বুধবার ● ২৭ মে ২০২০
প্রথম পাতা » গাজিপুর » প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালগুলোর ডিজিটাল প্রতারণা ও জাতির সাথে তামাশা
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালগুলোর ডিজিটাল প্রতারণা ও জাতির সাথে তামাশা
এম এস হাবিবুর রহমান :: মহামারি করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক অনলাইন সভায় অনুষ্ঠিত হয়।
প্রসঙ্গত উচ্চশিক্ষায় চলমান নানাবিধ প্রতারণা নিয়ে যেসব সংবাদ সময়ে সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নামসর্বস্ব ভুয়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ‘দূরশিক্ষণ’ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, উচ্চশিক্ষা বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রতারণা, অনুমোদনহীন ‘ভুয়া’ বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ খুলে শিক্ষার্থী ভর্তির পাঁয়তারা, মালিকানার দ্বন্দ্বে সৃষ্ট একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাস স্থাপন, আউটার ক্যাম্পাস বা শাখা ক্যাম্পাস খুলে প্রতারণা ইত্যাদি। উচ্চশিক্ষায় প্রতারণার বিষয়টি একেবারেই যে নতুন, তা নয়। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চশিক্ষায় এ ধরনের লাগামহীন প্রতারণা ও নির্লজ্জ বাণিজ্য চলে আসছে এবং চলছে। দেশে বিদ্যমান নানাবিধ প্রতারণার মিছিলে উচ্চশিক্ষাও যে শামিল হয়েছে বা শামিল হতে বাধ্য করা হয়েছে কিছু অসৎ মানুষ কর্তৃক সেটা এখন আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। প্রচলিত আইন কানুন বিদ্যমান এসব প্রতারণা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় এসব অরাজক পরিস্থিতির উন্নতিরও কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না । ফলে, দিনের পর দিন মানুষ প্রতারিত হয়েই চলছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী অনুমোদন ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা অবৈধ এবং চ্যান্সেলর হিসাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতিই একমাত্র ভিসি নিয়োগ দেয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু আমাদের দেশের অনেকে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে নিজেকেই ভিসি হিসাবে প্রচার করছে। এছাড়া, কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষার নামেও প্রতারণা করা হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যাপারে আপস না করলেও বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটার ক্যাম্পাস, অননুমোদিত বা সরকার কর্তৃক বন্ধ ঘোষিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে অনবরত প্রতারণা করেই যাচ্ছে।
যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী আউটার ক্যাম্পাস ও দূরশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এসব অবৈধ শাখা থেকে মানুষ ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার করছে বা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এ ধরনের প্রতারণা রোধে প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব বরাবরের মত পরিলক্ষিত হওয়ায় কিছু অসৎ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছত্রচ্ছায়ায় এসব প্রতারণামূলক কর্মকান্ড বেড়েই চলছে। এসব ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। লাখ লাখ টাকা ও সময় ব্যয় করে সার্টিফিকেট পাওয়া কোন কাজে আসছে না। এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভ্রান্ত করছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। শিক্ষার্থী ভিড়াতে নানা লোভনীয় প্রস্তাবও দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে, এসব শিক্ষার্থীর দায়দায়িত্ব নিজেদেরকেই নিতে হবে। বর্তমানে দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১০০টি।
একথা সত্য যে, গত দুই দশকে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে কিন্তু প্রতারণামুক্ত ও মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা গেছে এমন দাবি যুক্তিসঙ্গত নয়। সেই সাথে প্রতারণার বিষয়টিও লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে যা অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ সচেতন মানুষদের আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নামসর্বস্ব নানা প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদেরকে প্রতারিত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংকট, উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বিদ্যমান বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রতারণা করে আসছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
গত ৩০ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে করোনাকালীন অনলাইনে পরীক্ষা ও ভর্তির ব্যাপারে সকলে সম্মত হয়েছিলেন। এতে ইউজিসি দুটি বিকল্প প্রস্তাব রাখে। ইউজিসিকে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে কোনও একটি পদ্ধতিতে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবে বলা হয়।
ইউজিসির প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, চলতি সেমিস্টারের কোর্সসমূহের অসমাপ্ত পাঠ্যসূচির উপর অনলাইনে ক্লাস চলমান থাকবে। তবে ল্যাবরেটরিভিত্তিক সকল কোর্সের ব্যবহারিক ক্লাস করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর শ্রেণিকক্ষে সম্পন্ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্যায়ের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর চলমান নিয়ম অনুযায়ী গ্রহণ করবে।
