শনিবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২১
প্রথম পাতা » অর্থ-বাণিজ্য » বিপর্যয়ের মুখে দক্ষিন -পশ্চিমাঞ্চলের “সাদাসোনা” চিংড়ি শিল্প : পোনা সংকট
বিপর্যয়ের মুখে দক্ষিন -পশ্চিমাঞ্চলের “সাদাসোনা” চিংড়ি শিল্প : পোনা সংকট
শেখ সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট প্রতিনিধি :: দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি চিংড়ি উৎপাদনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাগেরহাটসহ ১০ জেলায় মোরেলগঞ্জে গ্রামে গঞ্জে সর্বত্রই প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ‘সাদা সোনা’খ্যাতচিংড়ি শিল্পে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। রপ্তানি বন্ধ থাকার কারনে চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্য মূল্য থেকে। সেই সাথে মৌসুমের শুরুতে ঘের পরিচর্যা শেষ করলেও চাহিদা অনুযায়ী পোনা ছাড়তে না পাড়ায় গত বছরের মত এবারও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার চাষিরা। এছাড়া গত ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ায় চিংড়ি পোনা পরিবহন ব্যবস্থা অচল থাকায় চিংড়ি পোনা সংকট দেখা দিয়েছে। আর এ কারনেই গলদা-বাগদার পোনার দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুন। অনেকেউ বাধ্য হয়ে বেশি দামে পোনা কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চিংড়ি শিল্পের সাথে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ।
সরেজমিনে দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চিংড়ি পোনার হাট বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ফয়লাহাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন কোটি টাকার গলদা-বাগদা বেচাকেনা চলা এই হাটে এখন আর নেই আগের মত কর্মব্যাস্ততা। প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে পোনা পরিবহনে সংকট দেখা দেয়ায় শুন্য হাড়ি নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে এই আড়তের সাথে জড়িত শ্রমিকদের।
আড়তদার ও চিংড়ি পোনা গননাকারি শ্রমিকরা জানান, গত ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের কারনে অনেকটা বেকার হয়ে পড়েছে এই হাটের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকসহ প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ। অন্যদিকে এমন অবস্থা চলতে থাকলে মৌসুমের শুরুতে চাহিদা অনুযায়ী পোনা সরবারাহ করতে না পারায় জেলার চিংড়ি চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দাবী করছেন আড়তদারা।
ফয়লাহাটের আড়তদার মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, চট্রগ্রাম, ফেনি, নোয়াখালী ও কক্সবাজার থেকে বাগদা ও গলদা পোনা আসে এই হাটে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এই হাটে প্রায় কোটি টাকার গলদা-বাগদার পোনা বেচাকেনা হয়। তবে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে হাটে। আগের মত চিংড়ি পোনার সরবরাহ না থাকায় চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী পোনা সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ কারনে জেলার ৯৫ শতাংশ চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লকডাউনের কারনে হাটে পোনা সরবরাহ কমে যাওয়ার কারনে এই হাটের সাথে জড়িত বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ী ও শ্রমিকসহ প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ অসহায় দিনযাপন করছে।
হাটে চিংড়ি পোনা গননাকারি তরিকুল ইসলাম বলেন, ৪ থেকে ৫ হাজার লোক পুরোপুরি জীবিকা নির্বাহ করে এই ফয়লা বাজার চিংড়ি পোনার উপর। করোনা ভাইরাসের ফলে লকডাউনের কারনে ফয়লা বাজারে মাছ আসতে পারছে না। এমন অবস্থায় আমাদের ভিক্ষার থালা নিয়ে বসতে হবে। আমি লেখাপড়া করি কিন্তু আমার ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য আজকে আমাকে বাজারে আসতে হচ্ছে। “একহাজার মাছ গুনলি আমি বিষটা টাকা পাই। এই বিষটি টাকার জন্য আজকে আমাকে বাজারে আসতে হচ্ছে। এরপরও যদি লকডাউন দিয়ে যদি এটা বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে এই বিষটা টাকা কে আমাকে দেবে। আমাকে কিন্তু কেউ খাওয়াবে-পড়াবে না আমার ফ্যামিলি সাপোর্ট দেয়ার জন্য আমাকে আসতে হচ্ছে”।
