বৃহস্পতিবার ● ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » সুন্দরবনে ১৮ বছরে ২২ বার আগুন ঘটনা নাশকতা : বন বিভাগ খতিয়ে দেখছে
সুন্দরবনে ১৮ বছরে ২২ বার আগুন ঘটনা নাশকতা : বন বিভাগ খতিয়ে দেখছে
শেখ সাইফুল ইসলাম কবির,বাগেরহাট প্রতিনিধি :: বিশ্ব ঐতিহ্য সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সব সময়ই রক্ষা করে আসছে। কিন্তু সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রনিত না নাশকতা তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে বন বিভাগ। গত ১৮ বছরে বনের গহীনে বেশ ২২ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটলেও বন্ধ বা প্রতিরোধ করতে পারছে না বন বিভাগ। প্রতিবার বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন ও চুলছেড়া বিশ্লেষণ করে দেখলেও পুণরায় ঘটছে অপ্রীতিকর এমন ঘটনা। এমনকি ভবিষ্যতে আবারো সুন্দরবনে আগুন নাশকতার গন্ধ পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই বন বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে সতর্ক করা হয়েছে বলে ভোরের পাতাকে নিশ্চিত করেছে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র। সুন্দরবনে আগুন নাশকতা নিয়ে ভোরের পাতার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
সর্বশেষ ৮ ফেব্রয়ারি সুন্দরবনে লাগা আগুনের ঘটনা দুর্বৃত্তদের নাশকতা সন্দেহ নিয়েই খতিয়ে দেখছে বন বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটি। এর আগে ২০১৭ সালের ২৬ মার্চ একই এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটে। বিশ্বের দরবারে একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের নাম সবারই পরিচিত। এ সুন্দরবনের জন্যই বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের সমগ্র সংরক্ষিত বনভূমির অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৫১ শতাংশ বনই হচ্ছে সুন্দরবন। প্রায় ৬ হাজার ১১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই বনে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান,পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। নদ-নদীতে রয়েছে বিলুপ্ত প্রায় তালিকায় থাকা ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, লবন পানির কুমির ও ২১০ প্রজাতির মাছ।
তবে সুন্দরবনে ধারাবাহিক অগ্নিকান্ডের ঘটনা বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয় তার সঠিক কারণ জানা না গেলেও প্রতিবারই ধারণা করা হতো, বনজীবীদের অসাবধানতায় বিড়ি-সিগারেটের ফেলা দেওয়া অংশ থেকে আগুন লেগেছে। কিন্তু এবারের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন না অনেকেই।
বিএনপির নেতা ও সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘সোমবারের ঘটনা নাশকতাও হতে পারে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যেসব এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে সেসব এলাকার কিছু অসাধু জেলেরা মাছ ধরার জন্য তাদের সুবিধার জন্য জায়গা খালি করতে তারা আগুন লাগায়’। এছাড়াও ইতিপূর্বে চাঁদপাই রেঞ্জে জেলে সেজে কিছু দুর্বৃত্ত সুন্দরবনের গহীনে বনের কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরী করেছিল, যা গত বছর বন বিভাগের হাতে ট্রলার বোঝাই ধরা পরেছে। কিন্ত কারা এর সাথে জড়িত তা বন বিভাগের কাছে তথ্য ছিল। কিন্ত রহস্যজনক কারণে কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। তবে এর সাথে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী জড়িত থাকতে পারে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন ড. ফরিদুল ইসলাম। আর এজন্য বনবিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের চরম উদাসীনতাকে দায়ী করেন তিনি। বনবিভাগ কঠোর নজরদারী করলে এ ঘটনা বাববার ঘটতো না বলেও ক্ষোভ নিয়ে জানান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় কার্যালয়ের (বাগেরহাট) উচ্চমান সহকারী মোঃ হারিস এক তথ্য মতে জানান, সুন্দরবনে ২০০২ সালে কটকা এলাকায় একবার, নাংলী ও মান্দারবাড়িয়া এলাকায় দুই বার, ২০০৫ সালে পচাকোরালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল দুইবার, ২০০৬ সালে তেরাবেকায়, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকরালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোরালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়া এলাকায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলশাখালী একবার, ২০১১ সালে নাংলিতে দুইবার, ২০১৪ সালে গুলশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলি, পচাকোরালিয়া ও তুলাতুলিতে তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসা ছিলায় একবার এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর এলাকায় সোমবার চার শতক বনভূমি পুড়ে যায়।
এসব আগুনে কোটি কোটি টাকার বনজসম্পদ আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে বলেও জানান বন বিভাগের বিভাগীয় কার্যলয় থেকে। এদিকে নানা সময়ে আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন এমন একজন বন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের পাতাকে বলেন, কমিটি বনের অভ্যন্তরে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধকল্পে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ৩৯ ধরনের সুপারিশমালা পেশ করেছিল। সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বন-সংলগ্ন লোকালয়ের লোকজনের মাঝে অগ্নিকান্ডের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি, অগ্নিকান্ডের পর তা নিয়ন্ত্রণ বা নেভাতে বন বিভাগের লোকবল বৃদ্ধি, বন বিভাগের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ইউনিট গঠন, বন-সংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদী ও খাল খননের মাধ্যমে গভীরতা সৃষ্টি প্রভৃতি।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা আরও বলেন, সুপারিশের অধিকাংশই দীর্ঘদিনে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে বনাঞ্চলে বারবার আগুনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া আগুন লাগার পর তা নেভাতেও বনকর্মীদের চরম ভোগান্তি আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, চাঁদপাই রেঞ্জে অধিকাংশ আগুনের ঘটনা ঘটেছে নাংলি, ধানসাগর, ভোলা ও পচাঁকোরালিয়ার নদী-সংলগ্ন এলাকায়। তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ সোমবার আগুনের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে এই কমিটি কি কারণে বনের অভ্যন্তরে আগুন লেগেছে তার কারণ চিহ্নিত করে প্রতিবেদন জমা দিবে। তারপরই ব্যাবস্থা নেয়া হবে বনের আগুন দিয়ে বনজ সম্পদ ধ্বংসকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, চাঁদপাই রেঞ্জে অধিকাংশ আগুনের ঘটনা ঘটেছে নাংলি, ধানসাগর, ভোলা ও পচাঁকোরালিয়ার নদী-সংলগ্ন এলাকায়।
তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ সোমবার আগুনের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে এই কমিটি কি কারণে বনের অভ্যন্তরে আগুন লেগেছে তার কারন চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেবেন। তার পরেই ব্যাবস্থা নেয়া হবে বনের আগুন দিয়ে বনজ সম্পদ ধ্বংশকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ।