শুক্রবার ● ১৫ মে ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » করোনা দুর্যোগ-কর্তৃত্ববাদী শাসনের শেকড় আরো গভীরে নিচ্ছে : সাইফুল হক
করোনা দুর্যোগ-কর্তৃত্ববাদী শাসনের শেকড় আরো গভীরে নিচ্ছে : সাইফুল হক
করোনা মহামারী দুনিয়াজুড়ে এক অকল্পনীয় অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অদৃশ্য এক অনুজীব- জীবানুর সংক্রমন ও মৃত্যু আতঙ্কে পারমানবিক শক্তিধর দেশসমূহের জনগণের বড় অংশকেও ঘরবন্দী করে ফেলেছে। পারমানবিক বোমা, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সমরসজ্জা, মহাকাশ যাত্রা, চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন আর অগ্রগতির আত্মম্ভরী কোন প্রকল্পই এখন আর মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারছে না। শিল্পোন্নত ‘সুপার পাওয়ারের’ দেশগুলোও কোভিড- ১৯ নামক এই ভাইরাসের কাছে চরম অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়েছে।এই ভাইরাস মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় হাসপাতাল নেই, ডাক্তার নেই, ভাইরাস শনাক্তকরণে পর্যাপ্ত কীট নেই, নেই প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর, ডাক্তার-নার্স-চিকিৎসা সেবীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ইত্যাদি ইত্যাদি। কথিত সভ্যতা আর উন্নয়নের স্ববিরোধীতা আর ভিতরকার গোমর এত মারাত্মকভাবে কখনও ধরা পড়েনি। মহামারীজনীত এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সামাল দিতে যেয়ে রাষ্ট্র ও সরকারসমূহকে জরুরী পরিস্থিতি, লকডাউন, সান্ধ্য আইন প্রভৃতি চরম ব্যবস্থা জারী করতে হয়েছে। পবিত্র ধর্মীয় স্থানসমূহে ধর্মপ্রাণ মানুষের যাতায়াত বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মসজিদ, মন্দির, গীর্জাসহ প্রার্থনাস্থানসমূহ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে, ভক্তদের যাতায়াত একেবারে সীমিত রাখতে হয়েছে। দ্রুত হাসপাতাল তৈরী, ডাক্তার-নার্সদের যোগান, চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবস্থা, জনগণের বিভিন্ন অংশের জন্য খাদ্য ও নগদ টাকার ব্যবস্থাসহ বিশাল অংকের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হয়েছে। মহামারী পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে সরকারসমূহকে সমাজের নানা অংশের জন্য আগামীতে আরো প্রণোদনা সহায়তা ঘোষণা করতে হবে। জরুরী এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যেয়ে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রমে ভাটা পড়ছে; নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরী হচ্ছে; তাদেরকে পিছনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে; কোন কোন ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে স্থগিত রাখা হচ্ছে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, তথা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গের হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসজনীত দুর্যোগ সামাল দিতে দেশের সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সকল সহায় সম্পদ সংগঠিত করার পরিবর্তে পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন সরকার ও শাসকগোষ্ঠি নিজেদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতেই অধিক মনযোগি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস, সিনেট ও অঙ্গরাজ্যসমূহের এখতিয়ার ও ক্ষমতা এড়িয়ে যেয়ে আইনের নানা ফাঁক ফোকরে পরিস্থিতির অজুহাতে ট্রাম্প নিজের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতার চৌহদ্দিকে বাড়িয়ে নিতে বেপরোয়াভাবে তৎপর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন দৃশ্যত: অনেক কৌশলী। কোভিড- ১৯ মোকাবেলার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার বা প্রশাসনের হাতে না রেখে তিনি এ সম্পর্কিত প্রধান দায়দায়িত্ব আঞ্চলিক গভর্ণরদের হাতে অর্পণ করেছেন; যাতে করে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তার প্রধান দায়ভার তার উপর এসে না পড়ে। তবে রাশিয়ায় তার নিবর্তনমূলক পদক্ষেপসমূহ অব্যাহত রয়েছে। মিডিয়ায় ফেক বা ভূয়া খবর বন্ধ করার নামে নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। তবে পরিস্থিতির কারণে প্রেসিডেন্ট পুতিনের আরো দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে সংবিধান পরিবর্তনের তৎপরতা (যাকে সাংবিধানিক অভ্যুত্থান হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে) আপাতত: স্থগিত রাখতে হয়েছে। করোনা দুর্যোগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আরো জোরদার হচ্ছে। সেখানে সামাজিক গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তৎপরতা জারী রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেবার কারণে তুরস্কে ইতিমধ্যে শত শত লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পোলান্ডে কথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অবশিষ্টটুকু বানচাল হবার পথে। হাঙ্গেরীর পরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। করোনা মোকাবেলায় হাঙ্গেরীতে ‘বিপজ্জনক পরিস্থিতি’ ঘোষণা করে আইন সভায় প্রধানমন্ত্রী ভিন্নতর পন্থায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখতে এবং নিজের চরম কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা পুরোপুরি সংহত করতে তৎপর রয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় ডিক্রি জারীর মধ্য দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য তিনি ক্ষমতায় থাকার রাস্তা তৈরী করছেন। করোনা সংক্রমনের শুরুতেই তিনি অভিবাসি ও জাতিবিদ্বেষী ভূূমিকা নিয়ে বলতে থাকেন ‘বিদেশীরা এই রোগ বহন করে এনেছে’।
