মঙ্গলবার ● ২ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » ঢাকা » বাণিজ্যিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে ‘গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ গড়ে তুলতে হবে
বাণিজ্যিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে ‘গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ গড়ে তুলতে হবে
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি, মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি, বামপন্থি ও বিপ্লবীদের করণীয়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে সাপ্তাহিক একতার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এর সাক্ষাৎকার:
একতা: মহামারী আকারে বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো করোনাভাইরাসের উৎপত্তির কারণ কি সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক? নাকি এর পেছনে ‘মনুষ্য সৃষ্ট’ কারণও আছে? থাকলে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কী কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?
সাইফুল হক: করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামে যাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে তা প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে কোনো পশু-পাখি বা বণ্যপ্রাণী থেকে মানুষের দেহে এটি সংক্রমিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মার্কিন বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞসহ দুনিয়াব্যাপী গবেষক ও বিজ্ঞানীরা গত দুই মাস বারবার এটা নিশ্চিত করেছেন যে, অন্ততপক্ষে এটা কোনো গবেষণাগার থেকে সৃষ্ট নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারংবার এটাকে চীনের গবেষণাগার থেকে ছড়িয়ে পড়ার কথা বলে চীনের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। এটাকে তিনি ‘চীনা ভাইরাস’ হিসাবে উল্লেখ করে তার জাতিবিদ্বেষের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের নাগরিকেরা হেনস্তা ও হামলা-আক্রমণের শিকার হয়েছেন। কোভিড-১৯ নির্দিষ্টভাবে অন্য প্রাণী দেহ থেকে কিভাবে মানবদেহে আশ্রয় নিয়েছে আগামীদিনে গবেষক ও বিজ্ঞানীরা তা নিশ্চ্য় বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
তবে এই ধরনের প্রাণঘাতি ভাইরাসের উৎপত্তি ও তার সংক্রমণ ক্ষমতার বিস্তারের সাথে যে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা, প্রাণ-প্রকৃতি-জীব বৈচিত্র বিনাশী কথিত উন্নয়ন ও সভ্যতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে সচেতন মানুষের কাছে এখন তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে যেভাবে পৃথিবীর দেশে দেশে, মহাদেশে মহাদেশে নির্বিচারে প্রকৃতিকে উজাড় করা হয়েছে, প্রাণ-প্রকৃতি-জীব বৈচিত্র্য বিনষ্ট করা হয়েছে, মাটি, পানি, বায়ু বিষাক্ত ও দূষিত করে প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য ধ্বংস করা হয়েছে তার সাথে প্রাণ সংহারি করোনা ভাইরাসের যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। বন-বনাঞ্চল-খাল-বিল-নদী, জলাশয় বিনষ্ট, উজাড় ও দখল করে বায়ুমণ্ডলে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, হিমবাহ গলে যেয়ে সাগরের জলরাশির উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতি অসংখ্য ধরনের বেপরোয়া তৎপরতার মধ্য দিয়ে মানুষ ও তার অস্বিত্বকেই বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। কোটি কোটি জীব- অনুজীব,পশু-পাখি-বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রকে একদিকে বিনষ্ট আর অন্যদিকে এসবের উপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের জীবন, জীবিকা, খাদ্যাভাসসহ জীবনযাপন। প্রতিক্রিয়ায় অনিবার্যভাবে সৃষ্টি হয়েছে মানুষের সাথে পশু-পাখি-বন্য প্রাণীসহ জীব-অনুজীবের বিরোধ -বৈরীতা-সংঘাত। এর ফলে উন্মুক্ত হয়েছে নানা ধরনের ভাইরাসের পথ; কোনোটা মারাত্মক প্র্রাণঘাতি, হয়তো কোনোটা এতটা প্রাণঘাতি নয়। নিকট অতীতে ২০০৩ সালে সার্স মহামারীর পর বিজ্ঞানীরা এই ধরনের আরো মারাত্মক ভাইরাসের উৎপত্তির ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সরকারসমূহকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে দুনিয়ার কোনো মাতব্বরেরা তা আমলে নেয়নি।
বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম ছাড়া পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন, শিল্প সভ্যতা ও উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে সর্বোচ্চ মুনাফা, নতুন নতুন বাজারের বিস্তৃতি, যে কোনোভাবেই পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন-পুনঃউৎপাদনের সাইকেল অক্ষুন্ন রাখা। উদ্দাম ভোগবাদীতা এখানে মূল প্রণোনা। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ আর তাদের শ্রমশক্তি পুরো প্রক্রিয়ায় পণ্যমাত্র। পুঁজি এখানে ঈশ্বরতুল্য । পুঁজিতন্ত্রের বিশ্ব মোড়লেরা এই জন্যে করতে পারে না হেন কোনো কাজ নেই। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত মানবিক ও উন্নত জীবন তাদের কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে পুঁজিতান্ত্রিক কর্পোরেটসমূহের নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করা। এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মতাদির্শক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বাতাবরণও তারা তৈরি করে নেয়।
করোনা ভাইরাসের মত মারাত্মক ভাইরাসসমূহের উৎপাদনের সাথে বিদ্যমান আত্মঘাতি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও উন্নয়নের রাজনৈতিক দর্শনের যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে তা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়।
একতা : প্রাণঘাতী এ ভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বের ও আমাদের দেশের প্রস্তুতি কেমন ছিল? আমাদের দেশে সরকারি কোন্ কোন্ অব্যবস্থাপনাকে আপনার ক্ষমার অযোগ্য মনে হয়েছে?
সাইফুল হক: করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের ও বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কার্যকরি কোনো প্রস্তুতি ছিল না বললেই চলে। তবে দুই দশকে সার্স, মার্স ও ইবোলা ভাইরাসের স্থানীয় পর্যায়ে মহামারীকালে বিজ্ঞানী গবেষকরা আরো নতুন নতুন প্রাণ সংহারী ভাইরাসের উদ্ভবের ব্যাপারে বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকারসমূহকে বারবার সতর্ক করলেও এটাকে তারা যে বিশেষ কোনো আমলে নেয়নি তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই; যে কারণে এই ধরনের ভাইরাস মোকাবেলায় গোটা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যেভাবে ঢেলে সাজানো, বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, মাস্ক, সেনিটাইজার, ভেন্টিলাইজারসহ পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার-নার্স-চিকিৎসা কর্মী প্রভৃতি রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি বিশেষ মনোযোগ পায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যখাতের বাজেট খুবই সীমিত। আর বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশেই স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মূলগতভাবে মুনাফাভিত্তিক ব্যক্তিগতখাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এবার এর পরিণতি হয়েছে ভয়ংকর। করোনা চিকিৎসায় অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে আসছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর এবং এই বছরের ১০ জানুয়ারি চীন আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববাসীকে এই ভাইরাসের প্রাণঘাতী সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর পরও ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ দেশ সংক্রমণ সামাল দিতে পর্যাপ্ত সময় পেলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ভাইরাস নিয়ে চীন বিরোধী রাজনীতিতে যে সময় দিয়েছেন তা যদি তিনি দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় দিতেন তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের করোনা পরিস্থিতি এত ভয়াবহ রূপ নিত না।
বাংলাদেশে এই ভাইরাস মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে আমরাও প্রায় দু’মাস সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু এই সময়টা যথাযোগ্যভাবে কাজে লাগানো যায়নি। শুরু থেকেই আমাদের এই ব্যাপারে ‘গা ছাড়া ভাব’ ‘দেখি কি হয়’ এই জাতীয় মনোভাব কাজ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিজ্ঞানীদের হুশিয়ারীকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বরং সরকারের নীতি-নির্ধারকদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশে তারা এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতাকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। এখনও দিচ্ছেন তাও মনে হয় না।
দেশের সমগ্র স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, ছত্রভঙ্গ ও বেহাল দশাকেই বলতে হবে সরকারের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালকে এখনও করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসায় যুক্ত করা যায়নি। আর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে দেশে এখনও শক্তিশালী কিছু গড়ে উঠেনি।
একতা: এমন সংকটকালে বামপন্থি ও বিপ্লবীদের করণীয় কী? সরকারের অযোগ্যতার সমালোচনা করার পাশাপাশি তাদের আরও কিছু করার আছে কি? সেসব কতোটা আপনারা করছেন?
