শনিবার ● ৪ জুলাই ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » করোনাকাল : বাজেট, বৈষম্য ও দুর্যোগ উত্তরণের দিশা সম্পর্কে
করোনাকাল : বাজেট, বৈষম্য ও দুর্যোগ উত্তরণের দিশা সম্পর্কে
সাইফুল হক :: করোনা মহামারীকালেও ধনী-গরীবের বৈষম্য আরো মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার পার্থক্য আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। মহামারীর এই দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও পুঞ্জিভবন ঘটছে। দেশের জনগণের এক বড় অংশের আয় ও ক্রয় ক্ষমতা উদ্বেগজনক ভাবে হ্রাস পেয়ে চলেছে। এদেশে করোনার উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের পাশাপাশি দারিদ্রের উৎপাদন-পুনরুৎপাদনও ঘটে চলেছে। আয় ও সম্পদের এই কেন্দ্রীভবন ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে সমাজে শ্রেণীবিভাজন - শ্রেণীমেরুকরণ আরো স্পষ্ট করে তুলছে।৩০ জুন জাতীয় সংসদে ‘সর্বসম্মতিক্রমে ‘পাশ হওয়া ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট এই বিভাজন ও মেরুকরণকে আরো বিস্তৃত করার আইনী সুযোগ ও পরিসরকে যে আরো বাড়িয়ে তুলবে তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার বিশেষ অবকাশ নেই।
করোনার এক অভুতপূর্ব দুর্যোগ উত্তরণে আগামী এক বছরের জন্য যে বাজেট দরকার ছিল তা পাওয়া গেল না। সংসদে অর্থমন্ত্রী যদিও বলেছেন, কোভিড- ১৯ এর কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন, কষ্টে আছেন তাদের জন্য এই বাজেট। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই সরকারের আমলেও প্রচলিত বাজেটে তেলের মাথায় তেল দেওয়া, অর্থাৎ ধনী-বিত্তবান, কালো টাকা ও অবৈধ সম্পদের মালিক এবং সর্বেপরী লুন্ঠনপ্রিয় কথিত পুঁজিপতিদের তোষণের যে নীতি-কাঠামো, অগ্রাধিকার ও বরাদ্দ আগামী অর্থ বছরের বাজেটেও মৌলিকভাবে তা অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে। মহামারীকালেও সরকারের রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি, সামরিক খাতসহ অনুৎপাদনশীল খাতে বর্ধিত বরাদ্দ, কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক সুযোগ অব্যাহত রাখা, বিত্তবানদের আয় ও সম্পদের উপর বর্ধিত কর আরোপ না করা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে চুরি, দুর্নীতি লুট করা অর্থ-সম্পদ উদ্ধারের দৃশ্যমান ও বিশ্ববাসযোগ্য কোন পদক্ষেপ ছাড়াই বাজেট গ্রহণ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির জোরালো ও যুক্তিগ্রাহ্য দাবি সত্ত্বেও মহামারীজনীত দুর্যোগ মোকাবেলা ও দুর্যোগ উত্তরণে স্বাস্থ্য-চিকিৎসাখাত, কৃষি ও গ্রামীন খাত, কর্মসংস্থান এবং আট থেকে দশ কোটি মানুষের কাছে সরাসরি খাদ্য ও নগদ অর্থ পৌঁছানোর মত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অর্থমন্ত্রী তথা সরকারের কার্যকরি মনযোগ পায়নি। এজন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া হয়নি। সর্বোপরি মাননীয় অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে যেভাবে আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুলেছেন তা নিছক কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। আর উচ্চতর প্রবৃদ্ধি যে উন্নয়নের সমর্থক নয় গত চার দশকে বাংলাদেশসহ দুনিয়ার তাবৎ দেশেই তার নজির রয়েছে। প্রবৃদ্ধির ‘চুইয়ে পড়া’ অর্থনীতি যে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই দারিদ্র্য, না খাওয়া, বেকারত্ব, সীমাহীন আয় ও ধন বৈষম্য লাঘব করতে পারেনি তা আর নতুন করে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। এ কারণে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এর মত বিশ্ব সংস্থাগুলো তাদের ঘাড় থেকে প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীক উন্নয়নের ভুতকে অনেকটা নামিয়ে ফেললেও অতীতের ধারাবাহিকতায় দেশের অর্থমন্ত্রী অপ্রয়োজনীয়ভাবে কথিত প্রবৃদ্ধির এই ভুতকে মাথায় রেখে দিয়েছেন। প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীক এই উন্নয়ন ভাবনা যে বাংলাদেশ, বিশেষ করে এখনকার মহামারী দুর্যোগ উত্তরণে বিশেষ কাজে দেবে না তা সরকারকে কে বোঝাবে।
