শুক্রবার ● ১৩ আগস্ট ২০২১
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » অবচাঁন রাজার গবচাঁন মন্ত্রীর গল্প
অবচাঁন রাজার গবচাঁন মন্ত্রীর গল্প
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: পাশাপাশি দুটি দেশ, যেমন মায়ানমার (বার্মা) আর বাংলাদেশ।
উদাহরন স্বরুপ বাংলাদেশের মধ্যে দুজন বন্ধু ছিলো, শম্ভু আর আবু।
শম্ভু ছিলেন পেশায় শিক্ষক আরেকজন আবু পেশায় কামার। দুই বন্ধু মিলে একদিন পরামর্শ করলেন তাদের দেশে ভোটাধীকার নাই আর কর্মসংস্থানের অভাব এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। এসব থেকে বাঁচতে তারা দুজনে মিলে বাংলাদেশের পার্শবর্তী দেশ মায়ানমারে চলে গেলেন।
সেখানে গিয়ে দেখেন চাউলের কেজি দশ টাকা আটার কেজি দশ টাকা, মাছ মাংস সব্জি গহনা ইত্যাদির সবকিছুর মূল্য দশ টাকা দরে। আবু-কামার এসব দেখে অত্যন্ত খুশি হয়ে তার শম্ভু-শিক্ষক বন্ধুকে বললেন, এমন দেশ আর পৃথিবীতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা, বন্ধু আমরা দুজন মিলে এখানেই থেকে যায়। শম্ভু-শিক্ষক বন্ধু বললেন, নারে বন্ধু এদেশে কোন বিচার নাই, যে দেশে পানির মূল্য দুধের মূল্য চাউলের মূল্য একই দাম সেদেশ তো অবিচারের দেশ, যে দেশে কোন বিচার নাই। এ কথা শুনে কামার বন্ধু –শম্ভু-শিক্ষককে বললেন, তাহলে তুমি দেশে চলে যাও আমি ঘি-য়ে ভাজা পরোটা খাবো, আমার কামার কাজ করে জীবন যাপন করবো। বন্ধুর মুখে একথা শুনে শম্ভু-শিক্ষক বন্ধু অনেকটা হতাশ হয়ে আবু-কামার বন্ধুকে ছেড়ে দুদেশের মাঝামাঝি সীমান্ত এলাকায় গিয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবণ শুরু করলো।
আবু- কামার যে দেশে বসবাস করছিলো সে দেশের রাজার নাম অবচাঁন আর মন্ত্রীর নাম ছিলো গবচাঁন। অবচাঁন রাজার দেশে অভাব নিত্য সঙ্গী। সে দেশে আশু নামের এক ধর্মীয় পুরোহীত ছিলো। পুরোহিতের স্ত্রী-বৃথী একদিন একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। পুত্র সন্তান জন্মের পর বৃথী ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে তার স্বামীকে বলল, দেখো রাজভান্ডারে অনেক অনেক চাউলের বস্তা আছে, তুমি যদি সেখান থেকে একবস্তা চাউল নিয়ে আস আর সে চাউল রান্না করে ভাত খেলে আমার বুকে দুধ হবে আর বুকের দুধ শিশুটি খেলে তার প্রাণ রক্ষা পাবে, অন্যতাই সে মারা যাবে। একথা শুণে আশু-পুরোহিত রাজবাড়ীর দিকে রওনা করেন এবং অনেক ভোরে রাজভান্ডারে প্রবেশ করে একবস্তা চাউল নিয়ে বের হয়ে আসার সময় অবচাঁন রাজার কতোয়াল তাকে ধরে ফেলে। চাউল চুরির অপরাধে পুরোহিত আশুকে রাজ দরবারে হাজির করা হয়। অবচাঁন রাজা রাজভান্ডার থেকে চাউল চুরির কথা শুনে পুরোহিতের উপর অত্যন্ত খেপে গেলেন আর বলেন, পুরোহিত তোমার এতবড় সাহস আমার রাজভান্ডার থেকে চুরি কর ? তাৎক্ষনিক রাজা গবচাঁন মন্ত্রীকে নির্দেশ দিলো এই পুরোহিতকে শূলে চড়িয়ে পুরোহিতের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে। অবচাঁন রাজার এই আদেশ শুনে পুরোহিত বলেন, হুজুর আমার একটা আর্জি ছিলো, রাজা বলেন বলো কি তোমার আর্জি? পুরোহিত বলেন হুজুর আমি তো স্বেচ্ছায় চাউল চুরি করতে আসিনি, আমার স্ত্রী বৃথীর কথায় আমি