সাইফুল হক: করোনা মহামারীকালে দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশে এখন বামপন্থি ও বিপ্লবীরা ক্ষমতায় না থাকলেও এই দুর্যোগে তাদের বিশেষ দায়িত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। অতীতের মহামারী, দুর্বিপাকে এদেশের বাম প্রগতিশীল শক্তি তাদের সর্বস্ব উজাড় করে মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। মানুষের ভরসার জায়গা হিসেবে প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মানুষকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সামাজিক ও গণ উদ্যোগ জোরদার করে সংকট উত্তরণের চেষ্টা করে আসছে। করোনার এই মহামারীকালেও বামপন্থি বিপ্লবীরা তাদের সামর্থে্যর সবটুকু দিয়ে মহামারী দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। গত চার মাস ধরে বাংলাদেশের বাম প্রগতিশীল শক্তি, তাদের নেতা, কর্মী-শুভ্যার্থীরা এই কাজই করে আসছেন। প্রথমদিকে ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা, সেনিটাইজার ও মাস্ক সরবরাহ করা, বারবার হাত ধোয়ায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, দ্বিতীয় দফায় ডাক্তারসহ চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি সহজলভ্য করা এবং করোনা দুর্গত শ্রমজীবী- মেহনতি-দিনমজুর-বস্তিবাসী ও স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের খাদ্য ও ত্রাণ সমগ্রী পৌঁছে দেবার কাজ এখনও তারা অব্যাহত রেখেছেন। এই দুর্যোগকাল পার না হওয়া পর্যন্ত বামপন্থিরা এই মানবিক দায়িত্ব অব্যাহত রাখবেন।
বামপন্থিদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ হচ্ছে সরকার যাতে জনগণের প্রতি তার দায়দায়িত্ব পালন করে সে ব্যাপারে বাধ্যবাধকতার পরিস্থিতি তৈরি করা।
মহামারীজসনিত জাতীয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংকীলর্ণ দলীয় অবস্থান থেকে সরকারের ‘একলা চলো নীতির’ বিপদ সম্পর্কে তাদেরকে বারবার সতর্ক করা এবং পরিস্কার করে বলা যে, এখন দলবাজীর সময় নয়।
দেশের সমগ্র স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় গুরুতর সমন্বয়হীনতা, চুড়ান্ত অব্যবস্থাপনা, আধা নৈরাজ্যিক বেহাল পরিস্থিতি তুলে ধরা।
সাধারণ ছুটি ও লকডাউন নিয়ে সরকারের পরস্পর বিরোধী, আত্মঘাতী নীতি কৌশলের বিপজ্জনক দিকসমূহ তুলে ধরা।
স্বাস্থ্যগত মহামারী যে অর্থনৈতিক দুর্যোগ সৃষ্টি করেছে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকা যে গভীর অনিশ্চয়তায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে তার বাস্তব পরিস্থিতি সরকার ও জনসমক্ষে তুলে ধরা।
দুর্যোগ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের অর্থনৈতিক প্যাকেজ, খাদ্য-ত্রাণ সামগ্রী ও নগদ অর্থ বণ্টন প্রকল্পের ফাঁকি, চুরি, দুর্নীতি, দলীয়করণ ও জালিয়াতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি বা গণতদারকি কমিটি গঠন করে যাবতীয় অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করা, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ-আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা, যাতে এসব বিক্ষোভ নৈরাজ্যিক চেহারা না নেয় এবং সর্বোপরি মহামারী দুর্যোগ নিয়ে সরকারের ভুল নীতি কৌশল তুলে ধরে প্রতিটি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিকল্প প্রস্তাবনা ও করণীয় তুলে ধরা এবং এই আলোকে সরকারের কাছে দুর্যোগ উত্তরণের পথ তুলে ধরা। পাশাপাশি এই সমুদয় প্রস্তাবনা ও করণীয় এর ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা।
আমরা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে শুরু থেকেই এই মহামারীর বিপদ এবং সরকারের করণীয় ও মানুষের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছি। মাস্ক ও স্যানিটাইজার সরবরাহ, হাত ধোয়া কার্যক্রমে মানুষকে যুক্ত করার কাজ করেছি। আমরা কিছু ঔষধ পিপিইসহ চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। শুভ্যার্থী ও দরদীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ এবং চাল, ডাল, তেল সংগ্রহ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, সাটুরিয়াসহ সারাদেশে কয়েক হাজার পরিবারের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছি। ঈদের আগে কাপড় চোপড় সংগ্রহ করে কয়েক শত অসহায় পরিবারসমূহের কাছে তা আমরা পৌঁছে দিয়েছি। নেত্রকোনায় পার্টির নেতাকর্মীরা দুই দফায় হাওরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কৃষকদের ধান কেটে দিয়েছেন। আশা করি এসব উদ্যোগ আমরা অব্যাহত রাখতে পারব।
একতা: মহামারী মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া যেত কি? তা হলে কী কী সুবিধা হতো, কী কী অসুবিধা ও ঝক্কি এড়ানো যেত?
সাইফুল হক: করোনা মহামারী মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়াটা জরুরি ছিল, জাতীয় স্বাস্থ্যগত এই দুর্যোগ জাতীয়ভাবেই সামাল দেবার প্রচেষ্টা গ্রহণ আবশ্যক ছিল। সরকারের একার পক্ষে যে অদৃষ্টপূর্ব মহামারীর মত এই দুর্যোগ সামাল দেয়া সম্ভব নয়- ইতিমধ্যে তা প্রমাণিত হয়েছে। সরকার ও সরকারি দলের সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, এতবড় দুর্যোগকালে দলবাজির মানসিকতা ও একলা চলো নীতির কারণেই তা সম্ভব হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণের বিভিন্ন অংশকে আস্থায় নেবার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। বরং এ ব্যাপারে তাদের উন্নাসিকতা এবং এ সংক্রান্ত আহ্বানকে নানাভাবে তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। বিলম্বে হলেও বাম জোট ১৩ এপ্রিল এ সংক্রান্ত যে জাতীয় পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিল কথা দিয়েও সরকারি দলের কেউ সেখানে আসেনি। বাম জোটের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন ছিল; তাহলে হয়তো একটা সময় সরকারকে বাধ্যবাধকতার জায়গায় নিয়ে আসা যেত।
সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে- মহামারী মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের যুক্ত করে শক্তিশালী ও ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি মনিটরিং কমিটি করা যেত, যাদের মতামত ও পরামর্শ অনুযায়ী বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া যেত।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যে সমন্বয়হীনতা, অব্যবস্থাপনা, ঘাটতি ও আধা নৈরাজ্যিক অবস্থা তা অনেকখানি কাটিয়ে ওঠা যেত।
মহামারীজনিত এই পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীদের কাছে খাদ্য, ত্রাণ, নগদ অর্থ পৌঁছানোসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য পদক্ষেপও সফলভাবে গ্রহণ করা যেত। এসব ক্ষেত্রে চুরি, দুর্নীতি, দলীয়করণ বন্ধ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা অনেকখানি নিশ্চিত করা যেত।
দুর্যোগ মোকাবিলা ও দুর্যোগ থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সীমিত সম্পদ ও শক্তি সংগঠিত করে তার যথোপযুক্ত ব্যবহারের পথ প্রশস্ত হত, মানুষের মধ্যে আস্থা জাগিয়ে তুলে আমাদের জনগণের ভিতরকার শক্তিকে অনেকখানি বিকশিত করা যেত। সর্বোপরি করোনা মহামারী দুর্যোগ সম্পর্কে একটা ঐক্যবদ্ধ নীতি কৌশল প্রণয়ন করা সহজ হত।