এই ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও খুব পিছিয়ে নেই। করোনা দুর্যোগে পাকিস্তানে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব, বিশেষ করে সামরিক আমলাতন্ত্রের খবরদারি আরো বেড়েছে। কদিন আগে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের সামনের সারির দৈনিক পত্রিকাসমূহের মালিকদের সাথে মিটিং করে করোনা সংক্রমন নিয়ে নেতিবাচক খবরাদি প্রকাশ না করতে তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন। একদিকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিরোধীদের সাথে কথা বলছেন, তাদের পরামর্শ শুনছেন, আর অন্যদিকে সংবাদপত্রসহ মিডিয়াসমূহ নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন; যাতে করোনা মোকাবিলায় সরকার গৃহীত পদক্ষেপসমূহের প্রতি মানুষের সমর্থন ও সম্মতি আদায় করে তার সরকারের নিম্নগামী ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা যায়। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনসহ সংবিধান বিরোধী চরম, অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপসমূহের বিরুদ্ধে ভারত জুড়ে অভূতপূর্ব গণজাগরণের মধ্য দিয়ে মোদি সরকার যেভাবে ‘ব্যাকফুটে’ চলে গিয়েছিল করোনা দুর্যোগ এদিক থেকে তাদের জন্য অনেকটা সাপেবর হিসাবেই আবির্ভূত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির সুযোগে শাহীনবাগের ঐতিহাসিক অবস্থান তুলে দেয়া গেছে। দিল্লীতে তাবলিগ জামায়াতের সমাবেশ ও কিছু মুসল্লীর করোনা সংক্রমনকে ইস্যু করে নানাভাবে মুসলমানবিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রচারণা অব্যাহত রাখা হয়েছিল। বলা হচ্ছিল চীন করোনার ‘প্রডিউসার’ আর ভারতের মুসলিমরা হচ্ছে ‘ডিস্ট্রিবিউটর’। ১৮৯৭ সালে ভারতজুড়ে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর ভারতের স্বাধীনতাকামী নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক বৃটিশ রাজের মহামারী ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করায় ঔপনিবেশিক ভারতে তাকে যেমন রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এখন মোদি সরকারের পদক্ষেপসমূহের (হোক তা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা করোনা মোকাবিলায় আকস্মিক লকডাউন সহ নানা পদক্ষেপ) যৌক্তিক সমালোচনাকেও দেশদ্রোহী-গণদুষমনী হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। চরম হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক ফ্যাসিবাদী ভাবাদর্শের সাথে এখন মতপ্রকাশ ও তথ্যের অধিকারসহ গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত করে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের মেলবন্ধন ভারতের জন্য বড় রাজনৈতিক বিপদ হিসাবে হাজির হয়েছে। করোনাকালের রাজনীতি ভারতে বিরোধীদেরকে বেশ খানিকটা পিছনে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থানও গুণগতভাবে এ থেকে ভিন্ন নয়। করোনা সংক্রমনের জাতীয় দুর্যোগেও সরকার ‘একলা চলো নীতি’ অব্যাহত রেখেছে। জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় বিরোধীদের ও জনগণের নানা অংশের সমন্বিত ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বানকে উপেক্ষা করে করোনাকালেও সরকার তাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে হাঁটছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমসমূহকে ‘সেলফ সেন্সরশীপে’ ঠেলে দিয়েছে। ইতিমধ্যে দুই অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদকদ্বয়ের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে। সামাজিক সংক্রমন এড়াতে সকল ধরনের সভা-সমাবেশ বন্ধের রাজনৈতিক সুফলও সরকারের তহবিলে জমা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিরোধীদের যৌক্তিক মতামত ও পরামর্শসমূহকেও উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গণতান্ত্রিক চৌহদ্দী এমনিতেই মারাত্মকভাবে সংকুচিত। তার উপর করোনা মহামারী নির্বাহী বিভাগ তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে বস্তুত: সকল ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার কেন্দ্রীভূত করেছে। বাংলাদেশে এখন কার্যত: এক ব্যক্তির সরকার চলছে। তার ইচ্ছা, সম্মতি, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা ছাড়া চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে খাদ্য ত্রাণ বিতরণ কিছুই চলে না। কথিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এ এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। করোনা দুর্যোগজনীত পরিস্থিতি কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আরো পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত করার সুযোগ এনে দিয়েছে। নাগরিকদের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে দুর্বল, অকার্যকরি ও নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে প্রলম্বিত করার প্রণোদনাও উপস্থিত করছে। এটা স্পষ্ট যে, এখনকার শাসকেরা যদি করোনা সংকট মোটামুটি সামাল দিয়ে উঠতে পারেন তাহলে তারা তাদের সীমাহীন স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার লাগামও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবেন না। তাদের অস্তিত্বের সাথে দেশের অস্তিত্ব ও টিকে থাকাকে যুক্ত করেই দেখা হবে। তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলোতে বিশেষত: ভারত ও বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বহুমুখী প্রচারণাও শুরু হয়েছে। লক্ষ্য বিশেষ শাসক বা শাসকগোষ্ঠিকে কেন্দ্র করে একটা আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাতাবরণ তৈরী করা, যাতে তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতার পিছনে জনগণের একটা বড় অংশের সম্মতি আদায় করা যায়। করোনা মহামারী বিদ্যমান অন্যায়, অন্যায্য, শোষণ ও বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তন, তার খোলনলচে পাল্টিয়ে মানবিক, দায়বদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও সাম্যভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে অমিত সম্ভাবনা সামনে নিয়ে এসেছে পরিবর্তনকামী শ্রেণী ও জনগণ তাকে কতটা কাজে লাগাতে পারে তার উপর করোনাউত্তর দুনিয়ার অনেক কিছু নির্ভর করছে।
লেখক : সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।