আর দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব সক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের উপযোগী ডিজিটাল পদ্ধতিতে ক্লাস পরিচালনা করবে। চলমান সেমিস্টারের অসমাপ্ত প্রায় ৩০ শতাংশের মতো পাঠ্যসূচি সম্পন্ন হয়ে গেলে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। তবে চলমান সেমিস্টারের বিভিন্ন বিষয়ের আগের ক্লাস উপস্থিতি, ক্লাস টেস্ট এবং মিডটার্ম পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করতে হবে। একইসঙ্গে অনলাইনে পঠিত অংশের উপর অ্যাসাইনমেন্ট, কেইস স্টাডি, ভাইভা, ভার্চুয়াল প্রেজেন্টেশনের নিয়ে মূল্যায়ন সম্পন্ন করে ফল প্রকাশ করা যাবে। তবে ব্যবহারিক পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর ক্লাসে নিতে হবে।
উভয় প্রস্তাবের যে কোনও একটি গ্রহণ করতে হলে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমপক্ষে ৬০ শতাংশ হতে হবে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি ১৪টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেখানে টিউশন ফি আদায়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ করা; অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফ, হ্রাস ও ইনস্টলমেন্টে প্রদানের সুযোগ রাখা; শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধসহ নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়।
লকডাউনের কারণে সকল প্রকার কর্মজীবী মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধ। তাদের আর্থিক অবস্থা ভীষণ খারাপ। যেখানে ঘরে দু’বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে প্রতিদিন মিনিমাম ১০০ টাকার এমবি দিয়ে ক্লাস করা বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। যাদের এই সামর্থ্য আছে তারা নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ক্লাসে অংশ নিতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ঐক্যের নামে একটি সংগঠন অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা বর্জনের দাবি জানিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী শহরের বাইরের, গ্রাম অঞ্চলের, প্রতন্ত অঞ্চলের। দুর্বল নেটওয়ার্ক সেবার ফলে যেখানে ফোনেই কথা বলা যায় না সেখানে অনলাইন ক্লাস করাটা অকল্পনীয় চিন্তা। আর যারা কোন প্রকারে অংশ নিতে পারছেন তারা ক্লাসের পড়া কিছুই বুঝতে পারছেন না।
শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, অনলাইন ক্লাস হলো সেমিস্টার ফি নেওয়ার একটি ফাঁদ। ভার্সিটি গুলো শিক্ষার্থীদের রিটেক এবং অন্যান্য ভয় দেখিয়ে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য করছে যাতে পরবর্তী সময়ে সেমিস্টার ফি আদায় করা যায় ৷ বর্তমান পরিস্থিতে শিক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা না করেই ক্লাস চালিয়ে যাওয়া ও সেমিস্টার ফি মওকুফ না করার সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হয়েছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে।
একদিন এক লোক এক হুজুরের কাছে গিয়ে সন্তানের আশা ব্যক্ত করে বলেন দোয়া করতে। পরের বছর হুজুরের কাছে গিয়ে জানায় তার সন্তান হয়নি। আবার হুজুরকে দোয়া করতে বলেন। তারপর আবারও পরের বছর হুজুরের কাছে গিয়ে জানায় তার সন্তান হয়নি তখন হুজুর ভেবে-চিন্তে বললেন আপনার বউকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করবেন আশা করি তখন দু’জনের সাথে কথা বলে সমস্যা নির্ণয় করা যাবে। লোকটি বললে হুজুর আমি তো বিয়ে করিনি।
একদিন কয়েকজন যাদব একত্রিত হয়ে কয়েকজন ঋষির সাথে ছলনা করার চেষ্টা করে। তারা শাম্বকে এক গর্ভবতী নারীর বেশে সজ্জিত করে ঋষিদের জিজ্ঞাসা করে যে সেই নারীর আগত সন্তান পুত্র হবে না কন্যা। ঋষিরা ধ্যানে সমস্ত ছলনা জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দেন যে নারীবেশী শাম্বের গর্ভে এক মুসল জন্মগ্রহণ করবে এবং সেই মুসলই হবে যদুবংশের ধ্বংসের কারণ।
প্রতি বছরই বেকার যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী দেশে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার লোক রয়েছে। করোনার বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন কোম্পানি ইতোমধ্যে কর্মীছাটাই শুরু করেছে যা আরো প্রকট হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়ার সঠিক পদ্ধতির ব্যবহার করতেছে না। তারা ইউটিউব বা ফেসবুকে ক্লাস নিচ্ছে, আর ই-মেইলে প্রশ্নপত্র দিয়ে দিচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা বই দেখে লিখে মোবাইলে ছবি তুলে ই-মেইল করে দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এত এত টাকা ও সময় ব্যয় করে কেনো সার্টিফিকেট নিতে হবে? তাহলে যে যেই বিষয়ে পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক সে বিষয়ে নেট থেকে পড়াশোনা করে কম্পিউটারে সার্টিফিকেট বানিয়ে নিলেই চলে। তাতে সময় ও খরচ উভয়ই বাঁচবে।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব সফটওয়্যার তৈরি করে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়ার সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করুক। আর ইউজিসির প্রতি আহ্বান তাঁরা যেনো এই প্রহসন বন্ধের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
লেখক : এম এস হাবিবুর রহমান, সম্পাদক ও প্রকাশক, নিউজ সমাহার। সিইও জোনাকি মিডিয়া গ্রুপ।