এই মহাযজ্ঞ এগিয়ে নেবার পথে নিশ্চয় কিছু অসুবিধা ও ঝক্কি ঝামেলার সম্মুখীন হতে হতো। আমাদের গায়ে হয়তো কিছু কাদার ছিটা বা ময়লা এসে পড়তো। কিন্তু এসব এড়িয়েও বিপ্লবী বামপন্থিরা তাদের শ্রেণিগত রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র অক্ষুণ্ন রেখে একটি যুগসন্ধিক্ষণে দেশ ও মানুষের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। একটা পর্যায়ে সরকারের শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে এই সমন্বিত উদ্যোগ যদি মুখ থুবড়েও পড়তো তাহলেও বামপন্থিদের হারানোর কিছু ছিল না। তখন বরং এটা দেশবাসীর সামনে আরো একবার প্রমাণ করা যেত যে জাতির দুর্যোগে দেশের বামপন্থিরা দলীয় রাজনীতির গন্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় কর্তব্য পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছে।
একতা: বৈশ্বিক এ মহামারীর পর, বাস্তব সম্ভাবনার বিবেচনায়, সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে দরিদ্র ও শ্রমজীবীদের স্বার্থে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদে কি কি নীতি-কাঠামোগত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?
সাইফুল হক: এই ব্যাপারে প্রস্তাবসমূহ নিম্নরূপ:
ক) বিদ্যমান দুর্বল, ভঙ্গুর ও বাণিজ্যিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খোল নলচে বদল ঘটিয়ে ‘গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ গড়ে তোলা, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করা। এজন্যে একেবারে ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, ডাক্তার, নার্সসহ যাবতীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা। মহামারীজনিত চিকিৎসার জন্য সর্বস্তরে আলাদা ইউনিটের ব্যবস্থা করা।
খ) দেশের সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যয় সংকুলান নিশ্চিত করতে জাতীয় বাজেটের ৭-৮ শতাংশ বরাদ্দ প্রদান করা।
গ) গ্রামাঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলের সকল শ্রমজীবী-মেহনতি-দিনমজুর-বস্তিবাসী ও দরিদ্র পরিবারসমূহের জন্য শক্তিশালী ‘গণবণ্টন ব্যবস্থা’ গড়ে তোলা যাতে প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য নিশ্চিত করা যায়।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে এই গণবণ্টন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করে প্রতিটি প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসব প্রকল্পের যাবতীয় অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, চুরি, দুর্নীতি, দলীয়করণ রোধে ইউনিয়ন পর্যায়ে গণতদারকি কমিটি গঠন করা; যার অধীনে ২/৩ মাস পরপর এলাকায় গণশুনানীর আয়োজন করা যায়।
ঘ) প্রত্যেক নাগরিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা।
ঙ) অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করাকে সরকারি বাধ্যতামূলক কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা এবং তার জন্যে প্রথমে বর্তমান সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা।
চ) জনগণের, বিশেষ করে শ্রমজীবী ও দরিদ্রদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে স্বশাসিত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহীমূলক শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থা করা।
ছ) এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৩ শতাংশ যে খাতের উপর নির্ভরশীল সেই কৃষক ও গ্রামীণ খাতকে বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার অগ্রাধিকারে নিয়ে আসা। সূত্র : সাপ্তাহিক একতার জন্য সৌজন্য
নিউ ইস্কাটন, ৩১ মে ২০২০