রবিবার ● ১৬ আগস্ট ২০২০
প্রথম পাতা » ঢাকা » জননেতা খন্দকার আলী আব্বাস : বিপ্লব ও বিপ্লবীর মৃত্যু নেই
জননেতা খন্দকার আলী আব্বাস : বিপ্লব ও বিপ্লবীর মৃত্যু নেই
দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি প্রয়াত জননেতা কমরেড খন্দকার আলী আব্বাস
লাল সালাম …
কমরেড খন্দকার আলী আব্বাসের প্রতি বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির শ্রদ্ধাঞ্জলি এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা খন্দ্দকার আলী আব্বাস গত ১৭ আগস্ট ২০১১ বিকাল ৪.৩০ এ ঢাকায় মীরপুরস্থ ডেল্টা ক্যানসার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। তিনি স্ত্রী বেবী আব্বাস এবং দুই পুত্র খন্দকার মোহাম্মদ আলী আগুন ও খন্দকার শওকত আলী প্রতিবাদসহ অসংখ্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ফুসফুসে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য ১৮ আগস্ট তাঁর মরদেহ ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। এরপর তাঁর মরদেহ নবাবগঞ্জ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানেও তার প্রতি সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নবাবগঞ্জ শহীদ মিনার চত্ত্বরে নামাজে জানাজার পর নবাবগঞ্জের কাশিমপুরের নিজ বাড়ীতে তার মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।
ঢাকার নবাবগঞ্জের কাশিমপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। স্কুল-কলেজে বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি ঢাকায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতেও তিনি সঙ্গীত শিক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে মজুলম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর স্থানীয় পর্যায়ে আবদুল হামিদ খান মজলিশ ও মীর মাহবুব আলীসহ বামপন্থী নেতৃবৃন্দ রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংশোধনবাদ বিরোধী লড়াইয়ে চীনের বলিষ্ঠ ভূমিকা, ভিয়েতনাম, কিউবাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লবী সংগ্রামের জোয়ার এবং দেশে আইয়ুব শাহী বিরোধী গণআন্দোলন-গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিপ্লবী ধারায় দ্রুতই তিনি সক্রিয় হয়ে উঠেন এবং ঢাকা-মানিকগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর সংগঠন-আন্দোলন বিকশিত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন পার্টির শত শত কর্মী সংগঠকদের নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানীদের আক্রমনের মুখে জনগণকে রক্ষায় সচেষ্ট হন।
স্বাধীনতা সংগ্রাম কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কারণে পার্টি বিভক্ত হলে তিনি বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম-এল) এর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উঠে আসেন। পরবর্তীতে তিনি সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম-এল) এর ঐক্য প্রক্রিয়ায়ও তিনি নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা পালন করেন। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে তিন পার্টি- বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নামে একীভূত হলে তিনি এই পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে পার্টির বিপ্লবী সত্তা ও বিপ্লবী রাজনীতি রক্ষায় পার্টিকে মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠন করতে কমরেড সাইফুল হকসহ যে পাঁচ নেতা ঐতিহাসিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন কমরেড খন্দকার আলী আব্বাস ছিলেন তাঁর অন্যতম। ২০০৫ এর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে তিনি পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ এ পার্টির অষ্টম কংগ্রেসেও তিনি অসুস্থ অবস্থায় পুনরায় পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন।
এদেশের কৃষক আন্দোলনের সাথে কমরেড আলী আব্বাসের ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তিনি ছিলেন দেশের কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নেতা। ষাট দশক থেকে মওলানা ভাসানীর কৃষক সমিতিতে তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ-মানিকগঞ্জের বিশাল এলাকা জুড়ে তিনি জঙ্গী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে সমাজ বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। তার উদ্যোগে নবাবগঞ্জে কয়েকটি বড় বড় কৃষক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বহু বছর চাষী সমিতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিন পার্টি ঐক্যবদ্ধ হলে তিনি জাতীয় কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৫ সাল থেকে তিনি বিপ্লবী কৃষক সংহতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
গত শতাব্দীর ষাট দশক থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানী প্রায় উপনিবেশিক শাসন- শোষণের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতিসত্তার মুক্তি এবং সামজতন্ত্রের লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক জনতার মৈত্রীর ভিত্তিতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে সংগ্রাম তিনি শুরু করেছিলেন নানা বাধা ও প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে আজীবন সেই সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। ১৯৭২-৭৫ আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, ১৯৭৬-৮১ জিয়ার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, ১৯৯১-২০১০ নির্বাচিত সরকারের নামে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, ২০০৭-০৮ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুখোশে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন-গণসংগ্রামে আপোষহীনভাবে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এরশাদ স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন তার তৎকালীন আবাসস্থল পুরানা পল্টনে রেজিয়া ভিলা (বিএনপি’র বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যালয়) হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের এক বড় কেন্দ্র। দেশের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াই, ৭১’র চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তেল-গ্যাসসহ জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কমিউনিস্ট আন্দোনের নানা ভাগ-বিভক্তি কাটিয়ে উঠে দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থী আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করতেও তিনি উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। ২০০৬ এ গণমুক্তি আন্দোলন ও ২০০৭ এ গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা গঠনের ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সংশোধনবাদী-সুবিধাবাদী ও লেজুড়বাদী প্রবণতা ও মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক কারণে বহুবার কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পার্টি বিভক্ত হলেও বরাবরই তিনি বিপ্লবী ধারার পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শ্রেণী ও গণসংগ্রামের ধারায় জনণের সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানকে তিনি বিপ্লবের পথ হিসেবে মনে করলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নির্বাচনকেও তিনি আন্দোলনের একটি রূপ হিসাবে বিবেচনা করতেন। মুজিব সরকারের জারী করা হুলিয়াসহ রাজনৈতিক কারণে প্রায় দশ বছর তাকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। দীর্ঘদিন নানা ছদ্মবেশে থেকে তিনি কৃষক-জনতাকে সংগঠিত করেছেন। আত্মগোপনের সময়কালেই তার সাথে হাজার হাজার মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাষ্ট্র ও সরকারের নানা আক্রমন ও ষড়যন্ত্র থেকে এই মানুষরাই তাকে রক্ষা করেছে।
ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, শ্রীনগর, সিরাজদিখান, সিঙ্গাইর, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জে তিনি ছিলেন গণমানুষের কিংবদন্তীতুল্য নেতা ও সংগঠক। এসব অঞ্চলে জনগণের প্রায় প্রতিটি সংকট আর দুর্যোগে এবং আন্দোলনে বন্ধু ও নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন জনগণের সাথে, সবার আগে। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও তৎপরতাতেও তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের অনেককেই তিনি নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছেন। দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ (ডিএন কলেজ) ও কলাকোপায় ছাত্রাবাসের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি অবিভক্ত ভারতের মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নবাবগঞ্জের আবদুল ওয়াছেকের নামে ‘ওয়াছেক সমিতি ও পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা জেলা-মুন্সিগঞ্জ-মানিকগঞ্জ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এখনকার গুরত্বপূর্ণ নেতাদের এক বড় অংশের রাজনীতির হাতে খড়ি হয়েছে খন্দকার আলী আব্বাসের হাতে। এসব অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে খন্দকার আলী আব্বাস ও তার পার্টি যেমন ছিল পরম বন্ধু ও নির্ভরতার প্রতীক, বিপরীতদিকে গণশত্রু ও গণদুশমনদের কাছে তিনি ছিলেন এক মহাআতঙ্কের নাম। সর্বোপরি তিনি ছিলেন অত্র অঞ্চলের জননন্দিত নেতা। ১৭ আগস্ট তার মৃত্যুর পর ১৮ আগস্ট নবাবগঞ্জ শহীদ মিনারে যারা তার মরদেহ দেখতে পারেননি তাদের যেন আফসোসের শেষ নেই। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে তার কবরের কাছে মানুষ আসছেন কবর জিয়ারত করছেন, পরম শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, অশ্রুপাত করছেন। আজীবন বিপ্লবী একজন মানুষের কাছে বিপ্লব আর শোষিত-নিপীড়িত জনতার এই হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা ছাড়া আর কি চাওয়ার থাকতে পারে।
কমরেড খন্দকার আলী আব্বাস মার্কসবাদী- লেনিনবাদী বিপ্লবী মতাদর্শ ও মাও সে তুং এর বিপ্লবী চিন্তা-অনুশীলনে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণীত ছিলেন। বাংলাদেশের নির্দিষ্ট বাস্তবতায় তিনি বিপ্লবী মতাদর্শের উপলব্ধি, রাজনৈতিক লাইন নির্মাণ ও তার সৃজনশীল অনুশীলনে ব্রতী ছিলেন। তিনি জুতার মাপে পা তৈরীর চেষ্টা করেননি। তার প্রায় পঞ্চাশ বছরের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক জীবনে কয়েকটি পর্যায়ে পার্টি ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করলেও তিনি কখনও গণলাইন পরিত্যাগ করেননি, শ্রেণীসংগ্রাম ভোলেননি, অন্য অনেকের মত সরকার শাসকদের নানা লোভ-লালসার ফাঁদে পা বাড়াননি, আজীবন নিজের ও পার্টির বিপ্লবী সত্তা রক্ষায় নিরলস সংগ্রাম করেছেন। পার্টিকে তিনি নিজেরই বৃহৎ পরিবার হিসেবে মনে করতেন। পার্টি নেতাকর্মীদের জন্য তার ছিল অফুরন্ত ভালবাসা আর প্রবল এক দরদী মন। তরুণ সদস্যদেরকে তিনি সন্তানের মত স্নেহ আর ভালবাসায় গড়ে তুলতে মনযোগী ছিলেন। তার পরিচিত ও কাছের কেউই তার হৃদয়ের এই গভীর উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত হননি।
দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে ৬৬ বছর বয়সে তার বিদায় অকাল মৃত্যুই। তার প্রয়াণে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন তার এক অগ্রণী বীর, সংগঠক ও নেতাকে হারিয়েছে। দেশের কৃষক- খেতমজুরসহ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ হারিয়েছে তাদের এক অকৃত্রিম বন্ধুকে। এই ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি তার প্রয়াত সভাপতি কমরেড খন্দকার আলী আব্বাসের বিপ্লবী আদর্শ ও বিপ্লবী রাজনীতির উত্তরাধিকারকে ধারণ ও এগিয়ে নিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা ধনীকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী সংগ্রামে কমরেড খন্দকার আলী আব্বাস আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে থাকবেন।
কমরেড খন্দকার আলী আব্বাস-লাল সালাম।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি।