বুধবার ● ১১ নভেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » ভয়াল ১২ নভেম্বর ৫ কোটি মানুষ উপকূলবাসী আজও কাঁদে
ভয়াল ১২ নভেম্বর ৫ কোটি মানুষ উপকূলবাসী আজও কাঁদে
শেখ সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট প্রতিনিধি :: আগামী কাল ভয়াল ১২ই নভেম্বর ৫ কোটি মানুষ উপকূলবাসী আজও কাঁদে ।এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলার স্বাধীনতার সফলতা। করেবাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে।
বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বহু পরিবার তাদের আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল।আজ ভয়াল ১২ই নভেম্বর ১৯৭০ সালের এই দিনে প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দেশের উপকূলীয় আঞ্চল। ভয়াবহ সেদিনের ৪৮ বছর অতিবাহিত হলেও আজো সে দুর্বিসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় উপকূলের বাসিন্দাদের। উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। এই ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূল। বহু মানুষ প্রাণ হারায়। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন। এই ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
উইকিপিডিয়ার সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়। সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবেও এটিকে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এটির নাম ছিল ‘ভোলা সাইক্লোন’। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ওই ঘূর্ণিঝড়টি ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে।
জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই সময়ে সেখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। একটি এলাকার প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রাণ হারানোর ঘটনা ছিল অত্যন্তহৃদয়বিদারক।
’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে মনপুরা উপকূলে প্রায় ৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে হাজিরহাট ইউনিয়নের পাটোয়ারী পরিবারে ৫৫ জন স্বজন প্রাণ হারায়। এছাড়াও অধিকাংশ পরিবারে ৭-১০ জন স্বজনের প্রাণ যায়। তখন বেতার ও টেলিভিশনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার আজকের মতো জোরদার ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি ছিল না কোন আশ্রয়কেন্দ্র।
নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও এত মানুষের প্রাণহানি হত না বলে মন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মনপুরাবাসীকে সমবেদনা জানাতে হেলিকাপ্টারে ছুটে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রত্যেকটি পরিবারের স্বজন হারানো মানুষের সাথে দেখা করে সমবেদনা জানান। পরে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেন।
বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়টি পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। চলতি বছরের ১৮ মে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতী আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে। তালিকার শীর্ষ প্রাণঘাতী ঘটনা হিসেবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ ঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। সরকারি হিসেবে এতে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যান। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃত্যের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি ছিল।
ঘটনা-১
তোফায়েল আহমেদ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেক পরিবার তাদের আত্মীয়স্বজন, মা-বাবা, ভাই-বোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল। প্রতি বছর আমাদের জাতীয় জীবনে যখন ১২ নভেম্বর ফিরে আসে, তখন বেদনাবিদুর সেই দিনটির কথা স্মৃতির পাতায় গভীরভাবে ভেসে ওঠে।’৭০-এর ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান করি।১ জানুয়ারি ’৭০-এ রাজনৈতিক তত্পরতার ওপর থেকে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহূত হয়। তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ডাকসুর ভিপি। ছাত্রলীগের উদ্যোগে আমার নেতৃত্বে সে দিন প্রথম জনসভা করি পল্টনে। তখনই বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই ভোলা যাবি। সকল এরিয়া সফর করবি। আমি তোকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিবো।’ এই কথাটি ভীষণভাবে আমার হূদয়কে আলোড়িত করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ভোলা সফরে যাই এবং ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট কিছুই ছিল না,—ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক তত্পরতা চালাই। বঙ্গবন্ধু ১৭০০ টাকা দিয়ে একটা মোটরবাইক আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। এই মোটরবাইক ছিল আমার যানবাহন।
সেদিন আমি ছিলাম জন্মস্থান ভোলায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে আসন্ন নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত ছিলাম আমার নির্বাচনী এলাকায়। কয়েকদিন ধরেই গুমোট আবহাওয়া ছিল। বৃষ্টি আর সেই সঙ্গে ছিল ঝড়ো বাতাস। এরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মিয়া, মাওলানা মমতাজুল করিম, মোস্তাফিজুর রহমান মিয়া এবং অন্য নেতাদের নিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকাসহ ভোলায় ব্যাপক গণসংযোগ করি। আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ভোলা থানা, দৌলত খাঁ থানা, তজমুদ্দি থানা। তখন মনপুরা থানা হয়নি। কিন্তু মনপুরার তিনটি ইউনিয়নও আমার নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর একটি এলাকা ছিল বোরাহানউদ্দিন, লালমোহন এবং চরফ্যাশন। আমার নির্বাচনী এলাকাটি বড় ছিল। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু যখন আমাকে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন তখন আমার বয়স মাত্র ২৬।বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঘূর্ণিঝড় দুর্গত-অসহায় মানুষের জন্য এলাকায় এলাকায় ক্যাম্প করে যে ব্যাপক ত্রাণকার্য সেদিন আমি পরিচালনা করেছি তা আমার বাকি জীবনে চলার পথের পাথেয় হয়ে আছে। জাতীয় চার নেতার অন্যতম শ্রদ্ধেয় নেতা তাজউদ্দীন ভাই এক বিরাট লঞ্চভর্তি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ভোলা এসেছিলেন ত্রাণকার্যে। তার থেকে কিছু তিনি বিলি করতে পেরেছেন বাকিগুলো রেখে এসেছিলেন আমার কাছে। সেগুলো আমি বিলি-বণ্টন করেছি। খাবার পানি, মুড়ি, চিঁড়া, ওষুধ-পথ্য বিলি করেছি দুর্গত এলাকায়।
ঘটনা-২
সেদিনের স্মৃতির কথা তুলে ধরে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের প্রত্যক্ষদর্শী মোঃ ইলিয়াছ (৬৫) বলছিলেন, ‘আগের দিন সন্ধ্যায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝে হঠাৎ কালো মেঘের সৃষ্টি। মাইক ও রেডিওতে প্রচার হয়েছে ১০ নম্বর বিপদ সংকেত। রাতেই ৮-১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয় বাড়িঘরের প্রয়োজনীয় মালামালসহ জমিতে উৎপাদিত ধানগুলো, মধ্যরাতে হঠাৎ মুহূর্তের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আক্রমণ করলে মারা যায় আমার মামাতো ভাই।
ওই সময়ে ধ্বংসস্তুপের মাঝে বেঁচে থাকা খুব কঠিন ছিলো’। কমলনগরের আরো একজন আবদুল করিম (৭২) বলেন, ‘৭০ এর ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে ফেনী নদী ও ভূলুয়া নদী থেকে আসা পানি ও ঘূর্ণিঝড়ে মরে যাওয়া বহু মানুষ ভেসে ভেসে চলে গেছেন, তাদের কবর দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব হয়নি।’
ঘটনা-৩
ভোলার দৌলতখান পৌর এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান ’৭০-র ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘সেদিন ছিল মেঘাচ্ছন্ন। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। রাতের বেলা দোকান বন্ধ করে ঘরে এসে ঘুমাতে যাই। এমন সময় দোকানের কর্মচারীরা নীচে ঘুমাচ্ছিল। তারা অনুভব করে বিছানা ভিজতে শুরু করেছে।
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে প্রবলবেগে পানি আসতে দেখে তারা তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে এই খবর দেয়। তখন পরিবারের সকল সদস্যদেরকে নিয়ে ঘরের দোতলায় অবস্থান নেই। পরে যখন পানি কমে যায়, তখন চারদিকে শুধু আর পানি পানি দেখতে পাই। কোন ঘর-বাড়ির চিহ্ন ছিল না।
ঘটনা-৪
ভোলা সদরের আলীনগর ইউনিয়নের সাচিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আলমগীর মাঝি ’৭০-র ঘূর্ণিঝড়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ওই বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। বাড়ি একটু দূরে থাকায় তিনি দৌলতখান বাজারের একটি দোকান ঘরের মধ্যে থেকে পড়ালেখা করছিলেন। রাতে দেখেন প্রবলবেগে পানি আসছে। সেই সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।
এসময় তিনি একাকী কি করবেন ভেবে আশ-পাশের দোকানগুলোতে কোন মানুষের অবস্থান আছে কিনা, তা বুঝতে চেষ্টা করলেন। তার পাশের একটি দোকানের মধ্যে লোকজনের কথা শুনতে পেয়ে সেখানে যেতে মনস্থির করলেন। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে পানির চাপ প্রচণ্ড। এর মধ্যে অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। উপায়ন্তর না দেখে তিনি ওই পানির মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পাশের দোকানের বেড়াটি ধরলেন।
পরে তিনি দোকানের উপরে থাকা লোকজনকে ডাক দিলে তারা তাকে উপরে তোলেন। সকালবেলা তিনি বাড়িতে গিয়ে দেখেন, ঘরগুলো বন্যায় ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। যাওয়ার সময় তিনি পথে পথে হাজারো লোকের মরাদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন।
ঘটনা-৫
মনপুরা উপকূলের সবার মত ’৭০ সালের ২৭ বছরের গর্ভবতী রাহেলা তার স্বামী, ৩ সন্তান, পরিবার-পরিজন নিয়ে গাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ততক্ষনে উপকূল জুড়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হয়েছিল। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঘূর্ণিঝড় প্রকট আকার ধারণ করে। গাছ থেকে পড়ে যায় রাহেলা। খেজুর গাছের পাতা ধরে বন্যার পানি থেকে বাঁচতে লড়াই করেছিলেন রাহেলা।