প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রীক এসব উন্নয়ন চিন্তা ও তৎপরতার মধ্যেই বাংলাদেশে প্রায় অবিশ্বাস্য রকম গতিতে অর্থ সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটে চলেছে। গেল ২৪ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে দেশের গণমাধ্যম জানিয়েছে যে, দেশে গত একবছরে কোটিপতিদের সংখ্যা বেড়েছে ৮২৭৬ জন। এই সংখ্যা আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশী। সচেতন কারই এটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, এটি একটি খন্ডিত চিত্র। কোটিপতিদের ক্লাবে নাম তোলার সংখ্যা যে বাস্তবে আরো বেশী হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। গণমাধ্যম প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ব্যাংকের মোট আমানতের ১২ লক্ষ ১৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকার মধ্যে কোটিপতিদের আমানতই হচ্ছে ৪৩.৩৯ শতাংশ। মোট আমানতে কোটিপতিদের অংশীদারিত্ব যে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে তাও স্পষ্ট। গেল মে মাসে যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স বাংলাদেশ সম্পর্কে চমকে যাওয়ার মত আরো তথ্য হাজির করেছে। তাদের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে যেসব দেশে স্বল্পসংখক লোকের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে এরকম দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শীর্ষে। বাংলাদেশ সরকার বা সরকারের সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান এই তথ্য চ্যালেঞ্জ করেছেন এমন কোন সংবাদ এই পর্যন্ত নেই। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের অর্থ জমা রাখার প্রবণতা গত এক বছরে কিছুটা হ্রাস পেলেও গত এক যুগে অর্থ জমানোর গতি উর্ধ্বমুখী। আগে সুইস ব্যাংকে আমানতকারীদের তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার যে ধারা ছিল তা এখন তুলে দেয়া হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানা ও তা প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। আর অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা জানাচ্ছেন গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে; যা বর্তমানে দেশের গোটা অর্থবছরের বাজেটের কাছাকাছি।
এর বিপরীত চিত্র সম্পর্কে কদিন আগে বিআইডিএস এর গবেষণা জরীপের তথ্যে উঠে এসেছে যে করোনা মহামারীর তিন মাসে দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে এসেছে। তারা জানাচ্ছেন এই সময়কালে শহরাঞ্চলে শ্রমজীবীদের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ, আর গ্রামাঞ্চলে ১০ শতাংশ। আর করোনা দুর্যোগের আগে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ১৭ শতাংশ, নতুন করে বেকার হয়েছেন ১৩ শতাংশ মানুষ। মহামারীর এই দুর্যোগে চাকুরী বা কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হওয়া মানুষ মিলে এখন ছয় কোটির উপর মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নীচে বিবেচনা করা হচ্ছে। করোনা দুর্যোগ যদি এইভাবে আরো চার/ছয় মাস অব্যাহত থাকে তাহলে আরো দেড় থেকে দুই কোটি মানুষ যে দারিদ্রসীমার নীচে নেমে আসবেন সে আশঙ্কার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এর মধ্যে আবার রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলসমূহ বন্ধ হয়ে গেলে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক নতুন করে বেকারের খাতায় নাম লেখাতে যাচ্ছে। আর করোনাকালে গ্রামাঞ্চলে পোল্ট্রি, মৎস্য ও দুগ্ধ খামারসহ ছোট ও মাঝারি শিল্পের ক্ষতি প্রায় লক্ষ কোটি টাকা। এসব শিল্পের সাথে যুক্ত উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি চরম বিপাকে পড়েছে এসবের সাথে যুক্ত কয়েক লক্ষ মানুষ।
জীবিকা ও আয় হারিয়ে ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকা, চট্টগ্রাম শহর ও শিল্পাঞ্চল থেকে গ্রামে ফিরছেন। সদ্য গৃহীত বাজেটে এই বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠির খাদ্য, নগদ অর্থ ও আত্মকর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় মনযোগ ও কার্যকরি বরাদ্দ নেই। যেটুকু যা বরাদ্দ আছে তার এক বড় অংশ চুরি, দুর্নীতি, দলবাজী ও জালিয়াতির কারণে মানুষের কাজে আসছে না। মহামারীর সুযোগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুরি, দুর্নীতি আর জালিয়াতিও চরমে উঠেছে।
করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসা কেন্দ্র করে অনিয়ম-দুর্নীতি বহুল আলোচিত। কিন্তু এসবের জন্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়নি, কারও বিরুদ্ধে কার্যকরি কোন শাস্তি প্রদান করতেও দেখা যায়নি। করোনা দুর্যোগে সরকারি ত্রাণ ও নগদ অর্থ প্রদানের কর্মসূচিও অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে নিমজ্জিত। করোনা মহামারীকে অনেকেই দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। মুনাফাখোর বাজার নিয়ন্ত্রণকারী থেকে শুরু করে গৃহীত মেগা প্রকল্প, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও অনিয়ম, চুরি, দুর্নীতি নতুন মাত্রা নিয়েছে। অতীতেও দেখা গেছে এদেশে মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনেকেই দ্রুত বিশাল মুনাফা, আয় ও সম্পদ গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেছে। এখনও তার ব্যত্যয় নেই। বস্তুত: মহামারী দুর্যোগে সীমাহীন বিপাকে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন প্রাণ হারায়, কোটি কোটি মানুষ যখন নিঃস্ব থেকে আরো নিঃস্ব হয়, তখন এক শ্রেণীর মানুষ নানাভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করে দ্রুত ফুলে ফেপে ওঠে, তৈরী হয় নতুন বিত্তবান গোষ্ঠি, সুযোগ সন্ধানী লুটেরাদের নতুন নতুন অংশ। বিদ্যমান রাষ্ট্র, ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কাঠামো কোন না কোনভাবে এদেরকে মদদ যোগায়। করোনাকালে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রে আমরা আবার এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি।
এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, অতীত সরকারসমূহের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের কথিত উন্নয়নের রাজনীতি সমাজে সীমাহীন বৈষম্য লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে তুলছে। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে; ১৭ কোটি মানুষের দেশকে লুটপাটের এক ধরনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছে। আমাদের মহান স্বাধীনতার ঘোষণায় বর্ণিত ‘সামম্্মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার বিপরীতে দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চরম কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা যেমন পুরোপুরি কেন্দ্রীভুত, তেমনি অর্থনতিক ক্ষমতাও আজ পুরোপুরি কেন্দ্রীভুত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মাফিয়ারাই এখন সর্বেসর্বা। সরকারের মধ্যে তারা আবার নানা সরকার গড়ে তোলে। কখনও কখনও সরকারকেও এরা জিম্মি করে ফেলে।
শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন-নিপীড়ন, বৈষম্য আর বিভাজনের এরকম একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মহামারী দুর্যোগ থেকে উত্তরণ সত্যিই কঠিন। সে কারণে আশঙ্কা যে আমাদের দুর্ভোগ-দুর্দশাও প্রলম্বিত হবে। কিন্তু দেশের মানুষতো এটাকে নিয়তি হিসাবে মেনে নিতে পারে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষকে যেমন অস্তিত্ব রক্ষায় ঘুরে দাঁড়াতে হয়, বিদ্যমান দশা থেকে মুক্তি পেতে এদেশের কোটি কোটি মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া বোধ করি আর কোন পথ নেই; নিশ্চিতই মানুষ এই পথেই এগিয়ে যাবে; রক্ষা করবে নিজেদেরকে, রক্ক্ষা করবে দেশকে।
২ জুলাই ২০২০
নিউ ইস্কাটন, ঢাকা
লেখক: সাইফুল হক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক