সোমবার ● ১১ জানুয়ারী ২০২১
প্রথম পাতা » কৃষি » ঝিনাইদহে ফুলচাষিদের সব স্বপ্ন কেড়ে নিল করোনা ভাইরাস
ঝিনাইদহে ফুলচাষিদের সব স্বপ্ন কেড়ে নিল করোনা ভাইরাস
জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :: ঝিনাইদহে দীর্ঘমেয়াদি করোনার রোষানলে পড়ে ভেস্তে গেছে ব্যবসা। ডিসেম্বর থেকে প্রতি বছর ফুলের বেঁচাবিক্রি যেখানে থাকে রমরমা, সেখানে বিজয় দিবস ও ইংরেজি বর্ষবরণে হয়নি আশানুরূপ বিক্রি। সামনের তিন মাসজুড়ে আছে বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নর্ববর্ষ। দিবসগুলো কতটা পরিবর্তন করবে ভাগ্য, বলতে পারছেন না তারা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ফুল নষ্ট হয়েছে বাগানেই। গবাদিপশুর খাদ্যে পরিণত হয়েছে করোনাকালীন সময়ে। ফুলচাষিরা জানান, গত বছর ২০২০ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে এই ফুলের ব্যবসা হয়েছে রমরমা। সে বছর ফুলের চাষে স্বাবলম্ভী হয়েছেন অনেকে। এ বছরে নিষ্প্রাণ সব। তিন বিঘা জমিতে গাঁদা, রজনীগন্ধা ও গ্ল্যাডিয়াস ফুলের চাষ করেছিলেন কালীগঞ্জের গান্না বাজার ও ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের কৃষক আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘ফুল বেচাকেনা খুবই কম। ফলে জমিতেই নষ্ট হচ্ছে ফুল। এদিকে ফুল তুলে বাগান থেকে অপসারণ না করলে গাছ মরে যাবে। সে কাজেও রয়েছে খরচ। এদিকে কবে ফুলের বাজার শুরু হবে তাও অনিশ্চিত। পকেটের টাকা খরচ করে এভাবে ফুলগাছ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে এখন ফুলগাছ তুলে ফেলে দিতে হচ্ছে।’ জানা যায়, ১৯৯১ সালের কথা। ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা ঝিনাইদহে কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের সৌখিন কৃষক ছব্দুল শেখ সর্বপ্রথম ফুল চাষ করেন। ওই বছর মাত্র ১৭ শতক জমিতে ফুল চাষ করে ৩৪ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেন। এরপর থেকে এলাকায় বিভিন্ন জাতের ফুল চাষের বিস্তার লাভ করতে থাকে। সেখান থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে জেলার হাজার হাজার কৃষক ফুলচাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছিলেন। এদের সবাই এখন বিমর্ষ। এলাকার বেশ কয়েকজন ফুলচাষি জানান, কৃষকের সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। গত বছরের ফুল বিক্রির মৌসুমে করোনা সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে তাদের। এবছরের ফুল বিক্রির মৌসুমের এক মাস অতিবাহিত হয়েছে, দুটো দিবস কেটে গেছে, কিন্তু বিক্রি তেমন নেই। চরম লোকসানের মুখে পড়েছেন সবাই। বেশি বিপদে পড়েছে ফুলকর্মীরা, যারা ফুল তোলা ও গাঁথার কাজ করে সংসারের খরচ জোগান দিত। সব থেকে বেশি ফুলচাষ হওয়া এলাকা বালিয়াডাঙ্গা ও গান্না ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা ফুল বাগানের গাছ বাঁচাতে পকেটের টাকা খরচ করে খেত থেকে ফুল তুলে ফেলে দিচ্ছেন। অনেকে ফুল গবাদি পশুর খাবার হিসাবে ব্যবহার করছেন। শাহপুর ঘিঘাটি গ্রামের স্কুল শিক্ষক খলিলুর রহমান ঝিনাইদহের চোখ’কে জানান, এ বছর আট বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছিলাম। অনেক জমিতে ফুল তোলা শুরু হয়েছিল। এখন ফুল বেঁচাকেনা বন্ধ। অনেক জমির ফুল গাছ তুলে দিচ্ছি। আগে বালিয়াডাঙ্গা, লাউতলা ও কালীগঞ্জ মেইন বাসস্টান্ড দুপুর গড়ালে ফুলে ফুলে ভরে যেত। এসব বাজারে প্রতিদিন দূর-দুরান্ত থেকে ফুল কিনতে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আসতেন। ফুলচাষি, ব্যাপারী আর ফুল কর্মীদের হাঁকডাকে মুখরিত থাকত। সকাল থেকেই বিভিন্ন রুটের বাসের ছাদে স্তূপ করে সাজানো হতো ফুল। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে ট্রাক-পিকআপ ও ভ্যান ভরে ফুল যেত। সেখানে এখন খাঁ খাঁ মরুভূমির মতো। গান্না বাজার ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দাউদ হোসেন জানালেন, ফুলের ভরা মৌসুমে করোনার হানায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা দিশাহারা হয়ে পড়েছে। কবে নাগাদ ফুলের বেঁচাকেনা হবে তাও অনিশ্চিত, যেহেতু এখানকার ফুলের সুনাম আছে আমরা আশাকরছি খুব সিগগিরই এ ব্যবসা আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
