রবিবার ● ১৩ জুন ২০২১
প্রথম পাতা » খাগড়াছড়ি » কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৫তম বার্ষিকীতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অনলাইন আলোচনা
কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৫তম বার্ষিকীতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অনলাইন আলোচনা
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি :: পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা বাংলাদেশের সমগ্র সমাজ এবং রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণীর যে চরিত্র এতে কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভাবার কোন সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম।
গতকাল শনিবার (১২ জুন ২০২১) সন্ধ্যা ৬টায় কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৫তম বার্ষিকীতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন’র কেন্দ্রীয় কমিটি’র উদ্যোগে আয়োজিত অনলাইন আলোচনা সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন।
“পাহাড়-সমতলে নারীর ওপর নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা” শীর্ষক এই অনলাইন আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরূপা চাকমা। সভায় অংশগ্রহণ করে আলোচনা করেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, কলাম লেখক ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ান, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শম্পা বসু, নারী সংহতি’র সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা চন্দ ও সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখ।
আলোচনা সভা থেকে বক্তারা কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা পুনঃতদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য সালেহ আহম্মদ ও নুরুল হকসহ ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের মেডিক্যাল রিপোর্টের গোপন নিষেধাজ্ঞা বাতিল ও পাহাড়-সমতলে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সহিংসতা বন্ধ করার দাবি জানানো হয়।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম তাঁর আলোচনায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস স্বাধীনতা সংগ্রামের পর বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, এই রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণীর যে চরিত্র এর থেকে কল্পনা চাকমা অপহলণের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করার কোন সুযোগ নেই। কারণ, এই দেশের শাসকশ্রেণী যে সংবিধান প্রনয়ন করেছে তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট কৃষক, শ্রমিক, নিপীড়িত জাতি ও জনগণকে নিপীড়নের কাঠামোর মধ্যেই রেখেছে, তাদের স্বাধীনতা দেয়নি।
তিনি ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটিতে এক জনসভায় সকল পাহাড়ি জাতিসত্তাদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোন এক জাতির দেশ নয়। বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, সাঁওতাল, মুনিপুরিসহ নানা জাতিসত্তা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে এসব জাতিসত্তাসমূহকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
তিনি কল্পনা চাকমা অপহরণ ও মাইকেল চাকমা গুমের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, এসব ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পার্বত্য অঞ্চলে শাসকশ্রেণীর যে শোষণ, আধিপত্য, লুণ্ঠন, ভূমির উপর তাদের যে দখলদারিত্ব এর বিরুদ্ধে সেখানকার জনগণ প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে। আর এই প্রতিরোধ সংগ্রামের একজন হচ্ছেন কল্পনা চাকমা. কিংবা মাইকেল চাকমা, কিংবা মিঠুন চাকমা, কিংবা অনিমেষ চাকমা; যাদেরকে অপহরণ করা হয়েছে, যাদেরকে গুম করা হয়েছে, যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।
প্রকৌশলী শম্পা বসু বলেন, মুলত নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের কন্ঠস্বরকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রের বিচারহীনতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন কল্পনা চাকমা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সমানাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী নাহলে, তাহলে কবে তৈরী হবে সমমর্যাদা?
তিনি বলেন, জণগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নারী নিপীড়ন থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক নেত্রী ইলিরা দেওয়ান ২০০১ সালে প্রকাশিত “কল্পনা চাকমার ডায়রির” কথা উল্লেখ করে বলেন, কল্পনা চাকমা বরাবরই নারী জাগরণ ও স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতেন। বলতেন জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার পাশাপাশি ঘুণে ধরা চিন্তায় লালিত হওয়া সমাজ ব্যবস্থার বিনির্মানের কথা। পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন কল্পনা চাকমা। তিনি বেইজিং নারী সম্মেলনের মাধ্যমে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে পেরে অনেক খুশি হয়েছিলেন। তিনি সবসময় সাংগঠনিক কার্যক্রমে তৎপরতা ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিটি আনাচে কানাচে সাংগঠনিক কাজ পরিচালনা করেছিলেন।
কল্পনা চাকমার বিচারের কালক্ষেপনের চিত্র তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা এটি একটি মাইলফলক। এই ঘটনা যদি বিচার পায় এটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। তখন আমরা বলতে পারবো দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে লড়াই সংগ্রাম করে জোর দাবির ফলে বিচার পেয়েছি। আর যদি বিচার নাও পায় তাহলে দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহ ন্যায় বিচার থেকে যে বঞ্চিত, দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতি যে কি পর্যায়ে রয়েছে, জাতিগত নিপীড়নের শিকার জনগোষ্ঠীগুলো যে কি বঞ্চনার মধ্যে রয়েছে সেটা এই রাষ্ট্রের জন্য একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হয়ে থাকবে।
তিনি তাঁর আলোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনাবলীর কথাও তুলে ধরেন।
সাংবাদিক সাদিয়া গুলরুখ বলেন, সেনাবাহিনীর অন্যায়-অবিচারের বিচার চাওয়াতেই কল্পনা অপহৃত হয়েছিলেন। একইভাবে রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার হয়েছেন মাইকেল চাকমা।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছরে কল্পনা অপহরণ মামলা তদন্তে ৩৯ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদলের পরেও অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদে নেওয়া হয়নি কেন?
আওয়ামী লীগের শাসনে বিচার চাওয়া প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে নেমে এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই সরকার। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহিংস প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলা ও পৃথিবীর অনেক দেশের মতই বাংলাদেশেও জনগণের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর জন্য বিনিয়োগ বন্ধ করার দাবি তোলেন।
নারী সংহতির সাধারন সম্পাদক অপরাজিতা চন্দ বলেন, সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আছে বাংলাদেশের জনগণ। তিনি উল্লেখ করেন, কাশ্মীরের পরিস্থিতির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির কোন পার্থক্য নেই। এই দুটো অঞ্চলই সেনা শাসনের আওতাধীন হিসেবেই আছে। ফলে রাষ্ট্রীয় মদদ ও উস্কানিতেই পাহাড়ে গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নিপীড়নের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। তিনি আরো কিছুদিন পরে হয়তো তনু নামটিরও বিলুপ্তি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
তিনি আরও বলেন, যেভাবে শ্লেষাত্মক বক্তব্য ও প্রোপাগা-ার মধ্য দিয়ে খুব সচেতনভাবে পাহাড় ও সমতলের জণগণের মধ্যে বিভাজন তৈরী করে রাখা হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, যা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য ছড়া আর কিছুই নয়।
তিনি পাহাড়ের সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে কোনভাবেই নারী মুক্তি সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন এবং নিজের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত পাহাড় ও সমতলে সরকারের দ্বিমুখী নীতির প্রশ্নে বলেন, পাহাড় বরাবরই দ্বৈত শাসনের শিকার। বর্তমান সময়ের মত কখনো শোষণ মাত্রা এতটা তীব্র ছিল না। পাহাড়ে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের কোন সুযোগ নেই, যারা মতপ্রকাশ করতে চাই তাদেরকে বিভিন্ন দমনমুলক পদ্ধতিতে থামিয়ে দেওয়া হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, নারী কখনো ভোগ্যবস্তু নয়, নারীরাও মানুষ। সুতরাং নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা ভয়াবহ অপরাধ।
আলোচনায় আলোচকগণ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, সরকারের দমন-পীড়ন, দুর্নীতি-অনিয়মসহ বিভিন্ন বিষয়েও আলোকপাত করেন।