বৃহস্পতিবার ● ২৮ মে ২০২০
প্রথম পাতা » নওগাঁ » নওগাঁর পর্যটন এলাকা শর্ত সাপেক্ষে খুলে দেওয়ার দাবী
নওগাঁর পর্যটন এলাকা শর্ত সাপেক্ষে খুলে দেওয়ার দাবী
নাজমুল হক নাহিদ, নওগাঁ প্রতিনিধি :: ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরা উত্তরের জেলা নওগাঁ। এই জেলায় রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, জাতীয় শালবন বিহার, দীবর দীঘি, ঐতিহাসিক কুসম্বা মসজিদসহ নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। বর্তমানে বিশ্বে করোনা ভাইরাস নামের এক অজানা ভাইরাস বিরাজ করছে। যার প্রতিষেধক এখনও আবিস্কার হয়নি।
করোনা ভাইরাসের কারণে জনজীবন স্থবীর হয়ে পড়েছে। মহামারি ঠেকাতে সরকার আগেই দেশের পর্যটন এলাকাগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে। এছাড়া সরকারি দপ্তর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ রাখা হয়েছে। পর্যটন এলাকাগুলো বন্ধ থাকায় এর সাথে সম্পৃক্ত কর্মজীবীরা যেমন বেকার হয়ে পড়েছে তেমনি ভাবে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
ইতিমধ্যেই দর্শনীয় দুটি ঐতিহ্যবাহি স্থাপনা নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ও আত্রাই উপজেলায় অবস্থিত বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পতিসর কাচারি বাড়ী জাদুঘর থেকে সরকার প্রায় ৬লাখ টাকা রাজস্ব পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
জানা গেছে, দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ হওয়ার কারণে প্রতান্তিক অধিদপ্তর মহা-পরিচালকের পক্ষ থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে নওগাঁয় পর্যটন, দর্শনার্থী স্থান ও প্রত্মতাত্ত্বিক জাদুঘর গত ১৯মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ৩০ মে থেকে বন্ধ থাকবে বলেও জানা গেছে। পাহারপুর বৌদ্ধ বিহার ও জাদুঘর মার্চের শেষ সময় হতে চলতি মে মাস পর্যন্ত বন্ধ থাকায় প্রতিমাসে ২০হাজার টাকা গড় হিসেবে প্রায় ৬০হাজার টাকা এবং ঈদ-উল-ফিতরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে গড়ে প্রায় ৪লাখ টাকা অর্থাৎ প্রায় ৪লাখ ৬০হাজার টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত।
অপরদিকে, জেলার আত্রাই উপজেলার বিশ্বকবির পতিসর কাচারি বাড়িতে প্রতি মাসে ১৭হাজার টাকা গড় হিসেবে গত তিন মাসে ৫১ হাজার টাকা এবং ঈদের তিন দিনে গড়ে ১লাখ ২০হাজার টাকা হিসেবে মোট ১লাখ ৭১হাজার টাকা আয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার এ দুই দর্শনীয় ও পর্যটন স্থান থেকে প্রায় ৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। এটি বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। খ্রিষ্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। পাহাড়পুরে সীমানা দেয়াল বরাবর অভ্যন্তর ভাগে সারিবদ্ধ ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে। উত্তর দিকের বাহুতে ৪৫টি এবং অন্য তিন দিকের বাহুতে রয়েছে ৪৪টি করে কক্ষ। কক্ষগুলোর প্রতিটিতে দরজা আছে। এই দরজাগুলো ভেতরের দিকে প্রশস্ত কিন্তু বাইরের দিকে সরু হয়ে গেছে।