ঝিনাইদহে ৫ বছরে ১২৯টি ইট ভাটায় আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৫ হাজার হেক্টর,কমছে মাটির উর্বরতা
ঝিনাইদহ :: ঝিনাইদহে কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ব্যবহার করা হচ্ছে ইটের ভাটায়। এতে একদিকে কৃষি জমি কমছে অন্যদিকে কমছে মাটির উর্বরতা। গত ৫ বছরে নানা কারণে জেলায় আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৫ হাজার হেক্টর। এরমধ্যে অন্যতম হলো ইটভাটায় মাটি বিক্রি। এভাবে চলতে থাকলে তা সার্বিকভাবে বিরুপ প্রভাব ফেলবে কৃষি পরিবেশের উপর বলছেন কৃষি ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা। ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার হাকিমপুর গ্রামের মাঠে বেশ কিছুদিন ধরেই কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে ব্যবহার করা হচ্ছে ইটের ভাটায়। এমন অবস্থায় ভ্রাম্যমান আদালতের উপস্থিতি দেখে পারিয়ে যায় মাটি কাটার সাথে সংশ্লিষ্টরা। এমনচিত্র শুধু জেলার সব স্থানেই। কিছু অসাধু জমি মালিকের সহযোগীতায় ভাঁটা মালিকরা প্রতিদিন ট্রলিভর্তি মাটি নিয়ে যাচ্ছেন ভাটায়। এতে ওই জমি অসমতল হয়ে পড়ায় পাশ^বর্তি জমিগুলোও ক্ষতির সম্মুখনি হচ্ছে, ব্যহত হচ্ছে চাষাবাদ। আর ভ্রাম্যমান আদালত জরিমানা করেও বন্ধ করতে পারছেন না কৃষি জমির মাটি কাটা। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় গত পাঁচ বছর আগে আবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এক লক্ষ ৫৫ হাজার ২ শ’ ৩৫ হেক্টর আর বর্তমানে তা কমে দাড়িয়েছে এক লক্ষ ৫০ হাজার ২ শ’ ৩৫ হেক্টরে। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরো বেশী হবে স্থানীয় সাধারন মানুষের মত। জেলায় ইট ভাঁটা রয়েছে ১২৯ টি। এরমধ্যে অনুমোদন কৃত ভাঁটা রয়েছে মাত্র সাতটি। এসব ভাটার জন্য প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৫ হাজার ট্রলি মাটি কাটা হচ্ছে। হরিনাকুন্ডু গ্রামের দবির মন্ডল জানান, ধান কাটার পর থেকেই জমি থেকে মাটি কাটা শুরু হয়েছে। জমি থেকে মাটি কাটার পক্ষে সবাই না কিন্তু বাধ্য হয়ে অনেককে মাটি কাটতে হয়। জমি থেকে মাটি কাটার পর পাশের জমিগুলো উঁচু হয়ে যায়। তখন উঁচু জমিতে ফসল হয় না। তখন বাধ্য হয়ে জমির মাটি কেটে নিচু করতে হয়। তিনি আরো জানান, মাঠে ভাল জমিতে পুকুর করছে। অনেকে জমির মাটি কেটে উঁচু বা নিচু করছে মাটি ব্যবসায়ী মোঃ হাবিল জানান, প্রতিটা এলাকার কৃষি জমি থেকেই এক-দেড় ফিট গর্ত করে মাটি কাটা হয়। পাশ^বর্তি ভাঁটা মালিকদের সাথে চুক্তিভিত্তিক মাটি নিয়ে তাদের দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইটভাটার ম্যানেজার জানান, আমরা সরাসরি মাটি কিনি না। মাটির ব্যবসায়ীরা এসে আমাদের মাটি দিয়ে যায়। তবে আমার জানামতে কৃষিজমি যেগুলো পানি ছেচের অনুপোযোগী সেগুলো থেকে মাটি কাটা হয়। এ ছাড়া বেশিরভাগ পুকুর কাটে সেসব মাটি আমাদের ভাটায় দেয়। আমরা সরাসরি মাঠের মাটি কিনি না। তিনি আরো জানান জমির মালিক যদি তার জমির মাটি বিক্রি করে দেয় এখানে আমার কিছু বলার নেই। সরকারি লালন শাহ কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহব্বত আলী জানান, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়ার ফলে উর্বরতা যেমন কমছে তেমনি নানা দিক থেকে মাটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। কয়েক বছরে ভাটার সংখ্যা বেড়েছে ৬০%, কৃষি জমিও কমেছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর উপ-পরিচালক কৃপাংশু শেখর বিশ^াস জানান, কৃষি জমি হ্রাস রোধ করতে হবে। সাথে সাথে অবশিষ্ট জমিতে উন্নত প্রযুক্তি ও জাত ব্যবহার করতে হবে। ঝিনাইদহ ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হেদায়েত উল্লাহ জানান, কৃষি জমির মাটি কেটে নেওয়া আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে এমন একটি অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে মাটি কাটার ভারী জিনিস জব্দ করা হয়। এ ছাড়া হরিনাকুন্ডু উপজেলার মাটি ব্যবসায়ী মোঃ হাবিলকে দুই দফায় জরমিনা করা হয়। তিনি আরো জানান, দিন দিন কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। আবার যদি জমি থেকে এভাবে মাটি তোলা হয় তাহলে কৃষি জমি আরো কমে আসবে। জমি রক্ষায় আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে যোগ করেন।