সোমবার ● ১৭ আগস্ট ২০২০
প্রথম পাতা » জাতীয় » করোনা সঙ্কট রাজনৈতিক বোধে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে একান্ত সাক্ষাতকারে সাইফুল হক
করোনা সঙ্কট রাজনৈতিক বোধে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে একান্ত সাক্ষাতকারে সাইফুল হক
করোনা সঙ্কট দেশের চলমান রাজনৈতিক বোধের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা ও উপলব্ধি যুক্ত করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, আমি আশা করি- করোনা সঙ্কট রাজনীতির প্যারামিটারে অনেকগুলো নতুন নতুন চিন্তা ও উপলব্ধি যুক্ত করবে। আমরা যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন উৎসাহব্যঞ্জক কিছু যুক্ত করতে পারি তাহলেই নতুন পৃথিবীতে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে পারবো। করোনা হয়তো এই নতুন পৃথিবীর দ্বার উদঘাটনের ক্ষেত্রে একটা সুযোগও সৃষ্টি করেছে। আমরা রাজনীতিবিদরা যদি সেই দূরদৃষ্টি, অভিজ্ঞা ও কান্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে পারি তাহলে দেশের জন্য ভালো কিছুই হবে।
সম্প্রতি দৈনিক যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। করোনাভাইরাস পরবর্তী নতুন পৃথিবী কেমন হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফুল হক বলেন, গত কয়েক শতকে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে মহামারি এসেছে। এগুলোর পরবর্তী সময়ে মানুষ কিছু শিক্ষা নিয়েছে। আবার অনেক বিষয়ে শিক্ষা নেয়নি। কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মতো বিষয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপি গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া এ ধরনের দুর্যোগের সময় অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসার বাইরে থেকে যাবেন। মানুষের সুস্থতা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তায় বিষয়গুলো ভবিষ্যতে মুনাফালোভী সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না। এখানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা আছে। আমার দেশের রাষ্ট্রপতি তিনি যেমন চিকিৎসা পাবেন, আমার শ্রমিক আব্দুল জব্বার তিনিও তেমনই চিকিৎসা পাবেন- এমন একটি মানবিক ব্যবস্থা যদি গড়ে তুলতে না পারি তাহলে সঙ্কটগুলো কিন্তু ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা সংঘাতের রাজনীতির অবসান চাই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার আস্থায় নেবে। দ্রুত জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে গ্রহনযোগ্য জাতীয় নির্বাচন করা এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিভাবে আমরা কার্যকর করতে পারি সেটা ভাবতে হবে। এবার কিন্তু সেই সুযোগ সরকারের সামনে ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের সমালোচনা করাই শুধু বিরোধী দলগুলোর দায়িত্ব নয়। সরকারের ভুল ধরিয়ে দেয়া, বিকল্প সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাকে হাজির করা এবং সেই ভিক্তিতে তাদেরও মানুষের কাছে যাওয়া।
করোনাভাইরাস বা কোভিড ১৯ মোকাবিলায় সরকারের এযাবৎ পর্যন্ত গৃহিত পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তগুলো কি যথাযথ ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা দেখছি শুরু থেকেই সেখানে একটা সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনা ছিল। এই সংক্রমনটাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার যে প্রয়োজন ছিল সেখানে উপলব্ধির একটা খাটতি ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। ৬ মাস পরেও এখনো আমরা অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতকে দূর করতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি- রাজনৈতিক ভাবে এর দায়-দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়েরও একটা বড় দায়-দায়িত্ব আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও এই সময়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারেননি। সরকার সচিবকে সরিয়ে দিয়েছে, ডিজিকে অপসারণ করেছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যক্তিকে পরিবর্তন করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। আমি মনে করি- স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ না করলে ওনাকে পদ থেকে অপসারণ করতে হবে। বর্তমানে সরকার হার্ড ইমিনিটির অঘোষিত তত্ত্ব দারা সরকার উদ্বুদ্ধ কী-না আমি সেটা জানি না। তবে এ ব্যাপারে আমার আশঙ্কা আছে। কিন্তু সেটা খুবই ভয়ানক এবং বিপদজনক। জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল কোনও সরকার এ ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে না।