পাহাড়পুর সংলগ্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত উল্লেখযোগ্য মূর্তি- বেলে পাথরের চামুন্ডা মূর্তি, লাল পাথরের দন্ডায়মান শীতলা মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণুর খন্ডাংশ, কৃষ্ণ পাথরের দন্ডায়মান গণেশ, বেলে পাথরের কীর্তি মূর্তি, দুবলহাটির মহারাণীর তৈলচিত্র, হরগৌরীর ক্ষতিগ্রস্থ মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের লক্ষ্মী, নারায়নের ভগ্ন মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের উমা মূর্তি, বেলে পাথরের গৌরী মূর্তি, বেলে পাথরের বিষ্ণু মূর্তি, নন্দী মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণু মূর্তি, সূর্য মূর্তি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পতিসর কাচারি বাড়ি। কবি গুরু বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তার শিল্পকর্মগুলো রেখে গেছেন। তার শিল্পকর্ম নিয়ে পতিসরে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র জাদুঘর। জাদুঘরে সংগ্রহে রয়েছে- কবির দেয়াল ঘড়ি, লোহার সিন্দুক, কৃষি ব্যাংকে ব্যবহৃত সিন্ধুক, খাট, টি টেবিল, টি-পট, আয়না, হেলানো চেয়ার, নাগর বোটের এ্যাংকর, স্নানের বাথটাব, বিভিন্ন বয়সের ছবি, পত্নীপুত্র ও কন্যার ছবি কবির স্বহস্তে লিখিত ছয় পৃষ্ঠার চিঠিসহ নানান সামগ্রী। কবীর সানিধ্যপেতে ও তার কর্মগুলো দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে কাচারি বাড়িতে ছুটে আসেন কবি ভক্ত ও অনুরাগীরা।
পাহাড়পুর প্রধান ফটকের পাশে ফাস্ট ফুড ও ঝিনুক মহল দোকানের মালিক মানিক হোসেন বলেন, প্রায় আড়াই মাস থেকে আমাদের দোকান বন্ধ রয়েছে। এতে অনেক পণ্য নষ্ট ও পন্যের মেয়াদ এক্সপেয়ার হয়ে গেছে। ইদুর মালামাল কেটে নষ্ট করে দিয়েছে। এতে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। একদিকে দোকান বন্ধ, অপরদিকে মালামাল নষ্ট এতে প্রায় পথে বসার উপক্রম। আয় রোজগার না থাকায় কষ্ট করে দিন পার করতে হচ্ছে। তার মতো সেখানে প্রায় ১২ জন দোকানীর একই অবস্থা। তিনি বলেন, আমাদের সহযোগীতা করা হবে বলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান তালিকা করে নিয়ে গেছেন। ঈদের আগেই সহযোগীতা করা হবে বলে আশ্বস্থ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ধরনের সহযোগীতা আমরা পাইনি।
পাহাড়পুর জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান আবু সাইদ ইনাম তানভিরুল বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২০১৯ সালের জুলাই হতে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে দর্শনার্থীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় দর্শনার্থীরা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এখন জাদুঘর ও পর্যটন স্থান বন্ধ রয়েছে। ঈদ-উল-ফিরতে জাদুঘর চালু হওয়ার সম্ভবনা নাই। সারা বছরে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হতো দুই ঈদে তার চেয়ে বেশি আয় হয়। করোনা ভাইরাসের কারণে দর্শনীয় স্থান ও জাদুঘর বন্ধ থাকায় সরকার মোট অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে করোনাভাইরাস থেকে জনজীবন স্বাভাবিক হলে আবারও রাজস্ব আয় হওয়া শুরু হবে।
আত্রাই পতিসর কাচারী বাড়ি জাদুঘরের অপারেটর আবুল কালাম হোসেন বলেন, প্রতিমাসে প্রায় প্রায় ১৭ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার রাজস্ব আয় হতো। এছাড়া প্রতি ঈদের প্রথম দিন প্রায় ৩০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় দিন ৫০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় দিনে ৪০ হাজার টাকার মতো রাজস্ব আয় হতো। চতুর্থদিন থেকে আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। করোনাভাইরাসের কারণে এখন বন্ধ রাখা হয়েছে।