এক পর্যায়ে রাহেলা অচেনা এক পুরুষের সাথে কাঠের আলমারী ধরে বাঁচার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে স্রোতের টানে রাহেলাসহ অচেনা পুরুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বঙ্গোপসাগরে। ৬ দিন সাগরে ভাসার পর ভারতীয় জাহাজ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম দিয়ে যায়। টানা ১ মাস চট্টগ্রামের হাসপাতালে চিকিৎসা শেষ করে বরিশাল হয়ে মনপুরা আসেন। ঘূর্ণিঝড়ে রাহেলা তার তিন সন্তানকে হারিয়েছেন।
প্রলয়ংকরী ‘ভোলা সাইক্লোন’-এর আগে এবং পরেও উপকূলের উপর দিয়ে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির বিচারে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে ভয়ংকর বলে প্রমাণিত। স্বল্প পরিসরে হলেও এত বছর পরেও ওই দিবসটি পালিত হয়। দিনটিকে স্মরণ করে গণমাধ্যমসমূহ।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ’৭০-এর আগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে। ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জ তথা বর্তমান বরিশাল অঞ্চলে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়। ওই ঘূর্ণিঝড়েও ২ লাখ লোক প্রাণ হারান।
১৯৭০-এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়াবহ। এতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর নিলোফার, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুসহ বেশকিছু ছোটবড় ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। তবে ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা অন্যকোন ঝড় অতিক্রম করতে পারেনি।
১২ নভেম্বর উপকূল দিবসের দাবি
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে, এত দিবসের ভিড়ে কেন আবার ‘উপকূল দিবসের’ দাবি? আমার প্রশ্নটা ঠিক এর বিপরীত। এত দিবস থাকা সত্বেও ‘উপকূল দিবস’ নেই কেন? সমগ্র উপকূল অঞ্চল ঘুরে খবরের খোঁজ করতে গিয়ে এই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছিল কয়েক বছর আগে থেকেই।
খবর লেখার মধ্যদিয়ে আমি প্রতিদিন উপকূলের কথা বলি। কিন্তু একটি দিবস থাকলে অন্তত সবাই মিলে একযোগে উপকূলের কথা বলার সুযোগ পাই! দিন ঠিক করার আগে নিজের কাছে নিজের আরেকটা প্রশ্ন, কেন উপকূল দিবস চাই?
যেকোন দিবস দাবির পেছনে রয়েছে অনেক যৌক্তিকতা। দিবস কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে, দিবস অধিকার আদায়ের কথা বলতে পারে, দিবস পারে জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর জোরালো করতে। কেন উপকূল দিবস চাই- প্রশ্নটির সহজ জবাব হলো, উপকূলের মানুষের কণ্ঠস্বর জোরদার করার মধ্যদিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
একই সঙ্গে প্রতিবছর একটি সুনির্দিষ্ট দিনে উপকূল দিবস পালিত হলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে সতেনতা বাড়বে। তথ্য আদান-প্রদান, তথ্য অধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত হবে। কেন্দ্রের কাছে পৌঁছাবে উপকূলের কণ্ঠস্বর।
উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কেবল দুর্যোগ এলেই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খবরাখবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয় না। উপকূলের প্রান্তিকের তথ্য যেমন কেন্দ্রে পৌঁছায় না, ঠিক তেমনি কেন্দ্রের মাঠে পৌঁছাচ্ছে না বহুমূখী কারণে।
উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। মোটামুটি এগুলোই উপকূল দিবস প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি।
এবারের চিন্তা দিন নিয়ে- কোন দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ প্রস্তাব করা যায়! খুঁজে পাই ১২ নভেম্বরকে। এটাই উপকূলবাসীর কাছে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। কারণ, ’৭০ সালের এই দিনে উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল গোটা উপকূল।
এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’। এই ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূল। বহু মানুষ প্রাণ হারান। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন। এই ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে প্রায় দশ লাখ।
ভাবি, এই দিনটিকেই উপকূল দিবস প্রস্তাব করা যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে ২০১৬ সালে এই দিবসের প্রস্তাব তুলে জনমত গঠণের চেষ্টা করি। লেখার শিরোনাম ছিল- ‘১২ নভেম্বর হোক উপকূল দিবস’। সমগ্র উপকূল থেকেই ব্যাপক সাড়া পাই।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার ২০১৭ সালে প্রথমবারের মত ১২ নভেম্বর বেসরকারিভাবে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৭১০ কিলোমিটার সমুদ্ররেখা পূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগর পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলের সর্বত্র ১২ নভেম্বর উপকূল দিবসের আওয়াজ।আর ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস যখন আমরা ছিলাম ‘অসহায়’। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন তার মূল লক্ষ্য ছিল শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেই দায়িত্বটা এখন বর্তেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্কন্ধে। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করত, ঘরবাড়ি হারাত। সেসব এখন আর নেই। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসনীয়। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার যে ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তা এখন সারা বিশ্বের জন্য মডেল হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আমাদের অনুসরণ-অনুকরণ করতে পারে। বাংলাদেশে এখনো প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়, কিন্তু যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আগে হতো এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলার স্বাধীনতার সফলতা।কিন্তু একটি দিবস থাকলে অন্তত সবাই মিলে একযোগে উপকূলের কথা বলার সুযোগ পাই! দিন ঠিক করার আগে নিজের কাছে নিজের আরেকটা প্রশ্ন, কেন উপকূল দিবস চাই?
যেকোন দিবস দাবির পেছনে রয়েছে অনেক যৌক্তিকতা। দিবস কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে, দিবস অধিকার আদায়ের কথা বলতে পারে, দিবস পারে জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর জোরালো করতে। কেন উপকূল দিবস চাই- প্রশ্নটির সহজ জবাব হলো, উপকূলের মানুষের কণ্ঠস্বর জোরদার করার মধ্যদিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
একই সঙ্গে প্রতিবছর একটি সুনির্দিষ্ট দিনে উপকূল দিবস পালিত হলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে সতেনতা বাড়বে। তথ্য আদান-প্রদান, তথ্য অধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত হবে। কেন্দ্রের কাছে পৌঁছাবে উপকূলের কণ্ঠস্বর।
উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কেবল দুর্যোগ এলেই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খবরাখবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয় না। উপকূলের প্রান্তিকের তথ্য যেমন কেন্দ্রে পৌঁছায় না, ঠিক তেমনি কেন্দ্রের মাঠে পৌঁছাচ্ছে না বহুমূখী কারণে।
উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। মোটামুটি এগুলোই উপকূল দিবস প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি।
এবারের চিন্তা দিন নিয়ে- কোন দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ প্রস্তাব করা যায়! খুঁজে পাই ১২ নভেম্বরকে। এটাই উপকূলবাসীর কাছে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। কারণ, ’৭০ সালের এই দিনে উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল গোটা উপকূল।
এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’। এই ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূল। বহু মানুষ প্রাণ হারান। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন। এই ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে প্রায় দশ লাখ।
ভাবি, এই দিনটিকেই উপকূল দিবস প্রস্তাব করা যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে ২০১৬ সালে এই দিবসের প্রস্তাব তুলে জনমত গঠণের চেষ্টা করি। লেখার শিরোনাম ছিল- ‘১২ নভেম্বর হোক উপকূল দিবস’। সমগ্র উপকূল থেকেই ব্যাপক সাড়া পাই।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার ২০১৭ সালে প্রথমবারের মত ১২ নভেম্বর বেসরকারিভাবে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৭১০ কিলোমিটার সমুদ্ররেখা পূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগর পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলের সর্বত্র ১২ নভেম্বর উপকূল দিবসের আওয়াজ।আর ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস যখন আমরা ছিলাম ‘অসহায়’। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন তার মূল লক্ষ্য ছিল শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেই দায়িত্বটা এখন বর্তেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্কন্ধে। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করত, ঘরবাড়ি হারাত। সেসব এখন আর নেই। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসনীয়। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার যে ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তা এখন সারা বিশ্বের জন্য মডেল হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আমাদের অনুসরণ-অনুকরণ করতে পারে। বাংলাদেশে এখনো প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়, কিন্তু যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আগে হতো এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলার স্বাধীনতার সফলতা।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার ২০১৭ সালে প্রথমবারের মত ১২ নভেম্বর বেসরকারিভাবে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৭১০ কিলোমিটার সমুদ্ররেখা পূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগর পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলের সর্বত্র ১২ নভেম্বর উপকূল দিবসের।