মঙ্গলবার ● ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » পর্যটন » মিনি কক্সবাজারে বর্ষায় নৌ-ভ্রমনে প্রাকৃতির অপরুপ দৃশ্য খুবই নয়নাভিরাম
মিনি কক্সবাজারে বর্ষায় নৌ-ভ্রমনে প্রাকৃতির অপরুপ দৃশ্য খুবই নয়নাভিরাম
নজরুল ইসলাম তোফা :: রূপবৈচিত্রের দেশ, বিনোদনের দেশ, স্বদেশ প্রেমের উৎসের দেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির দেশ, ঋতুবৈচিত্রের দেশ, ষড়ঋতুর মনোরম পরিবেশের দেশ, এই বাংলাদেশ। মনকে খুব বড় করতে হলে প্রকৃতির কাছে যেতেই হয়। মানুষের মনে বিশালতা আসে বা আকাশ কিংবা সমুদ্রের কাছ থেকে। অসীম এ আকাশ বা সমুদ্র মানুষকে বড় হতে শেখায়। সুতরাং এই দেশের প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে সমুদ্র সব সময়ে অনেক পছন্দের একটি জায়গা। ঢেউ খেলানো বিশাল সমুদ্রের জলরাশি কে ভালোবাসে না এমন মানুষকেই যেন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এবার আসা যাক মুল কথায়, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত জীবনান্দদাসের বনলতা সেন খ্যাত এক বৃহৎ ঐতিহাসিক স্থান নাটোর। নাটোর শহরে রয়েছে পৃথিবী খ্যাত নাটোরের কাচাগোল্লা। তাছাড়াও অনেক দর্শনীয় স্পট আছে। তার মধ্যেই দিঘাপতিয়া গণভবন, বঙ্গজল রাজবাড়ী সহ উত্তরে নলডাঙ্গা থানার অন্তর্গত পাটুলের মিনি কক্সবাজার। এই স্থানটি বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় বহুদূরেই অবস্থিত। সাগর দেখতে হলে- এমন অঞ্চলের মানুষকে পাড়ি দিতে হয় বহুদূর পথ। কিন্তু এই অঞ্চলের প্রকৃতি বোধ হয় মানুষকে সমুদ্রের স্বাদ থেকে কখনোই বঞ্চিত করতে চায় না। তাই পুরো নাটোর জুড়েই রয়েছে বাংলাদেশের বড় বিল, তাকে বলা যায় যে, ঐতিহাসিক চলনবিল। নাটোর শহর থেকে ১০ কিমি উত্তরেই রয়েছে হালতির বিল যা বর্ষাকালে পানিতে থৈথৈ করে। দু’চোখ যতদূর যায় শুধুই পানি আর পানি। উপরে নীল আকাশ আর নীচের ঢেউ খেলানো পানি, এই এলাকার মানুষকে সমুদ্রের অভাব পূরন করে দিয়েছে। আর তাই অনেকে আদর করে এই বিলটাকে বর্ষা কালে ‘মিনি কক্সবাজার’ নামেই ডাকে। এই হালতি বিলের চারটি দ্বীপগ্রাম অপূর্ণ সুন্দর। জানা যায় যে, প্রায় ৪০ হাজার একর জমি নিয়ে বিলটি। এই বিলের মাঝে মাঝে আছে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। ব্রিটিশ আমলেই নাকি হালতি পাখির আবাস ছিলো এই খানে। সেখান থেকেই নাম হয় হালতি। বলা দরকার যে, চলনবিলের অংশ হালতির বিল। তবে নাটোরের হালতি বিল সমুদ্রসৈকতের অভাব অনেকটাই পুরণ করেছে এ দাবি করেন এই এলাকার সাগরপিয়াসী মানুষ।
আবার বর্ষা কিংবা বন্যার পানি চলে গেলে চলন বিলের ভিতরে দ্বীপের মত যে ছোট ছোট গ্রাম আছে, সে গুলো আরো মনোমুগ্ধকর হয়। এ নাটোর সদরের উপজেলায় খাজুরা, পিপরুল, মাধনগর, ব্রক্ষপুর ইউনিয়নের বিস্তৃত এলাকা হালতি বিলের অংশ। জানা দরকার যে, বৈশাখ মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত এই বিল এলাকায় ৫ ফুট থেকে ৮ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। তখন দেখা যায় যে, দেশে- বিদেশের হরেক রকম পাখিদের আনাগোনা। প্রাকৃতিক মাছের প্রজননস্থল হিসেবে এমন হালতি বিল বিখ্যাত। আত্রাই নদীর সাথেই হালতি বিলের সংযোগটা আছে। শীত কালে হালতি বিলের যে অংশে পানি থাকে, তা মৎস অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে, উক্ত অভয়ারণ্যে শীত কালে যে মাছ গুলোকে সংরক্ষণ করা হয়- সে গুলো বর্ষাকালে হালতি বিলে ছড়িয়ে পড়ে এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রচুর পরিমান মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। উত্তরাঞ্চলেরই এমন বিলের কারণে উৎপাদিত ছোট- বড় দেশীয় মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু হয়ে থাকে।
