বৃহস্পতিবার ● ৩০ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » শ্রমিকশ্রেণির স্বপ্নের দুনিয়া বিনির্মানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে মে দিবস
শ্রমিকশ্রেণির স্বপ্নের দুনিয়া বিনির্মানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে মে দিবস
আবু হাসান টিপু :: মে দিবসের পেছনে রয়েছে শ্রমিকশ্রেণির আত্মদান ও বিরোচিত সংগ্রামের ইতিহাস। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। সেটি ছিল পুঁজিবাদী বিকাশের প্রাথমিক যুগ। তখন শ্রমিকদের কাজের কোনো শ্রমঘণ্টা নির্ধারিত ছিল না; ছিল না ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা; তাদের মজুরি ছাড়া অন্য কোন সুযোগ সুবিধা ছিল না; কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ বা নিরাপত্তার কোন গ্যারান্টি ছিল না; কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার দায় শিল্প মালিকরা বা রাষ্ট্র কেউই নিত না। সে সময় উঠতি বুর্জোয়ারা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে শ্রমিকদের দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা শ্রম দিতে বাধ্য করতো; এমনকি কোন কোন স্থানে ১৯ ঘণ্টা শ্রমের বিধানও চালু করা ছিল। ফলে শ্রমিকের জীবন এক দুর্বিষহ আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। শিল্প বিপ্লবের ফলে শ্রমিক ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। মালিকদের প্রাচুর্য ও জৌলুসের সীমা আকাশ ছুতে থাকে। আর স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের সকল যন্ত্রগুলো ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষাবলম্বন করতে থাকে। ফলে শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের সামনে মজুরী দাসত্বের শৃংখল ভাঙ্গার লড়াই হয়ে পরে অনিবার্য।
এ আকাশ পাতাল বৈষম্যের ফলস্বরূপ শ্রমিকরা বিক্ষুব্দ হয়ে কারখানা ভাঙা, জ্বালাও পোড়াওসহ ম্যানেজার হত্যার মতো ঘটনা ঘটাতে থাকে। সারা আমেরিকার সমস্ত শিল্পাঞ্চলই দিনদিন হয়ে উঠে অগ্নিগর্ভ। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অভিজ্ঞতায় শ্রমিকরা বুঝতে পারলো শুধুমাত্র কারখানা ভাংঙা, ম্যানাজার হত্যা জ্বালাও পোড়াও এ জাতিয় বিচ্ছিন্ন বিক্ষুব্দ আন্দোলনে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় ; প্রয়োজন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউন প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টাটাও ছিল শ্রমিকশ্রেণী লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা। শোষণ থেকে মুক্তির আশায় এরকম বহু আন্দোলন আর পরাজয়ের বেদনার মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছিল ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের আন্দোলন।
১৮৮০ সালে প্রথম আমেরিকার শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৮৮৪ সালে তারা সংগঠিতভাবে ৮ ঘণ্টা দৈনিক শ্রম নির্ধারণের জন্য মালিকপক্ষের কাছে প্রস্তাব করে। আর এ প্রস্তাব কার্যকরের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের প্রস্তাব কার্যকর করার লক্ষ্যে শ্রমিক নেতা জোয়ান মোস্ট, আগস্ট পাইজ ও লুই লিং-দের নেতৃত্বে ১৮৮৬ সালের এপ্রিলের ২৪ তারিখ থেকে মে মাসের ৪ তারিখ পর্যন্ত শিকাগোর শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করে। পহেলা মে তারিখে শিকাগো শহরের সাধারণ শ্রমিকেরা সম্মিলিতভাবে শহরের প্রায় ৩৫০০০ শ্রমিক তাদের কাজ বন্ধ করে দেন। এ সংখ্যা পরবর্তী তিন দিনে আরও বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকরা শহরের প্রতিটি শিল্প-কারখানায় গিয়ে পিকেটিং করে অন্যদেরকে তাদের সঙ্গে যুক্ত করতে থাকেন। এ সময়ে অনেকে ৮ ঘন্টা কাজের দাবীসহ শ্রমের মজুরি বৃদ্ধির স্লোগানও দিতে থাকেন। তবে এ পর্যায়ের পুরো আন্দোলনটাই ছিল শান্তিপূর্ণ। এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের এক পর্যায়ে বিনা উস্কানিতে রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষের সাজানো নাটকে পুলিশ গুলি চালালে নিহত ও আহত হন অসংখ্য শ্রমিক। ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতারকৃত বেশ কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়।
১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ফাসির মঞ্চে দাড়িয়ে শ্রমিকনেতা আগস্ট স্পাইজ বলেছিলেন এমন সময় আসবে যখন কবরের অভ্যন্তরে শায়িত আমাদের নিশ্চুপতা জ্বালাময়ী বক্তৃতার চেয়ে বাক্সময় হবে এবং তা শ্রমিকশ্রেণীর বিজয় লাভের শেষ সংগ্রাম পর্যন্ত লড়াইয়ে প্রেরণা যোগাবে। এবং শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস চীর স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এ সংবাদ বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পরলে ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য শিল্পাঞ্চলেও একই দাবীতে শ্রমিকরা সোচ্চার ও সংগঠিত হয়ে উঠে; শুরু হয় বুর্জোদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই। কবরের অভ্যন্তরে শায়িত জোয়ান মোস্ট, আগস্ট পাইজ ও লুই লিং-দের নিশ্চুপতা অনেক বেশী বাক্সময় হয়ে শোষকদের ভিত কাপিয়ে তোলে। এবং ক্রমান্বয়ে বিশ্বজুড়ে প্রতষ্ঠিত হয় ৮ ঘন্টা শ্রম অধিকার; তৈরী হয় শ্রম আইন।
আর তাইতো ১৮৪৮ সালে প্রণীত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে কার্ল মার্ক্স লিখেছিলেন সর্বকালের বিদ্যমান সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস অর্থাৎ মানব সমাজের পুরো ইতিহাসকে মার্ক্স দেখেছেন শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে। মার্ক্সের মতে সমাজ বিবর্তণের ইতিহাস হলো শোষক ও শোষিতের নিরন্তন বৈপরিত্য ও ধারাবাহিক সংগ্রাম ও সংঘর্ষের ইতিহাস। এ সংগ্রাম ও সংঘর্ষ অঞ্চলভেদে ও সময়ভেদে বিভিন্নরূপ নিতে পারে। কিন্তু এর পরিসমাপ্তি হয় পুরাতন প্রথার বিলুপ্তির মাধ্যমে। এবং নতুন প্রথার জাগরণে ও উন্মেষে।
কার্ল মার্ক্সের এই অমর উক্তিকে সত্য প্রমাণীত করে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেন্ট লুইস শ্রমিক সম্মেলনে কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণের দাবিতে মে দিবস পালনের ঘোষণায়। যা ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নামে খ্যাত কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের প্যারিস সম্মেলনে ১ মে তারিখটিকে দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত না হলেও ১৮৯০ সাল থেকে ইউরোপের দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণি ১ মে; মে দিবস পালন করে আসছে। পরে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক অধিকার সম্প্রসারণের ফলে প্রথমে গুটিকয়েক দেশ ১ মে-কে শ্রমিক দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ১ মে-কে সর্বজনীন শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পাকিস্তান শাসনামলে এই দিনটি জাতীয় ছুটি হিসাবে ঘোষিত না হলেও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশেও ১ মে রাষ্ট্রিয়ভাবে ছুটির দিন ঘোষিত হয়।
১৮৮৬ থেকে ২০২০ বিশ্বগুড়ে বহু রাষ্ট্রের উত্থান পতন হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এগিয়েছে। বিকশিত হয়েছে মানুষের গড় চিন্তা ও চেতনার। এককালের জমিদার শিল্পপতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। শাসকশ্রেনি গণতন্ত্রের হাস্যকর ত´ার আড়ালে স্বৈরতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদের ফেরীওয়ালায় পরিনত হয়েছেন। বিশ্বজুড়েই আজ নিকৃষ্ট অমানবিকতা উপস্থাপিত হচ্ছে মানবিক মোড়োকে । পশ্চিমা দুনিয়ার উন্নত পুজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ তাদের নাগরিকদের কিছু কিছু ঘুষ দিয়ে মানবিকতার চাদর পড়ে থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের এই অউন্নত রাষ্ট্র বাংলাদেশের চিত্র তার বিপরীত।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের শাসকগোষ্ঠি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বদাই রয়েছেন উদাসীন; আজকের বাস্তবতা আরও বেশী ভয়ংকর। বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনার ভয়াল আক্রমনে বাংলাদেশও যেখানে সন্ত্রস্ত, আক্রান্ত; দেশজুড়েই হচ্ছে করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এই রকম একটি জাতীয় দূর্যোগকালেও মুনাফালোভী গার্মেন্টস মালিকরা প্রায় ৫০ লক্ষ শ্রমিকের জীবন নিয়ে খেলার উন্মাদনায় মত্ত হয়েছেন। বরাবরের মতো রাষ্ট্রের সকল যন্ত্রগুলো এই বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষাবলম্বনই করছেন। মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার উপর ছেড়ে দিয়ে লিখছেন শ্রমিকের ভাগ্য। ফলে শ্রমিকরা হয়ে পরেছেন অসহায়। চরম স্বাস্থ ঝুকি নিয়েই তাদের কাজে যোগ দিতে হচ্ছে। এতে নিশ্চয় শ্রমিকরাই কেবল ক্ষতিগ্রস্থ হবেন না ক্ষতিগ্রস্থ হবেন গোটা জাতী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করতে লকডাউন, কারফিউ এমন কি রাস্তায় দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে গার্মেন্টসের মতো শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান চালু রাখা কি কোন ভাবেই সমিচিন? সরকারের প্রণোদনাভোগী মুনাফালোভী এই গার্মেন্টস মালিকরা আজ দেশের সরকারের ভিতর আরেক সরকার রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।
বাংলাদেশের এই চরম বাস্তবতায় শ্রমজীবী মানুষকে মজুরী দাসত্বের শৃংখল ভাঙ্গার লড়ায়ে সামীল হয়ে চুরান্ত মুক্তির জন্য সংগঠিত হওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। দেশের প্রচলিত পুরাতন প্রথার বিলুপ্তির মাধ্যমে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শ্রমিকশ্রেণির স্বপ্নের দুনিয়া বিনির্মানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রতি বছর মে দিবস শ্রমিকশ্রেণির দরজায় কড়া নাড়ে।
লেখক : আবু হাসান টিপু, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বিপ্লবী শ্রমিক সংহতি, কেন্দ্রীয় কমিটি।