রবিবার ● ১৭ মে ২০২০
প্রথম পাতা » ঢাকা » কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় তামাকপণ্যের কর ও দাম বৃদ্ধি করুন
কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় তামাকপণ্যের কর ও দাম বৃদ্ধি করুন
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি :: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তামাককে করোনা সংক্রমণ সহায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার কথা বলছে। ধূমপানের কারণে শ্বাসতন্ত্রের নানাবিধ সংক্রমণ এবং শ্বাসজনিত রোগ তীব্র হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা করে ডব্লিউএইচও জানিয়েছে যে, অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের কোভিড-১৯ সংক্রমণে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই সতর্কতা আমলে নিলে দেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি তামাক ব্যবহারকারী মারাত্মকভাবে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তামাকের সহজলভ্যতা এবং ত্রুটিপূর্ণ করকাঠামোই এর প্রধান কারণ। তামাকের দাম বেশি হলে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরৎসাহিত হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়। তামাক কর ও মূল্যবৃদ্ধির দাবিতে আজ রবিবার, ১৭ মে ২০২০ প্রজ্ঞা এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স-আত্মা’র উদ্যোগে তামাকবিরোধী সংগঠন এসিডি, ঢাকা আহছানিয়া মিশন, ইপসা, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, তামাকবিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) এবং বিটা ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য তামাক কর ও দাম সংক্রান্ত বাজেট প্রস্তাব গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরে।
এই বাজেট প্রস্তাব সমর্থন করে জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আমরা জানি যেকোনো ভাবে তামাক সেবন স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং এই কোভিড-১৯ মহামারী আবারও বুঝিয়ে দিল সুস্থ থাকার জন্য তামাকপণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ কতটা জরুরি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তামাক ব্যবহারের ক্ষতির শিকার বিপুল সংখ্যক মানুষ বর্তমানে মারাত্মকভাবে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে। করোনার অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি ভবিষ্যতে সুস্থ সমাজ গঠন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য তামাকমুক্ত জাতীয় পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। তাই আসন্ন বাজেটে সকল তামাকপণ্যের কর ও মূল্য বাড়িয়ে তরুণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠির ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করছি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের বিদ্যমান চারটি মূল্যস্তর বিলুপ্ত করে দুটি নির্ধারণ করা দরকার। কারণ একাধিক মূল্যস্তর এবং বিভিন্ন দামে সিগারেট ক্রয়ের সুযোগ থাকায় ভোক্তা স্তর পরিবর্তন করার সুযোগ পায়। ফলে তামাক ব্যবহার হ্রাসে কর ও মূল্য পদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করে না। তামাক খাত থেকে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং তামাকপণ্যের ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমানোর জন্য একটি সহজ ও শক্তিশালী তামাক করনীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, কোভিড -১৯ সংকট মোকাবেলায় তামাক কর সংস্কার একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এক্ষেত্রে তামাকপণ্যের জন্য নির্ধারিত সম্পূরক শুল্কের একটি অংশ সুনির্দিষ্ট কর আকারে আরোপ করা যেতে পারে এবং অন্যান্য কর পদক্ষেপের সাথে সব ধরনের তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ৩ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা যেতে পারে। সবমিলিয়ে, তামাক-কর বিষয়ক এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাট বাবদ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব এবং সারচার্জ থেকে আরো প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় অর্জন করা সম্ভব হবে। এই অর্থ সরকার তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস, করোনা মহামারী সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ। এই তরুণদের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যত বাংলাদেশের উন্নতি। সেজন্য তামাকের মতো স্বাস্থ্য হানিকর পণ্য থেকে তরুণ সমাজকে দূরে রাখতে তামাকপণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করে ধূমপান সামগ্রীর দাম তরুণ প্রজন্মের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। পাশাপাশি তরুণ এবং শিক্ষার্থীদের তামাকের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালাতে হবে।
কোভিড-১৯ মহামারী সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত অর্থ সংস্থান এবং একইসাথে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ সুগম করতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে তামাকপণ্যের কর ও মূল্য বৃদ্ধির জন্য নিম্নোক্ত দাবিসমূহ তুলে ধরা হয়:
বাজেট প্রস্তাব:
১। সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪টি থেকে ২টিতে (নিম্ন এবং প্রিমিয়াম) নামিয়ে আনা:
ক. ৩৭+ টাকা এবং ৬৩+ টাকা এই দুইটি মূল্যস্তরকে একত্রিত করে নিম্নস্তরে নিয়ে আসা; নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা;
খ. ৯৩+ টাকা ও ১২৩+ টাকা এই দুইটি মূল্যস্তরকে একত্রিত করে প্রিমিয়াম স্তরে নিয়ে আসা; প্রিমিয়াম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা;
২। বিড়ির ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার মূল্য বিভাজন তুলে দেয়া: ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৬.৮৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩২ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক এবং ৫.৪৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা;
৩। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের (জর্দা ও গুল) মূল্য বৃদ্ধি করা: প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪০ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৩ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং প্রতি ১০ গ্রাম জর্দা ও গুলের উপর যথাক্রমে ৫.৭১ টাকা এবং ৩.৪৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; সকল ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বলবৎ রাখা।
৪। সকল তামাকপণ্যের খুচরামূল্যের ওপর ৩ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা।
উল্লিখিত তামাক-কর ও মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাট বাবদ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে। এছাড়াও ৩ শতাংশ সারচার্জ থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় অর্জন করা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত এই অর্থ সরকার তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস, করোনা মহামারী সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে ৬ লক্ষ বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এবং প্রায় ২০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে। একইসাথে করোনার মতো যেকোন ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পাবে।