চিংড়ি পোনা গননাকারি হাকিম শেখ বলেন, “পোনা-পাতি আসতিছে না, তালি আমরা কি করে বাঁচবো। বাড়ী ছেলে-মেয়ে আছে মা আছে। আমাদের তো না খেয়ে মরার পথ।
মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের জামিরতলা গ্রামের বাসিন্দা চিংড়ি চাষি মিজানুর রহমান খান বলেন, “আমি আইজ ১২-১৩ বছর ঘের করি। আমার ঘেরের পরই সংসার চলে। এই করোনাকালিন সময় আইসে মাছের রেট কুমে গেইছে। আগে মাছ বিক্রি করিছি ১৩-১৪শ টাকা এখন সেই মাছের দাম হাপ, ৬শ,৭শ,৮শ, ৯শ টাকা গলদা-বাগদা। আমার ১০-১২ বিঘের দুটি ঘের আছে। আমি যা ইনভেষ্ট করেছি, তার অর্ধেক টাকাও আমার আসবে না। এখন সামনে আর ঘের করবো কি না, সেই তইফিক থাকবে কি না, টাকা থাকবে কি না, করার মত সেই অবস্থা আর নাই। এই করোনাকালিন সময় মাছের রেট প্রচুর খারাপ। আমি সরকারের কাছে আবেদন করি আমাদের আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে ঘের করার সুযোগ দেয়া হক”।
বাগেরহাট সদর উপজেলার রাধাভল্লব এলাকার চিংড়ি চাষি আতিয়ার গাজী বলেন, “আমরা ঘের রেডি করে রাইছি। মাছ ছারতি পারতিছিনা করোনার কারনে। মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, কম কম আসে, দাম বেশি। আগে ছিলো বাগদা হাজার ৩শ টাকা এহন ৬শ টাকা ডবল দাম। নদীর বাগদা ছিলো ৭শ টাকা এহন ১২-১৪শ টাকা তাও পাওয়া যাচ্ছে না। রেনু (গলদা) হালকা-পাতলা পাওয়া যাচ্ছে ৩ হাজার ৩২শ টাকা করে হাজার”।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর চিংড়ি আড়তদার সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, করোনাকালিন সময় চিংড়ি শিল্পে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ১৭শ টাকার চিংড়ি মাছ ৮শ-৯শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই চিংড়ি শিল্প থেকে প্রচুর পরিমান রাজস্ব আয় হয়। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই, এই চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাষিদের সরকারি সহায়তার প্রয়োজন। তা না হলে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
বাগেরহাট মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে বাগেরহাট জেলায় চিংড়ি চাষী রয়েছে ৭৯ হাজার ৭৩৬ জন। আর ৭১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমিতে ৮১ হাজার ৩৫৮টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১৭ হাজার ৪৮৭ মেট্রিকটন বাগদা ও ১৬ হাজার ৩৩৭ মেট্রিকটন গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস,এম রাসেল বলেন, করোনা প্রভাবে বর্তমানে রপ্তানি বন্ধ থাকায় বর্তমানে মাছের দাম অনেকটা কমে গেছে। এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলার প্রান্তিক চাষিরা। রপ্তানি বন্ধ থাকায় গত এক বছরে বাগেরহাটের চিংড়ি শিল্পে ক্ষতির পরিমান ১শ ৪০ কোটি টাকা আর সব মিলিয়ে এই ক্ষতির পরিমান হবে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে বাজারে পোনা সংকটও দেখা দিয়েছে। বাগেরহাটে ৭৭ কোটি বাগদা ও ২১ কোটি গলদা পোনার চাহিদা রয়েছে। করোনার প্রভাবে লকডাউন অবস্থা চলতে থাকলে কোনোভাবেই এই পরিমান পোনার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এমন অবস্থায় চলতে থাকলে সময়ের সাথে সাথে আর্থিক ক্ষতির পরিমান আরও বাড়বে। তবে চাষিদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসাবে জেলার ২৮ হাজার মৎস্য চাষিকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি সহজ শর্তে চাষিদের জন্য ব্যাংক থেকে ঋনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে।