শনিবার ● ২৯ আগস্ট ২০২০
প্রথম পাতা » কুষ্টিয়া » বিশ্বের ৫ লক্ষ সাংবাদিক ছিল আমাদের পক্ষে : সে দিন আমরা যদি দালালী করতাম তা হলে কি হত ?
বিশ্বের ৫ লক্ষ সাংবাদিক ছিল আমাদের পক্ষে : সে দিন আমরা যদি দালালী করতাম তা হলে কি হত ?
শামসুল আলম স্বপন :: ২০০৫ সালের ১৩ জুলাই সকাল ৯টার দিকে দৈনিক আজকের আলো পত্রিকার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জামাল উদ্দীন হায়দারী আমার বাসায় এসে খামে ভরা একটি চিঠি হাতে দিয়ে বললেন, আজ ভেড়ামারা ও মিরপুরে গণসংযোগ করবেন নব্য বিএনপি নেতা শিল্পপতি এম,এ, খালেক । তিনি বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে এবার কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। তার নিউজ কভারেজের জন্য দাওয়াত দিয়েছেন আমাদেরকে । তখন ওই আসনের এমপি ছিলেন অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম অধ্যাপক শহীদুল ইসলামের সমর্থকরা এম,এ, খালেককে প্রতিহত করবেন। তাকে গণসংযোগ করতে দিবেন না । আমি তখন দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকার কুষ্টিয়া প্রতিনিধি । বার্তা সম্পাদককে বিষয়টি জানানোর পর তিনি নিউজ কভারেজের জন্য ঘটনাস্থলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।
আমি, জামাল উদ্দিন হায়দারী, প্রথম আলোর কুষ্টিয়া প্রতিনিধি তারিকুল হক তারিক, মানবজমিনের ষ্টাফ রিপোর্টার হাসান জাহিদ,দৈনিক ইত্তেফাকের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি প্রভাষক মুস্তাফিজুর রহমান মঞ্জুসহ কয়েকজন সাংবাদিক একটি মাইক্রো নিয়ে রওয়ানা হলাম ভেড়ামারার দিকে । ভেড়ামারা পৌছে বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি ভয়াবহ । বিএনপি’র ক্যাডাররা প্রকাশ্যে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে রাস্তার উপর মহড়া দিচ্ছে । শিল্পপতি এম,এ খালেকের খোলা জীফ ঘিরে একের পর এক শ্লোগান দেয়া হ্েচ্ছ । গণসংযোগ বাতিল করে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্যও এম,এ খালেককে আল্টিমেটাম দেয়া হচ্ছে । কিন্তু শিল্পপতি খালেকের সাহস ও মনোবল ছিল অটুট । তিনি তার সফর সঙ্গী কর্মীদের উদ্দেশ্যে বললেন আমাকে যদি শহীদুল ইসলামের ক্যাডার বাহিনী খুন করার চেষ্টা চালায় তবুও গণসংযোগ বাতিল করা হবে না।
পরিস্থির ভয়াবহতা আচঁ করতে পেরে আমরা শিল্পপতির গণসংযোগ বহরের আগে অবস্থান নিয়ে মিরপুর উপজেলার সামনে পৌছালাম। শিল্পপতি এমএ খালেকের গাড়ি বহর আমাদের পেছনে। এমন সময় বিএনপি নেতা রহমত আলী ও তার ভাই যুবদল নেতা ইব্রাহিম শত শত ক্যাডার নিয়ে ঘিরে ধরলো আমাদের। আমরা সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তারা আমাদের মাইক্রো ছেড়ে দিলেন । এরপর তারা অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ঝাঁফিয়ে পড়লেন শিল্পপতি এম,এ ,খালেকের গণসংযোগ বহরে। ক্যাডার বাহিনী ৪/৫টি গাড়ি ভাংচুর করলো । আহত হলেন শিল্পতির সমর্থক অর্ধশতাধিক কর্মী । মিরপুর থানায় খবর দেয়ার পর পুলিশ বাহিনী এসে শিল্পপতি এম,এ ,খালেককে উদ্ধার করলেন । সেই সাথে আহতদের নিয়ে যান মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে । আমরা ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষি হয়ে ফিরে এলাম কুষ্টিয়ায়।
ঘটনাস্থলে আমরা যে সকল সাংবাদিক উপস্থিত ছিলাম তারা যাতে অধ্যাপক শহীদুল ইসলামের বিপক্ষে নিউজ না করি সে জন্য আমাদের কাছে পাঠানো হলো মোটা অংকের অফার । আমাদের সাথে কোন দালাল সাংবাদিক না থাকায় সেদিন এমপি সাহেবের লোকজন সুবিধা করতে পারেনি। পরের দিন আমাদের সকল পত্রিকায় প্রকৃত ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রচন্ড চাপের মুখে পড়লেন এমপি সাহেব। তার সকল রাগ পড়লো মিডিয়া কর্মীদের উপর । একই দিনে ৭টি মিথ্যা চাঁদাবাজির ঘটনা সাজিয়ে মামলা দেয়া হলো আজকের আলো পত্রিকার সম্পাদক গাজী মাহবুব রহমান, জামাল উদ্দিন হায়দারী, তারিকুল হক তারিক, হাসান জাহিদ ও আমার নামে। বিক্ষোভে ফেটে পড়লো কুষ্টিয়ার সাংবাদিক মহল । সে সময় কতিপয় দালাল সাংবাদিক পক্ষ নিল এমপি সাহেবের ।
তৎকালীন পুলিশ সুপার ও সদর থানার ওসি অনুরোধ জানালেন আমরা যেন দ্রুত কুষ্টিয়া ত্যাগ করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আসি । কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবে যেয়ে বিষয়টি জানালাম তৎকালীন সভাপতি এম,এ, রাজ্জাক ভাইকে। তিনি কথা বললেন পুলিশ সুপারের সাথে । তারপর আমাদেরকে বললেন আর দেরী করা ঠিক হবে না। তোমরা রেডি হয়ে আসো ঢাকা যেতে হবে। আমি তোমাদের সাথে ঢাকা যাবো। আমরা এবার ৭জন জিডি করলাম এমপি সাহেব ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ।
দৈনিক ইত্তেফাকের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি প্রভাষক মুস্তাফিজুর রহমান মঞ্জু মামলার আসামী না হয়েও তিনি আমাদের সাথে ঢাকা গেলেন। হাইকোর্টে জামিন ধরা হলে শুনানীর তারিখ নির্ধারণ হলো ২৩ শে জুলাই -২০০৫। এর মাঝে আমরা প্রেসক্লাবের সভাপতি রাজ্জাক ভাই এর নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাব ও বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে গিয়ে সম্পাদক সাহেবদের সাথে অধ্যাপক শহীদুল ইসলামের সাংবাদিক নির্যাতনের বিভৎস কাহিনী তুলে ধরি । ডেইলী ষ্টার, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ইনকিলাবসহ অধিকাংশ পত্রিকায় আমাদের নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরে কেউ সংবাদ প্রকাশ করলেন আবার কেউকেউ সম্পাদকীয় লিখলেন এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে । বিশেষ করে যুগান্তর সম্পাদক গোলাম সরওয়ার তার পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার হারুন অর রশীদকে দায়িত্ব দিলেন এমপি সাহেবের সকল অপকর্ম ধারা বাহিক ভাবে তুলে ধরতে। কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরে অন্যান্য পত্রিকাও ফলাও ভাবে সংবাদ প্রকাশ করে । মজার ব্যাপার হলো দৈনিক যুগান্তরের একটি সংখ্যার কুষ্টিয়া আসা পত্রিকার সকল কপি গায়েব করার কারণে কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি ও ভেড়ামারা প্রতিনিধিকে যুগান্তর পত্রিকা থেকে চাকরিচ্যুৎ করা হয়।
মহান আল্লাহর আশেষ রহমতে ২৩ জুলাই-২০০৫ মহামান্য হাইকোর্ট আমাদের সকলের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন।