এ চাউল চুরি করতে এসেছি। রাজা বললেন তাহলে তো পুরোহিত অপরাধী নয়, অপরাদী হচ্ছে তার স্ত্রী, কোতোয়াল পাঠিয়ে পুরোহিতের স্ত্রী বৃথীকে ধরে আনার আদেশ দিলেন, আদেশ পেয়ে পুরোহিতের স্ত্রীকে রাজ দরবারে হাজির করা হলো। অবচাঁন রাজা গবচাঁন মন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন চাউল চুরির অপরাধে পুরোহিতের স্ত্রীকে শূলে চড়ানো হোক। একথা শুনে পুরোহিতের স্ত্রী বললেন, হুজুর আমার একটি কথা আছে, রাজা বললেন কি কথা বলো! পুরোহিতের স্ত্রী-বৃথী বলেন হুজুর আমি কেন চাউল চুরি করতে বলেছি সেকথা খুলে বলছি। গত তিনদিন আগে আমাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে, শিশুটির জন্মের পর থেকে আমি উপোষ, আমি খেতে না পারায় শিশুটি বুকের দুধ পাচ্ছেনা। নবজাত শিশুটির জীবন বাঁচাতে আমি পুরোহিতকে বলেছি- আমি দুমুঠো ভাত খেতে পারলে আমার নবজাত শিশুটি বুকের দুধ পাবে। একথা শুনে অবচাঁন রাজা বলল তাহলে তো আসল অপরাধী শিশুটি। মন্ত্রী গবচাঁনকে নির্দেশ দিলো এখনি পুরোহিতের বাড়ীতে গিয়ে পুরোহিতের শিশুটি ধরে আনা হোক এবং তাকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হোক।
একথা শুনে কোতোয়ালরা নবজাতককে এনে শুলে চড়াতে গেল। এসময় বিপত্তি বাধলো নবজাতক শিশুটির মলদার অনেক ছোট আর শূলের মাথা (লোহা দন্ড) অনেক বড় হওয়ায় তাকে শূলে চড়ানো যাচ্ছেনা। নবজাতক শিশুটি তো আর কথা বলতে জানেনা, গবচাঁন মন্ত্রী এসে অবচাঁন রাজাকে বললো হুজুর, এই শিশুটির মলদ্বার দিয়ে তো শূল যাচ্ছেনা, একথা শুনে রাজা মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন কি করা যায়….কিছুক্ষন চুপ থেকে রাজা অবচাঁন মন্ত্রী গবচাঁনকে নির্দেশ দিলেন আমার দেশের মধ্যে যার নিতম্ব (পাছা) সবচেয়ে বড় তাকে ধরে আনা হোক। একথা শুনে সারাদেশে রাজার কোতোয়াল সৈন্য বের হয়ে পরলো, সারাদেশ খুজে একমসয় কোতোয়ালরা খুজে পেল সবচেয়ে বড় নিতম্বের অধিকারী শিক্ষকের বন্ধু কামার আবুকে।
এই সংবাদটি মন্ত্রী গবচাঁন রাজার কাছে পৌঁছে দিলেন, খবর পেয়ে রাজা মহাখুশি। রাজা মন্ত্রীকে বললো সারাদেশে ঢেড়ি পিটিয়ে দাও, আগামী তিনদিন পর সূর্যাস্তকালীন এই আবু কামারকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে।
এই ঘোষনা কামারের বন্ধু শিক্ষক শম্ভুর শুনে হতাশ হয়ে কামার আবুর সাথে গিয়ে দেখা করলো। আবু-কামার বললো দেখ বন্ধু আমি কোন অপরাধ করিনি, কেবলমাত্র আমার নিতম্ব (পাছা) বড় হওয়ার কারণে রাজা আমাকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদন্ড ঘোষনা করেছে, এতো অন্যায় আর অবিচার। শিক্ষক বন্ধু বললো, তুমি তো ঘি-য়ে ভাঁজা পরোটা খাওয়ার লোভে এদেশে রয়ে গেলে, আর ঘিয়ে ভাজা পরোটা খেতে খেতে এক সময় তোমার নিতম্ব (পাছা) বড় করে ফেলেছো! তোমাকে আমি আগেই বলেছি যেদেশে তেলের দাম আর পানির দাম সমান, সেদেশে ন্যায় বিচার থাকতেই পারেনা। আবু- কামার বলে বন্ধু তোমার কথা না শুনে আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি, আরেক দিন পরে রাজার সৈন্যরা আমাকে নিয়ে শূলে চড়িয়ে দিবে বন্ধু আমাকে বাঁচাও। বন্ধুর এই দুঃখের কথা শুনে শম্ভু-শিক্ষক বলল দেখি আমি কি করতে পারি।
