বুধবার ● ১৬ মার্চ ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » শিশুরা মায়ের কোলেও নিরাপদ নয়
শিশুরা মায়ের কোলেও নিরাপদ নয়
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে দুই ভাই-বোন অরণী ও আলভী হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। যেখানে মায়ের কাছে নিজের সন্তানরা নিরাপদ নয়, তাহলে সন্তানদের নিরাপত্তা কোথায় ? এসব ভাবতেও অবাক লাগে।
বনশ্রী বি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় মৃত্যু ঘটে নুসরাত আমান অরণী (১৪) ও আলভী আমান (৬) নামে ওই দুই ভাই-বোনের। নিহতদের পিতা আমান উল্লাহ আমান একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও মাহফুজা মালেক জেসমিন গৃহিণী দম্পতির সন্তান।
অরণী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণী এবং তার ভাই আলভী হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের নার্সারি শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলো । রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে দুই ভাই-বোন অরণী ও আলভী হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। জবানবন্দি প্রদান শেষে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন আদালত।
গত রোববার দুপুরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. গোলাম নবীর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন জেসমিন । এরপর আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
চলিত মাসে ৯ মার্চ থেকে জেসমিনকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সন্তানদের হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে চাওয়ায় রিমান্ড শেষে রোববার সকালে তাকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক লোকমান হাকিম।
আদালতের রামপুরা থানার কোর্ট পরিদর্শক (জিআরও) মুকুল জেসমিনের জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত ৪ থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত জেসমিনকে আরও পাঁচদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে রামপুরা থানা পুলিশ। সে অবস্থায় মামলাটির তদন্তভার ডিবি পুলিশের হাতে ন্যস্ত হলে আসামিকে হস্তান্তর করেন তারা।
স্বজনেরা খাবারের বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করলেও পরে ময়না তদন্তে জানা গেছে, দুই ভাই-বোনকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।
স্বজনদের দাবি ছিল, গত ২৮ ফেব্রুয়ারী রাতে পরিবারটি রেস্টুরেন্টে খেয়ে চায়নিজ খাবার বাসায় নিয়ে আসে। ২৯ ফেব্রুয়ারী দুপুরে বাবার নিয়ে আসা ওই চায়নিজ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে দুই ভাই-বোন অরণী ও আলভী। কিন্তু সন্ধ্যায় দীর্ঘ সময় ডাকার পরও না জাগায় অচেতন অবস্থায় তাদের ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
কিন্তু ময়না তদন্ত শেষে ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস ১ মার্চ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দু’জনের শরীরেই আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অরণীর চোখে রক্ত জমাট ও গলায় আঘাত এবং আলভীর পায় ও গলায় আঘাত রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে’।
ময়না তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে র্যাব। অরণী-আলভীকে দাফন শেষে ২ মার্চ জামালপুরে থাকা তাদের বাবা-মা-খালাকে ঢাকায় নিয়ে এসে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব-৩। পরদিন ৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব জানায়, মা জেসমিনই সন্তানদের হত্যা করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এটি স্বীকার করেছেন।
ওইদিনই (৩ মার্চ) র্যাব মাহফুজা মালেক জেসমিনকে পুলিশে হস্তান্তর করলে শিশু দু’টির বাবা আমান উল্লাহ আমান তাকে একমাত্র আসামি করে রামপুরা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, মা জেসমিন সন্তানদের স্কুলের পরীক্ষার ফলাফল এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। তার ধারণা ছিলো, তার সন্তানরা বড় হয়ে কিছুই করতে পারবে না। তাই তিনি ২৯ ফেব্রুয়ারী গৃহশিকিক্ষা চলে যাওয়ার পর বিকেল সোয়া ৫টার দিকে মেয়ে অরণীকে নিয়ে নিজের ঘরে ঘুমাতে ডাকেন। একই সময়ে ছেলে আলভী বিছানাতেই ঘুমাচ্ছিলো। জেসমিন ছেলের সঙ্গে একই বিছানায় শুয়েছিলেন। অরণী মায়ের সঙ্গে ঘুমানোর জন্য বিছানায় শোওয়ার কিছু সময় পর মা জেসমিন তার মেয়ে অরণীকে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেন। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে মা-মেয়ে দু’জনেই বিছানা থেকে মেঝেতে পড়ে যান।
কিছু সময় পর মেয়ের শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলে তিনি তার ছোট ছেলে আলভীকে খাটের ওপর ঘুমন্ত অবস্থায় একইভাবে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি মরদেহ দু’টির সামনে কিছু সময় ধরে কান্নাকাটি করেন বলেও স্বীকারোক্তি দেন।
পরে এ হত্যাকান্ড লুকাতে তিনি নিজেই একটি গল্প তৈরি করেন। সেই অনুযায়ী সাজিয়ে গুছিয়ে প্রচার করেন, দুপুরে খাবার খেয়ে ঘুমানোর পর তার ছেলে-মেয়েরা আর ঘুম থেকে ওঠেনি। খাবারে বিষক্রিয়ার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
গত ২ মার্চ নিহত দুই শিশুর ব্যবহৃত চাদর, বালিশের কাভার, টিস্যু ও কম্বলের ডিএনএ প্রোফাইল এবং চায়নিজ খাবার ও পানির বোতলের রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য সিআইডিকে অনুমতি দেন আদালত।
যে রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে দুই ভাই-বোন মারা গিয়েছে বলে পরিবার থেকে বলা হয়েছিল, সেই কিন্ট চায়নিজ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মাসুদুর রহমান, বাবুর্চি আছাদুজ্জামান রনি ও তার সহযোগী আতাউর ৫৪ ধারায় গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে । ওই তিনজন ছাড়াও র্যাব-৩ এ ঘটনায় ভাই-বোনের গৃহ শিকিক্ষা শিউলি আক্তার (২৮), খালু নজরুল ইসলামের ভাগনে শাহিন (২২), মেয়ের মার মামাতো ভাই মো. ওবায়দুর ইসলাম (৩৪), বাসার দুই দারোয়ান পিন্টু মন্ডল (৩২) ও ফেরদৌসকে (২৮) জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
গতকাল সোমবার ময়মনসিংহের নান্দাইলে বীথি নামে ১৭ মাসের এক শিশুর পেটে ছুরিকাঘাত করেছে মানুষ নামের কোন এক জঘন্য অমানুষ।
তাহলে কি মিথ্যা হয়ে গেল সেই সুন্দর বাক্যটি “ বন্যরা বনে সুন্দর আর শিশুরা মায়ের কোলে”। পৃথিবীতে সব চেয়ে নিরাপদ স্থান মায়ের কোল কিন্তু আজ শিশুরা মায়ের কোলেও নিরাপদ নয়।
মাহফুজা মালেক জেসমিন একজন মায়েদের নামের কলঙ্ক ।