স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের জিডিপির কমপক্ষে ৫শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে দেয়া দরকার ছিল। আর জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ। এটা আমরা আমাদের বাম গণতান্ত্রিক জোট থেকেও বলেছি। কারণ সব কিছুই তো মানুষের জন্য। মানুষ যদি বাচে তাহলেই তো উন্œয়ন থেকে শুরু করে সব কিছু। এই সময়ে বরং অনেকগুলো মেগা প্রসঙ্গে বরাদ্দ হ্রাস করতে পারতেন। আমি আশা করি সরকারের বোধদয় হবে। করোনা মোকাবিলায় পৃথিবীতে উদাহরণ যেগুলো আছে, সেই ইতিবাচক অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি মনে করি সরকারের সামনে এখনও সুযোগ আছে।
করোনার মতো এতো বড় সঙ্কটেও দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তি সমন্বিতভাবে কেন কাজ করতে পারলো না? এখানে কি কারও সদিচ্ছার অভাব ছিল? জবাবে তিনি বলেন, ১৩ এপ্রিল বাম জোট জাতীয় পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিলাম। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোট, বাম জোটসহ যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদীদের দল ছাড়া আমরা কিন্তু সবাইকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনও প্রতিনিধি শেষ পর্যন্ত আসে নাই। আমরা বলেছিলাম- জাতীয় দুর্যোগকে জাতীয়ভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। সেজন্য আমাদের সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করবো। সেখানে সরকারের দায়িত্ব ছিল সকল বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া। সকলকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি করা যেত। একটা পরামর্শ কমিটি দাড় করাতে পারতেন। তাহলে মানুষে মধ্যে একটা বল বা ভরসার জায়গ আসতো। এমনকি সরকারের দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতাও চিহ্নিত করা সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তবে সরকার একলা চলো নীত অবলম্বন করলো।
তিনি আরও বলেন, গত নির্বাচন যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, সেখানে এবার সরকারের সামনে বড় একটা সুযোগ ছিল করোনা মহামারী ও এখন যে বন্যা চলছে, এই দুর্যোগগুলোকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করা, আলোচনা করা বা কথা বলা। সকল বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া। তাহলে সরকারের গ্রহনযোগ্যতার যে প্রশ্নটা আছে, তার অনেকখানি সামাল দেয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ ছিল। কিন্তু সরকার সেটাতে কর্নপাত করেনি। এক ধরনের গায়ের জোরে সব কিছু করছে। তারা মনে করেছে যেভাবে ক্ষমতায় আছেন, সেভাবেই গায়ের জোরেই করোনাকেও মোকাবিলা করবেন। কিন্তু সব কিছু তো আর গায়ের জোরে করা যায় না।
সরকারের আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা প্রসঙ্গে সাইফুল হক বলেন, রাষ্ট্র একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ একটা পুরোনা ঐতিহ্যবাহি রাজনৈতিক দল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনে ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সরকারে এসেছেন, যেভাবে দিনের ভোট রাতে করেছেন। যেভাবে প্রশাসনের উপর নির্ভর করে তাদেরকে আবার ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। এ কারণে পুরো রাষ্ট্রে একটা ঐতিহ্যবাহি দল হিসেবে সরকার পরিচালনায় তার যে কর্তৃত্ব, নৈতিক জোর থাকার দরকার ছিল দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত নির্বাচনের পরে সেটা এখন অনেক দুর্বল। অনেকখানি কম। যে কারণে সরকারের কোনও কথা কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে না। আস্থার মধ্যে রাখতে পারে না। এটা আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক পরাজয়। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল। দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভোটের অধিকার তো আগেই কেড়ে নেয়া হয়েছে। এখন ডিজিটাল নিরাপত্ত্বা আইনের কথা বলে কবি লেখন সাংবাদিক থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষকে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
হাসিবুল হাসান।