রবিবার ● ২৫ এপ্রিল ২০২১
প্রথম পাতা » অপরাধ » ‘বন্ধুকে হত্যার পর একাই পড়েন জানাযা, ক্ষমা চান লাশের হাত ধরে
‘বন্ধুকে হত্যার পর একাই পড়েন জানাযা, ক্ষমা চান লাশের হাত ধরে
মাইকেল দাশ, রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি :: চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ট্রাক চালককে অপহরণের পর হত্যা ও লাশ গুমের ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে চালকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
ঘটনার এক মাস পর গতকাল শনিবার (২৪ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন শামীম’র নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে উপজেলাধীন পারুয়া ইউনিয়নের একটি ডোবার তলদেশের মাটি খুঁড়ে লাশটি উদ্ধার করা হয়। একই দিন দুপুরে ঘটনার মূল হোতা মো. নেজাম ওরফে মিজান (২৬ )কে চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত খুনি নেজাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আজিজুলকে হত্যা ও লাশ গুমের ঘটনার বীভৎস বর্ণনা দেন। মূলত পারিবারিক শত্রুতার জের ধরেই এই হত্যার পরিকল্পনা করেন নেজাম। ঘটনার দিন বালু আনার নাম করে আজিজুলকে কৌশলে রাঙামাটি জেলাধীন বেতবুনিয়া এলাকার এক নিভৃত জায়গায় নিয়ে গিয়ে ট্রাকের রেঞ্জ দিয়ে মাথায় আঘাত করে এবং ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন ট্রাক চালককে । হত্যার পর একদিন পাহাড়ে লাশ লুকিয়ে রাখার পর বন্ধু আজিজুলের জানাযা ও দাফন করার চিন্তা আসে নেজামের মাথায়। সে অনুযায়ী গত ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে তিনি লাশটিকে কাঁধে করে রাঙ্গুনিয়া থানাধীন চৌধুরী খিলস্থ নাজিম প্রফেসরের পাহাড়ের পাদদেশে একটি ডোবার সামনে নিয়ে আসেন। সেখানে নেজাম একাই মৃতের জানাযা পড়েন এবং কবর দেওয়ার মতো করে ডোবার তলদেশে লাশটিকে গুম করেন।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়, গত মার্চ মাসের ২৫ তারিখ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন ইসলামপুর ইউনিয়নের আল আমিন পাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিমের পুত্র ট্রাকচালক আজিজুল হক (২৭) নিখোঁজ হন।
এ প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ ট্রাক চালক এর বাবা রাঙ্গুনিয়া মডেল থানায় একটি হারানো জিডি করলে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে পুলিশ। এর মধ্যে গত ৬ এপ্রিল এ প্রসঙ্গে ট্রাক চালক এর মামা হায়দার আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। তদন্তে আজিজের ব্যবহৃত মোবাইলটি প্রযুক্তির সাহায্যে কক্সবাজারে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ। ঘটনার ১৫ দিন পর কক্সবাজার সদর এলাকা থেকে মোবাইল এবং রামু এলাকা থেকে ট্রাকটি জব্দ করা হয়। অপহরণকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ওই এলাকা তাদের দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা নেজামের সংশ্লিষ্টটার কথা স্বীকার করে। এরপর পুলিশ প্রযুক্তির সাহায্যে তার অবস্থান সন্দ্বীপে শনাক্ত করে এবং গতকাল শনিবার (২৪ এপ্রিল) সন্দ্বীপ থানা পুলিশের সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়ার পর ট্রাক চালককে হত্যার কথা স্বীকার করলেও হত্যার পদ্ধতি এবং লাশের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে থাকেন নেজাম। প্রথমে তিনি দাবি করেন যে, আজিজুল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন এবং তার লাশ কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত তথ্যপ্রমাণ এবং প্রশ্নবাণের মুখে শেষ পর্যন্ত নিজে খুন করার কথা এবং লাশের সঠিক অবস্থান জানাতে বাধ্য হন খুনি। পরে তার দেখানো মতে বর্ণিত স্থান থেকে আজিজুলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে উভয় পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানায়, নেজামের স্ত্রীর সাথে আজিজুলের পরকীয়া প্রেম রয়েছে, মূলত এই সন্দেহ থেকেই আজিজুলকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন নেজাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আজ রবিবার ২৫ এপ্রিল অভিযুক্ত খুনি গ্রেফতারকৃত মো. নেজামকে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম আঞ্জুমান আরার আদালতে তোলা হলে তিনি ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে আজিজুলকে হত্যা ও গুমের ঘটনার রোমহষর্ক বর্ণনা তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি নিজ স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সন্দেহ থেকেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরিকল্পনা করেছেন মর্মেও জবানবন্দিতে দাবি করেন। আসামি নেজাম রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা হাজীপাড়া এলাকার নুরুল আলমের ছেলে।
এবিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) রাঙ্গুনিয়া ও রাউজান সার্কেল মো. আনোয়ার হোসেন শামীম সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘ এক মাসের নিরবিচ্ছিন্ন এবং নিবিড় তদন্তে আমরা প্রায় কোন ক্ল্যু না থাকা এই ঘটনাটির রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছি। সেই মোতাবেক গতকাল ঘটনার মূল হোতা নেজামকে গ্রেফতার এবং এবং তার দেওয়া তথ্যমতে ট্রাক চালকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় অন্য কারো সংশ্লিষ্টাতা রয়েছে কিনা তা নিরূপণের জন্য তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।