শিক্ষক বন্ধুটি পরেরদিন ভোরবেলায় গিয়ে রাজ দরবারে ঘন্টি বাজাতে থাকে। ঘন্টির আওয়াজ শুনে রাজা কোতোয়ালকে বলল দেখোতো রাজ দরবারে কে যেন এসেছে। কোতোয়াল রাজদরবারে গেইটে গিয়ে দেখে একজন লোক ঘন্টি বাজাচ্ছে। কোতোয়াল তার পরিচয় জানতে চাইলে শম্ভু জানাল সে একজন শিক্ষক এবং সে রাজার সাথে দেখা করতে চায়। একথা কোতোয়াল রাজাকে গিয়ে বললো হুজুর একজন শিক্ষক এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে চান। রাজা বললেন ঠিক আছে ঐ শিক্ষককে আমার কাছে নিয়ে আস। রাজ দরবারে প্রবেশ করে শিক্ষক রাজাকে বললেন হুজুর আপনার সাথে আমার গোপন কথা আছে, সবাইকে একটু সরে যেতে হবে। শম্ভুর একথা শুনে রাজা কিছুক্ষনের জন্য সবাইকে দুরে সরে যেতে আদেশ দিলেন।
সবাই যখন আড়ালে গেল, শম্ভু (শিক্ষক) রাজার দুই পা জড়িয়ে ধরে বললেন হুজুর আগামীকাল সূর্যাস্তের পরে যে শূলে চড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন সেই শূলে আমাকে চড়ানো হোক এবং আমার মৃত্যুদন্ড শূলে চড়িয়ে কার্যকর করার আদেশ দিন।
রাজা কিছুটা আশ্চার্য হয়ে প্রশ্ন করলো সেই শূলে তো চড়ানোর কথা আবু-কামারকে তুমি কেন অযথা শূলে চড়ে মরতে চায়ছো ? রাজা মনে-মনে ভাবলো স্বেচ্ছায় শূলে চড়ে মৃত্যুদন্ড বরনের আসল রহস্য কি হতে পারে! সেই রহস্য উদঘাটনের জন্য রাজা শিক্ষককে বলল আসল ঘটনা আমাকে খুলে বল, তারপর আমি ভেবে দেখবো। শিক্ষক তখন কৌশল অবলম্বন করে রাজাকে বললেন হুজুর আমি গতরাত্রে স্বপ্নে দেখেছি এই চলমান তিথিলগ্নে সূর্যাস্তের সময় শূলে চড়ে যার মৃত্যু হবে সে এরকম দেশের মত আরো তিনটি দেশের রাজা হবে এবং শুয়ে শুয়ে স্বর্গের মেওয়া উপভোগ করবে।
শিক্ষকের একথা শুনে রাজা মনে-মনে ভাবতে থাকে একটি দেশের রাজা হয়ে আমার এত সুখ, তিনটি দেশের রাজা হলে না জানি আরো কত সুখ! একথা ভেবেই রাজা শিক্ষককে বলল তুমি একজন শিক্ষক তুমি এসব রাজকার্যের কি বুঝবে ? রাজ্য তুমি চালাতে পারবেনা। রাজা তখন মন্ত্রী গবচাঁনকে ডেকে বললো সেই কামারকে শূলে চড়ানোর দরকার নেই, আমি নিজেই সেই শূলে চড়বো। পরের দিন সূর্যাস্তের সময় হাজার-হাজার লোক সমাগমের ভিড়ে ক্ষমতা লোভী রাজা নিজে শূলের সামনে গিয়ে মন্ত্রীকে বললো মন্ত্রী আমাকে শূলে চড়াও। একথা শুনে মন্ত্রী বললো হুজুর এ শূলে চড়লে তো আপনি মৃত্যু বরন করবেন, রাজা বললো রাখ তোমার নীতিকথা, আমি রাজা আমার শূলে আমাকে চড়াও। একটি রাজ্যর রাজা হয়ে এত সুখ আর শূলে চড়ে মৃত্যু হলে তিনটি রাজ্যর রাজা হবো, না জানি কত সুখ পাবো।
একথা শুনে মন্ত্রী মনে-মনে ভাবলো এই অবিচারী রাজার হাত থেকে দেশ এবং দেশের জনগণকে বাঁচাতে এটাই মোক্ষম সুযোগ।
গবচাঁন মন্ত্রী তখন কোতোয়ালদের নির্দেশ দিলো অবচাঁন রাজাকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার। শূলে চড়ে ক্ষমতা লোভী অবচাঁন রাজার মৃত্যু হলো, সেই সাথে সেই দেশ থেকে বিদায় নিলো অপশাসন আর অবিচার।
দেশের জনগণ অবচাঁন রাজার মৃত্যুর পর শান্তিতে-সুখে বসবাস করছে।
(লেখাটি কাল্পিনিক এবং এটি কেবলমাত্র রম্যরচনা)।
লেখক : নির্মল বড়ুয়া মিলন
মূখ্য সম্পাদক
সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম।