বুধবার ● ২৫ নভেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » ঢাকা » সারাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ নির্যাতন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে : প্রগতিশীল নারী সংগঠন
সারাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ নির্যাতন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে : প্রগতিশীল নারী সংগঠন
ঢাকা :: ‘সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদার করুন’এই আহ্বানে আগামী ২৭ নভেম্বর শুক্রবার বিকাল ৩টায় শাহবাগে অনুষ্ঠিতব্য নারী গণসমাবেশ উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় মুক্তিভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।প্রগতিশীল নারী সংগঠনসমুহের সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সিপিবি নারী সেলের আহ্বায়ক লক্ষ্মী চক্রবর্তী এবং পরিচালনা করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নিশিখা জামালী। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নারী সংহতির সভাপতি শ্যামলী শীল, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, বিপ্লবী নারী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক আমেনা আক্তার।
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য বলা হয়, সারাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ নির্যাতন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, এক একটি ঘটনা বর্বরতা নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে আরেকটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এবং বিশেষত উল্লেখ করতে চাই করোনাকালে নারীর প্রতি বিভিন্ন মাত্রার সহিংসতা তীব্রভাবে বেড়ে চলছে।
আমরা খুব সুস্পষ্টভাবে মনে করি গণতন্ত্রহীনতা, বিচারহীনতা ও নারীর প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আজকে এ ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চলতি বছলের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জন নারীকে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। শুধু ধর্ষণ নয় বহুমাত্রিক উপায়ে নারী-শিশুকে নির্যাতন নিপীড়ন করছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিয়ে চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। পাহাড়-সমতলে সব জায়গায় এ ঘটনা ঘটছে। পাহাড়ের অধিবাসী নারী সামরিক-বেসামরিক সেটেলার দ্বারা ধর্ষণ, গুম, খুন, হত্যার স্বীকার হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এর কোনোটারই বিচার বা সুষ্ঠু বিচার হচ্ছে না। মাত্র ৩ শতাংশ নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিচার হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ, বিচার না হওয়ার কারণে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং অপরদিকে আক্রান্ত মানুষেরা ও তাদের পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে।
লিখিত বক্তব্য আরও বলা হয়, এত ভয়াবহভাবে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছে তার কারণগুলো খুব সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করতে চাই আপনাদের সামনে। বিদ্যমান আইন, আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়া, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিচারহীনতা এবং সর্বোপরি নারীর প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি একজন পুরুষকে ধর্ষকে পরিণত করে। সমাজের নানা অসঙ্গতিপূর্ণ আধিপত্যাবাদী আচরণবিধির কারণে ধর্ষকের জন্ম হয়।
ধর্ষণের অন্যতম কারণ সমাজে নারী পুরুষের অসমতা এবং মুনাফা লোভী বাজার ব্যবস্থা যা সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করে, ভোগবাদী মানসিকতা উষ্কে দেয়া শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মীয় অনুশাসনের নামে মানুষের সব স্বাভাবিক চাহিদা বা প্রবণতা এবং বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করা। যার কারণে আপনারা লক্ষ করবেন আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোতে কি ভয়াবহ আকারে শিশু-ছেলে শিশু যৌন নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে। কাজেই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন একটি রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক লড়াই, ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে একইসাথে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে তার সাথে এ অপরাধের সুষ্ঠু দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
গোটা দেশের সচেতন মানুষ এ মুহূর্তে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে সরব রয়েছে। ক্ষমতা কেন্দ্রিক লুটপাটতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেয়া হচ্ছে না, যার ফলশ্রুতিতে আপনারা দেখছেন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে ও হামলা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা আমরা আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার করতে চাই তা হলো সাম্প্রতিককালে সরকার দেশব্যাপী তীব্র ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠেছিল ঠিক যে মুহূর্তে সরকার ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- বিধান করেছে।
আমরা মনে করি ৯৭ শতাংশ ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়াকে অকার্যকর রেখে এবং অপরাধ প্রমাণ করার পদ্ধতিসহ আক্রান্ত নারী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা না করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেয়া লোক দেখানো বা মূল ঘটনাকে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করানোর একটি অপকৌশল মাত্র। এ সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশের প্রগতিশীল নারী সংগঠনসমূহ আমাদের ধারাবাহিক লড়াই সংগ্রামের অংশ হিসেবে নি¤œলিখিত দাবিসমূহ নিয়ে আগামী ২৭ নভেম্বর শুক্রবার বিকেল ৩টা শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে নারী গণসমাবেশের আহ্বান করেছি। দেশবাসীকে উক্ত সমাবেশে অংশগ্রহণের আহ্বান আমরা আপনাদের মাধ্যমে জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছি।
আমাদের দাবিসমূহ :
১। সারাদেশে অব্যাহতভাবে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার সাথে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২। পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর সামরিক-বেসামরিক সকল প্রকার যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
৩। হাইকোর্টের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে।
৪। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করতে হবে। বাংলাদেশকে সিডো সনদের ২ এবং ১৬-১ (গ) ধারা স্বাক্ষর করে সিডো সনদের পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।
৫। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন-১৮৭২-১৫৫(৪) ধারাকে বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
৬। অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে।
৭। তদন্তকালীন সময়ে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৮। ধর্মীয়সহ সকল ধরনের সভা-সমাবেশে নারী বিদ্বেষী সংবিধানবিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা বন্ধ করতে হবে। পর্ণগ্রাফি নিয়োন্ত্রনে বিটিসিএল এর কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সুস্থধারার সাংস্কৃতিক চর্চা সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
৯। সারাদেশে মাদক বন্ধে সরকারিভাবে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
১০। পাঠ্যপুস্তকে বিদ্যমান নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যে কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে।
১১। গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে ধর্ষনের অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।