সোমবার ● ২৪ আগস্ট ২০২০
প্রথম পাতা » কুষ্টিয়া » কুষ্টিয়া ডিসি কার্যালয়ে নিয়োগে সনদ ও বয়স জালিয়াতির অভিযোগ
কুষ্টিয়া ডিসি কার্যালয়ে নিয়োগে সনদ ও বয়স জালিয়াতির অভিযোগ
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি :: জেলা প্রশাসকের দপ্তরে ১৬ বছর ধরে বিনাবেতনে চাকরি করে আসছেন রেজাউল ইসলাম। স্থানীয়ভাবে যাকে ওমেদার বলে। সিনিয়র হিসেবে এবার নিয়োগ পাওয়ার তালিকায় তার অবস্থান দ্বিতীয় ছিল। টাকা দিতে না পারায় তার চাকরি না হলেও জেলা প্রশাসকের বাসার বাবুর্চির ছোট বোন, বালুঘাট থেকে ডিসির হয়ে টাকা আদায়কারী দু’জনসহ অন্য স্টাফদের ভাইবোনের চাকরি হয়েছে কর্মচারী পদে। এছাড়া বাইরে থেকে কয়েকজনের চাকরি হলেও মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। নিয়োগে অনিয়ম হওয়ায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না।
কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে বাবুর্চির কাজ করতেন কুমারখালী উপজেলার উত্তর সাওতা গ্রামের বিল্লাল হোসেন। বর্তমান জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন যোগদানের পর তাকে সার্কিট হাউস থেকে তার সরকারি বাংলোতে নিয়ে যান। এবার নিয়োগে তার ছোট বোন সাবিনা ইয়াসমিন বেলির চাকরি হয়েছে। তবে এ চাকরি নিতেও নানা জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে বয়স ও সনদ জালিয়াতি করে এ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বেলি কুমারখালী উপজেলার লাহিনী এলাকার মীর মশাররফ হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস দেখিয়ে সনদ জমা দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে যাওয়া হয় বেলির বাড়িতে। সেখানে তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি জানতে চাইলে বাবা আব্দুল ওয়াহেদ খান বলেন, তার মেয়ে এইচএসসি পাস। এ কথা শুনে বেলির মা বলেন, তিনি জাননে না, তার মেয়ে অষ্টম শ্রেণি পাস। এরপর মীর মশাররফ হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে রেজিস্টার ও হাজিরা খাতা ঘেঁটে সাবিনা ইয়াসমীন বেলির কোনো নাম পাওয়া যায়নি।
স্কুলের শিক্ষক কলিম উদ্দিন বলেন, এ নামে কোনো ছাত্রীর নাম তাদের স্কুলের রেজিস্টার ও হাজিরা খাতায় নেই। সনদ জালিয়াতি করে সে চাকরি নিতে পারে বলে আমার ধারণা। এমন ছাত্রী থাকলে আমার জানার কথা।
রোববার যোগদান করতে ডিসি অফিসে আসেন বেলি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, লাহিনী এলাকার একটি স্কুলে পড়েছি। ২০০৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করেছি। এরপর টাকার কারণে লেখাপড়া হয়নি। পরে উন্মুক্ত থেকে এসএসসি দিলেও পাস করতে পারিনি। তবে লাহিনী মীর মশাররফ স্কুলের খাতায় তার নাম নেই জানালে তিনি সটকে পড়েন।
বেলির কয়েকজন সহপাঠী বলেন, ১৯৯৮ সালের দিকে সে এসএসসি পাস করেছে। সে অনুযায়ী তার বয়স ৩৭ বছরের ওপরে। তবে ৩০ বছরের কম দেখিয়ে সে চাকরি নিয়েছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকরি করেন এমন কয়েকজন জানান, নিয়োগ নিয়ে নানা অনিয়ম হয়েছে। চাকরি পেতে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেদদেন হয়েছে। বিষয়টি সবাই জানলেও কেউ মুখ খুলতে পারছে না। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন বিনাবেতনে চাকরি করছেন এমন অনেকে তালিকার প্রথম দিকে থাকলেও চাকরি হয়নি। আবার তালিকার শেষ দিকে আছে এমন ব্যক্তিরও চাকরি হয়েছে। এমন দু’জন শরিফুল ও আনিস। যারা ডিসির হয়ে বালুঘাট থেকে টাকা তুলতেন।
এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কুমারখালী উপজেলার জিলাপীতলার অবৈধ বালুঘাট থেকে জেলা প্রশাসকের হয়ে প্রতিদিন টাকা তুলতেন শরিফুল ও আনিস। জেলার সব বালুঘাট বন্ধ করে দিয়ে এ ঘাটটি চালু রাখা হয় সড়ক সংস্কার কাজের জন্য। সড়কের জন্য এ ঘাট থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু তোলা হতো। আর কত ট্রাক বালু প্রতিদিন উঠত তার সিরিয়াল হিসাব রাখত শরিফুল ও আনিস। তাদেরও চাকরি হয়েছে। তাদের বয়সও ৩০ পার হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। একইভাবে ডিসি অফিসে কর্মরত কামরুল নামের এক কর্মচারীর ভাই ও বোনের চাকরি হয়েছে। এদের একজন মিলন ও অন্যজন জান্নাতুল ইসলাম জ্যোৎস্না। পাশাপাশি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের বাড়িতে কাজ করতেন হেলাল উদ্দিন। তারও চাকরি হয়েছে। এমন আরও কয়েকজন চাকরি পেয়েছেন।
শরিফুলের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এসএ শাখায় দাঁড়িয়ে কথা হলে বলেন, আমরা ট্রাকের সিরিয়াল হিসাব রাখতাম প্রতিদিন। এটাই আমাদের কাজ ছিল।
পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় গত বৃহস্পতিবার রাতে। এতে ১৭ জনের রোল প্রকাশ করা হয়। রোববার অফিসের দিন হওয়ায় কর্মচারী পদে চাকরি পাওয়া অনেকেই যোগদান করতে আসেন। তবে দুপুর পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রেখে আর যোগদান করানো হয়নি বলে জানা গেছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, শূন্য পদে এমএলএসএস ও নৈশপ্রহরী পদে নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এরপর প্রায় দুই হাজার ৬০০ জন ১৬টি পদের বিপরীতে আবেদন করেন। গত ১৬ আগস্ট থেকে তার মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। প্রতিদিন ৫০০ জনের মৌখিক পরীক্ষা নেন তিন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। গত বৃহস্পতিবার রাতে ফল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে দেওয়া হয়।
যাদের চাকরি হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্টাফদের আত্মীয়স্বজন ও ডিসির কাছের মানুষ। এদের চাকরি হলেও অর্থ লেনদেন হয়েছে। ডিসির বাড়ির বাবুর্চি বিল্লালের মাধ্যমে বেশিরভাগ লেনদেন হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বিষয়টি জানতে চেয়ে বিল্লালের মোবাইলে কল দিলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে লাইন কেটে দেন।
এদিকে, ১২-১৬ বছর বিনাবেতনে চাকরি করে চাকরি না হওয়ায় হতাশ অনেকে। অথচ সাত থেকে আট বছর চাকরি করেও শুধু ডিসির কাছের লোক হওয়ায় তাদের ভাগ্যে চাকরি জুটেছে। এর মধ্যে অনেকের বয়স পেরিয়ে গেলেও সনদ জালিয়াতি করে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড থেকে ১৩ জনের একটি তালিকা দেওয়া হয়। পাশাপাশি ওমেদারদের পক্ষ থেকেও ১৩ জনের একটি তালিকা দেওয়া হয় জেলা প্রশাসকের কাছে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার মাত্র একজনের চাকরি হয়েছে। এ কোটায় মোট তিনজনের চাকরি হলেও তাদের টাকা দিয়ে চাকরি নিতে হয়েছে বলে জানা গেছে। বাকিদের অনেকে যোগ্য থাকার পরও চাকরি হয়নি। ওমেদারদের তালিকা থেকে চাকরি হয়েছে পাঁচজনের। এর মধ্যে প্রথম দিকে থাকা বেশ কয়েকজন বাদ পড়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল আলম টুকু বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে ১৩ জনের তালিকা দেওয়া হলেও মাত্র একজনের চাকরি হয়েছে। তবে নানা অনিয়মের বিষয়টি কানে আসছে। অনিয়ম হলে তা দুঃখজনক।
নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ওবাইদুর রহমানের কাছে অনিয়মের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোনো অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই। যারা যোগ্য, তাদের চাকরি হয়েছে। ওমেদারদের যারা বাদ পড়েছেন, তারা পর্যায়ক্রমে নিয়োগ পাবেন।
নিয়োগের বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ডিসি যাকে যোগ্য মনে করেছেন, তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।