কি এই এই নিষ্ঠুর শ্রমদাসত্বের জীবন, অনিরাপদ কারখানা আর গোটা অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ, ঘৃণা আর প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে?
করোনার এই ঘনঘোর দুরযোগেও বন্দুকযুদ্ধে মানুষ মরা থেমে নেই,,সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যাও বন্ধ হয়নি।
করোনার অমানিশা কেটে যাবার পর আমরা কি আবার এখনকার এই অসহনীয়, অমর্যাদাকর, অমানবিক পৃথিবীতে ফিরে যাব; নাকি গণতান্ত্রিক, মানবিক, দায়বদ্ধ, সাম্যভিত্তিক এবং প্রাণ, প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ নতুন পৃথিবী আর মানুষে মানুষে নতুন যুথবদ্ধ মানবিক ও গণতান্ত্রিক সম্পর্ক রচনার পথ তৈরীতে মনযোগী হব- এই প্রশ্ন নিশ্চয় এখন আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক, সাইফুল হক, সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
সূত্র : ফেইসবুক পেইজ থেকে ।