হালতি বিলের পাটুল ঘাটে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় হয় সারা বছর তবে ‘বর্ষাকালে বা বন্যার পানি’ এলে খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। বর্ষাতে মাছ শিকার কিংবা নৌকা চালানো এ এলাকার অধিকাংশ মানুষদের ‘প্রধান পেশা’ হয়ে দাঁড়ায়। বিলের অধিকাংশ জমিজমা গুলোই ব্যক্তি মালিকানাধীন। তবে এই অঞ্চলের মানুষদের জমি-জমা পরিমাণে অনেক বেশি। এক ফসলি জমির আয় দিয়েই চলেন তারা। তবে, বর্ষায় হাজার হাজার পর্যটক এদিকে আসায় নতুন আশা দেখছেন গ্রামবাসী। পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে যেন পাটুলের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে অনেক দোকানপাট সহ হোটেল। একটু পরিষ্কার ভাবেই জানানো দরকার, নাটোর শহর থেকেই ‘প্রায় ৮-৯ কিমি’ দূরে সিংড়া উপজেলার পাটুল আসতে হয়। পাটুল এসে অটোরিকশাওয়ালা বলেন, ভাইজান ‘মিনি কক্সবাজার’, বললাম কক্সবাজার সৈকতে পানি কই? তখন বললেন, পানি তো এখন পাবেন না। এটা শুধু বর্ষাকালের ক’মাস থাকে। তাই- না জেনে গিয়ে অনেকে একটু হতাশ হয়েই পড়েন। তবুও ‘মিনি কক্সবাজার’ খ্যাত নাটোরের হালতি বিলের পাটুল ঘাটে বিনোদন পিপাসুর ঢল নামে। “ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার”- ছুটিতে বিভিন্ন বয়সী হাজার হাজার মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে ছুটে আসেন এখানে।
এমন মিনি কক্সবাজারে বর্ষা কালের পানি না থাকলেও বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা নিচ্ছে।যেন সারা বছর এই এলাকায় ‘পর্যটন কেন্দ্র’ চালু থাকে। জানা যায়, সরকার- ২০১৬ সালকে ‘পর্যটন বর্ষ ঘোষণা’ যখন করে, ঠিক তখন এ এলাকার মানুষের নতুন আশা নিয়ে বুক বাঁধে। বিলের মধ্যে ডুবন্ত সড়ক নির্মাণের পর থেকেই যেন এখানকার অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। দিনমজুররা বছরের অর্ধেক সময় “চাষাবাদ ও বাকি সময় নৌকা বেয়ে ভালোমতোই যেন জীবন যাপন করেন। অনেকেই বিল পাড়ে পাড়ে নানা দোকান বসিয়ে বাড়তি আয় করেন। বিলে বর্ষাকালে প্রতি দিন হাজারো মানুষ আসে সমুদ্রসৈকতের স্বাদ নিতে। উত্তরাঞ্চলে তো সমুদ্র নেই, তাই এমন বিলই তাদের কাছে সমুদ্রসৈকত।হালতি বিলের উত্তাল জলরাশি আর ঢেউ যে কারো মন নিমেষেই ভালো করে দেওয়ার মতো। বিলের সামনেরই পাটুল-খাজুরা রাস্তাতে যেতে চোখে পড়বে বড় অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড “পাটুল মিনি কক্সবাজার’। আর একটু পথ ধরে দু’কদম গেলেই- অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের উত্তাল জলরাশি। বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পাটুল থেকেই খাজুরা পর্যন্ত যে রাস্তা আছে সেটাই বেশি আকর্ষণীয়। বর্ষায় যখন পানিতে পরিপূর্ণ হতে থাকে বিল, তখন এই রাস্তার সৌন্দর্যটাও যেন বাড়তে থাকে। আর ঠিক তখন পর্যটকের ভিড়ও বাড়তে থাকে।
বর্ষার অথৈ পানি আর শীতে ফসলি জমির এই বিলটির মাঝ বরাবর ৭ কিমি দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ আছে তা ২০০৪ সালেই নির্মাণ হয়। পানি কমতে থাকে যখন ঠিক তখনই ডুবন্ত সড়ক দেখা যায়। আর তখন সেই রাস্তাতে হেঁটে বেড়ানোসহ বিলের পানিতে সাঁতার কাটা ও নৌকা ভ্রমণ করে সময় কাটান হাজারও মানুষ। কক্সবাজারের আমেজ এখানেই উপভোগ করেন। না গেলে এ সৌন্দর্য বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কংক্রিটের কাঁচা পাকা রাস্তা ধরে একটু এগোতেই চোখে পড়বে দুপাশের বিশালতা। আধা ঘণ্টা পরে নাটোর হতে খোলাবাড়িয়া গ্রামে পৌঁছা যাবে। অদ্ভুত সুন্দর একটি গ্রাম। সব ক্লান্তি, কষ্ট দূর হয়ে যাবে এক মুহূর্তে। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে শুধুই সবুজ আর সবুজ। এমন সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেখতে হলে চোখ বা দৃষ্টিভঙ্গিটাও সুন্দর হতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি ও মনের চোখটা সুন্দর হলেই হয়তো বাংলাদেশের আসল সৌন্দর্যটাকেই উপভোগ করা যাবে। যেকোনো সৌন্দর্যকে উপভোগের জন্য আগ্রহ বৃদ্ধি করা দরকার। মানুষের মন যখন তৃপ্ত হয় তখন অল্প আনন্দে বা বিনোদনে মানুষ সুখী থাকে। মনের প্রশান্তি তাকে তৃপ্ত করে সুখের আবেশে। একজন সুখী, পরিপূর্ণ এবং পরিতৃপ্ত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে তাকে সৌন্দর্য পিপাসু হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চলতে হবে। সুতরাং প্রকৃতিক পরিবেশ দর্শনের মধ্যেই রয়েছে- আত্মতুষ্টি যা মানুষের মনকে প্রফুল্ল রাখে বা সুখী করে।
লেখক : নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।