মঙ্গলবার ● ৮ মার্চ ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদ ভিত্তিক পর্যটন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ঈর্ষান্বিত বিপ্লব ঘটবে
রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদ ভিত্তিক পর্যটন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ঈর্ষান্বিত বিপ্লব ঘটবে
নির্মল বড়ুয়া মিলন, রাঙামাটি :: (২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ : বাংলাদেশ : সময় : রাত ৩.২০মিঃ) ২৫ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটিতে জেলা উন্নয়ন কমিটির সমন্বয় সভায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা বলেছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা এ রাঙামাটি শহরে এক শ্রেণীর অবৈধ দখলদার অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলে সৌন্দর্য বিনষ্ট করছে ৷ সকলে মিলে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ৷ তিনি বলেন, এ জেলায় বসবাসরত সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ৷
মত্স্য উন্নয়ন কর্পোরেশন এর কর্মকর্তা জানান, কাপ্তাই হ্রদে কচুরিপানা অপসারণের বিষয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারী বুধবার পরিষদে একটি সভা করা হয়েছে ৷ এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে সাথে নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে ৷
আমাদের দেশে সুদুরপ্রসারী সরকারী যতই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক না কেন তা বাস্তবায়ন হয় খুবই কম ৷ তার প্রধান কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও আমলা তান্ত্রিক জটিলতা ৷
১৯৬০ সালে তত্কালীন সরকার পাহাড়ের ঝর্ণার পানিকে একত্রিত করে একটি জায়গায় বাঁধ নির্মান (কাপ্তাই বাঁধ) করে হাইড্রোলিক পাওয়ার ষ্টেশন বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র রাঙামাটি জেলায় স্থাপন করে ৷
পরবর্তীতে বাংলাদেশের কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশীদের কাছে কর্ণফুলী হ্রদ আর বিদেশীদের কাছে এশিয়ার বৃহত্তর কৃত্রিম হ্রদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ৷ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে আসা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অতিথিবৃন্দ কাছে ভ্রমন তালিকায় রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদ তালিকায় থাকে ৷ গত ২৪ ফেব্রুয়ারী ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধানও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভ্রমন করেছেন ৷ কাপ্তাই হ্রদটি সৃষ্টির পর থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের কষ্টের কারণ হলেও আজ ৫৬ বছর পরে দেখা যাচ্ছে কাপ্তাই হ্রদটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম পর্যটন এলাকা ও বিদেশী মুদ্রা আয়ের একটি মাধ্যম ৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন সরকার কাপ্তাই হ্রদের জায়গার পরিসীমা নির্ধারণ, সৌন্দর্য্য বর্ধন, হ্রদের উন্নয়ন ও সম্পদ রক্ষায় কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাই ৷ স্থানীয় প্রশাসন যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, রাঙামাটি জেলা প্রশাসন, মত্স্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি), বাজার ফান্ড, পর্যটন কর্পোরেশন, রাঙামাটি পৌরসভা, কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর, মত্স্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট, বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কেউ এর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে যথাযথ ভুমিকা পালন করতে দেখা যায়নি ৷ কাপ্তাই হ্রদ নিয়ে কেবলমাত্র সভা সমাবেশে বক্তব্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ৷ এর মূল কারণ হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ অবৈধভাবে দখল করে যেসমস্ত হোটেল, মোটেল, বহুতল ভবন, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক বাসা বাড়ী গড়ে তুলেছে তারা সকলেই বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সরাসরী অবৈধ হ্রদ দখলের সাথে জড়িত আছে ৷
কাপ্তাই হ্রদের জমি দখলের সাথে সাথে বিগত বিএনপি সরকারের সময় থেকে চালু হয়েছে কাপ্তাই হ্রদে বাঁধ দিয়ে, নেট দিয়ে, নদীতে খুটি গেড়ে জাল বসিয়ে বিভিন্ন এলাকায় নদী দখলের প্রক্রিয়া ৷ এ প্রক্রিয়ার সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক সকল দলের নেতাকর্মী বিভিন্ন সংগঠনের নাম ব্যবহার করে ও স্থানীয় প্রশাসনের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীরা সরাসরী জড়িত ৷ একারণে কাপ্তাই হ্রদ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম কোন সময় পরিচালনা করা হয়নি ৷ স্থনীয় পরিবেশবাদী ও জনসাধারনের দাবি রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা এ রাঙামাটি শহর এক শ্রেণীর অবৈধ দখলদারদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা ৷
জাতীয় ও আঞ্চলিক স্থানীয় রাজনৈতিক দলের রাঘব বোয়ালদের রক্ত চোখ উপেক্ষা করে কাপ্তাই হ্রদের পাড় মুক্ত বা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করে এশিয়ার বৃহত্তম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য্য ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলির দীর্ঘ দিনের দাবি রয়েছে ৷ কিন্তু এব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন গুলি নির্বিকার থাকায় পরিবেশবাদী সংগঠন গুলির আবেদন নিবেদন লাল ফিটার ফাইলে বন্দী হয়ে আছে ৷
১৯৬০ সালে তত্কালীন আয়ুব খান সরকার বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৭২৫ বর্গকিলোমিটার (গ্রুপল্যান্ড) এলাকা অধিগ্রহণ করে৷ সেসময় জমির মূল্য অনুসারে মূল্য পরিশোধ করে নদীর তলদেশ থেকে ১২০ ফুট পাড় পর্যন্ত সরকার অধিগ্রহণ করে ৷ এই জায়গার মধ্যে কারো কোন মালিকানা দাবির আইনগত সুযোগ নাই ৷ কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু, লোভী মানুষ স্থানীয় চার্কেল চীফ চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ের কাছ থেকে কৃষি চাষাবাদের কথা বলে (ফিসল্যান্ড) একসনা বন্দবস্তি নিয়ে গড়ে তুলেছে হোটেল, মোটেল, বহুতল ভবন, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক বাসা বাড়ী যা সম্পূর্ণ অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত ৷
পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা ৷ কিন্তু অধ্যাবধি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের স্থানীয় বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে একথা গুলি আজ পর্যন্ত স্থানীয় জাতীয় ও আঞ্চলিক কোন রাজনৈতিক দলের নেতারা জাতীয় সংসদে আলোচনা কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে বলতে শোনা যায়নি ৷
পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা কাপ্তাই হ্রদ অবৈধ দখলদারমুক্ত করা, হ্রদের পাড়ে পঁয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ করা, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি আঞ্চলিক সড়কটি বাঁকমুক্ত করা, রাস্তা প্রশস্থ করা, তিন পার্বত্য জেলার জন্য রাঙামাটি জেলায় একটি বিমান বন্দর নির্মাণ করা, হাটহাজারী থেকে রাঙামাটি সদর হয়ে ঠেগামুখ পর্যন্ত ট্রেন লাইন সম্প্রসারন করা, চন্দ্রঘোনা পেপার মিল থেকে রাঙামাটি জেলা সদরে গ্যাস লাইন সম্প্রসারন করা, পর্যটকদের পার্বত্য অঞ্চলের সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য চট্টগ্রাম চাক্তাই-রাঙামাটি বৃটিশ আমলের কর্ণফুলী নদী দিয়ে লঞ্চযোগে যাত্রী বহনের নদীপথে পরিবহণ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা, রাঙামাটি রাবার বাগান থেকে ডিসি বাংলো পর্যন্ত সড়কের দুই পাশের সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা থেকে অবৈধ বেআইনীভাবে নির্মাণকৃত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করে সড়কের দুই পাশে জনসাধারন পায়ে চলাচলের জন্য ফুটপাথ নির্মাণ করা, রাঙমাটি শহরের মধ্যে স্থানীয় জনসাধারন ও পর্যটকদের জন্য বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করা, চট্টগ্রাম- রাঙামাটি আঞ্চলিক সড়কে দিবারাত্রি যাত্রীবাহী বাস চলাচলের ব্যবস্থা চালু করা সেই সাথে ফিটনেস বিহীন পুরাতন লক্ষর জক্কর বাসগুলির রোড পারমিট বাতিল করে অত্যাধুনিক বিলাস বহুল বাস সার্ভিস চালু করা ও কাপ্তাই হ্রদে বৃষ্টির পানিতে ভেসে আসা ভরে যাওয়া পলিমাটি ড্রেজিং এর মাধ্যমে হ্রদের গভীরতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি ৷
উল্লেখিত সমস্যা সমূহ নিয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সরকারের উচ্চমহলে পর্যায়ক্রমে কথা বলে বাস্তবায়ন করেন, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলের রাজধানী বলে খ্যাত রাঙামাটি পার্বত্য জেলার শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত যুবক যুবতীদের চাকরীর জন্য ঘুষ দিয়ে কারো কাছে দ্বারস্থ হতে হবে না ৷ রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই হ্রদ ভিত্তি করে এই অঞ্চলে পর্যটন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ঈর্ষান্বিত বিপ্লব ঘটবে ৷
ইতিমধ্যে সরকার ঢাকঢোল পিঠিয়ে কোটি টাকা খরচ করে পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন স্থানে আকর্ষণীয় নতুন নতুন ষ্পট নির্মাণ করছেন, কিন্তু আমলা তান্ত্রিক জটিলতার কারণে স্থানীয় অধিবাসীদের এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত না করায় ভেসস্তে যেতে পারে সরকারের এ মহা পরিকল্পনা ৷ পার্বত্য অঞ্চলের পরিবেশকে বিপন্ন করে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে ধ্বংস করে, রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদকে প্রতিদিন আবর্জনায় ভর্তি করে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে হ্রদকে মুক্ত না করে রাঙামাটি জেলায় পর্যটনের বিকাশ, প্রচার, প্রসার ও উন্নয়ন কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয় ৷
এমন একদিন আসবে পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক সমস্যা অন্য খাতে মোড় নেবে স্থানীয় অধিবাসীরা তখন বলতে বাধ্য হবেন “ফিরিয়ে দাও অরণ্য”৷ সেসময় কিন্তু পার্বত্য চুক্তির দোহায় দিয়ে জনরোষ ঠেকানো যাবেনা ৷ সেদিন আর বেশী দুরে নয় ৷
রাঙামাটি জেলার বিজ্ঞ মহল মনে করেন এখনো হাতে সময় থাকতে দীর্ঘ দিনের উদাসীনতা পরিহার করে বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলের মনোযোগী হওয়া উচিত্ ৷