২৭ জুলাই ঘটে যায় আমাদের জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ডেইলী ষ্টার-এর প্রথম পাতায় উৎড়ঢ় পযধৎমবং ধমধরহংঃ ৫ শঁংযঃরধ লড়ঁৎহড়ং শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয় ক্ষমতাসীন মহলসহ সারা দেশে। ওই সংবাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি আর্ন্তজাতিক সাংবাদিক সংস্থা ওহঃবৎহধঃরহধষ ঋবফধৎধঃরড়হ ঙভ লঁৎহষরঃং (ও.ঋ.ঔ)এর ৫ লক্ষ সদস্য সাংবাদিক আমাদের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য সরকারে প্রতি চাপ সৃষ্টি করেছেন । ওই দিন বিকেলে রাজ্জাক ভাই এর মোবাইলে কল আসলে তিনি কথা বলতে লাগলেন। মোবাইল ছেড়ে দিয়েই রাজ্জাক ভাই বললেন, তোমাদের জন্য খুশির খবর আছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শওকত মাহমুদ ভাই ফোন করেছিলেন । তিনি জানালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিদের্শে আগামীকাল সকাল ১০টায় তথ্যমন্ত্রী এম শামসুল হকের কক্ষে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে । ওই বৈঠকে আমাদের সকল কে থাকতে হবে। এত বড় আনন্দের খবর পেয়ে আমাদের সকলে চোখে পানি চলে এলো। ১৩ দিন ঢাকায় । পরিবারের সাথে শুধু মোবাইলে যোগাযোগ । আমরা ভালো থাকলেও সকলে ছিল মনকষ্ট ।
পরের দিন আমরা যথা সময়ে সচিবালয়ে গিয়ে তথ্যমন্ত্রীর কক্ষে উপস্থিত হলাম রাজ্জাক ভাইএর নেতৃত্বে । সেখানে বসা ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি রিয়াজ রহমান সাধারণ সম্পাদক শওকত মাহমুদ। মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আমরা পরিচয় পর্ব সেরে নিলাম। তখনও এমপি অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম আসেননি। মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিক নির্যাতনের কথা শুনলেন । তিনি বললেন আপনারা সৌভাগ্যবান। বিশ্বের ৫ লক্ষ সাংবাদিক আপনাদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিষয়টি সুরাহা করার জন্য। এরই মাঝে মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ এমপি শহীদুল ইলাম। তিনি আমাদের দেখে বললেন ওরা তো সকলেই আমার ছোট ভাই । সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ বললেন তা হলে ওদের সাথে আপনার সর্ম্পক খারাপ হলো কেন ? এ সময় এমপি সাহেব চুপ থাকলেন। সাংবাদিক মঞ্জু এমপি সাহেবের অপকর্মের কথা তুলে ধরতে গেলে তিনি ধমক দিলেন। সাথে সাথে সাংবাদিক শওকত মাহমুদ বললেন উনার সঙ্গে কোন আপোষ নয় । জাতীয় প্রেসক্লাবও নির্যাতিত সাংবাদিকদের পক্ষে ভুমিকা রাখবে। পরিস্থিতি অনেকটা ঘোলাটে হলে মন্ত্রী মহোদয় এমপি সাহেবকে তিরোস্কার করে বললেন প্রধানমন্ত্রী মিমাংশা করে দিতে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কুষ্টিয়ার সাংবাদিকদের সাথে আপোষ না হলে আপনারই ক্ষতি হবে। এমপি সাহেব সরি বলায় মন্ত্রী মহোদয় বললেন আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা তুলে নিতে হবে। আর জাতীয় প্রেসক্লাব ও কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবে দুটি ব্লাক গট দিবেন সাংবাদিকদের আপ্যায়নের জন্য। এ আলোচনার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের সাথে অধ্যাপক শহীদুল ইসলামের উষ্ম সম্পর্ক গড়ে ওঠে ।
আমরা যদি মামলা -হামলার ভয়ে সেদিন এমপি সাহেবের দালালী করতাম তা হলে কি এমন বিরল সম্মান পেতাম ? মনে রাখরে হবে দালালী করে অর্থ উপার্জন করা যায় কিন্তু সম্মান পাওয়া যায় না ।
লেখক : শামসুল আলম স্বপন, সম্পাদক বিজয় নিউজ।