শনিবার ● ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২২
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » পার্বত্য অঞ্চলে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান থাকলেও সফলতা লাভ করেনি
পার্বত্য অঞ্চলে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান থাকলেও সফলতা লাভ করেনি
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো এবং সাদরি এই ৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে যা ২০১৭ সাল থেকে বিদ্যালয়ে প্রবর্তন করা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তথ্য মতে, এরই ধারাবাহিকতায় চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় উল্লিখিত ৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় তৃতীয় শ্রেণির শিশুদেরজন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়। যা প্রতি বছর সারা দেশে সকল শিক্ষার্থীর নিকট বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
২০২০ সালের ১লা জানুয়ারি তারিখ পাঠ্যপুস্তকগুলো শিশুদের হাতে পৌছে দেয়া এবং বিদ্যালয়ে প্রবর্তন করার দাবি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
বাংলায় মাতৃভাষা শিক্ষার সাথে সাথে অতিরিক্ত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো এবং সাদরি ভাষা শিক্ষার সুযোগ তৈরী হয় কোমলমতি শিশুদের। এই ৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষার বিষয়ে অভিবাবকদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর প্রায় ৫০% এসব জনগোষ্ঠীর লোকজনের বসবাস রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায়। এর মধ্যে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা হচ্ছে চাকমা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা হচ্ছে ত্রিপুরা এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা হচ্ছে মারমা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রধান্য বা সার্কেল।
রাঙামাটি জেলায় ১০ উপজেলায় অনুসন্ধান করে জানা গেছে, জেলার প্রতিটি উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমুহে প্রাক-প্রাথমিক (শিশু শ্রেণি) থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিশুদেরজন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষার জন্য নির্ধারিত কোন শিক্ষক নাই।
একজন চাকমা বা মারমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষক হলেই তিনি মারমা অথবা চাকমা ভাষায় পাঠ্যদান করা সম্ভব নয়, কারণ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো এবং সাদরি ভাষার বর্ণমালা ভিন্ন-ভিন্ন ও উচ্চারণ আলাদা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা তাদের পাঠ্যপুস্তকের সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় বই হাতে পাওয়ার পর থেকে অভিবাবকদের মধ্যে উৎকন্ঠা বেড়ে গেছে, বৈশি^ক মহামারির কারণে দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ, তার ওপরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার বর্ণমালা শিক্ষার শিক্ষক নাই, বছর শুরু হয়ে গেছে, তাদের শিশুদের মধ্যে দেয়া হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় বই।
এবিষয়ে রাঙামাটি প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইষ্টটিটিউট (পিটিআই) সুপারিনটেনডেন্ট মোহাঃ রবিউজ্জামান বলেন, চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় আমরা এখনো কোন প্রশিক্ষণ শুরু করিনি। শুনেছি, রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সংস্কৃকিত ইষ্টটিটিউট চাকমা ভাষায় একবার কিছু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
তিনি রাঙামাটিতে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুতা¡রোপ করেন।
এবিষয়ে রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জেলার ১০টি উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিক (প্রতি ছাত্রের জন্য ২টি করে বই), চাকমা- ৬৪০১, মারমা-১০০৪, ত্রিপুরা- ৪১০, মোট ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা-৭৮১৫, প্রাক-প্রাথমিক মোট বই বিতরণ ১৫৬৩০।
প্রথম শ্রেণি (প্রতি ছাত্রের জন্য ৩টি করে বই), চাকমা- ৫৪৫৮, মারমা-১০৬৮, ত্রিপুরা- ৪৯৭, মোট ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা-৭০২৩, প্রথম শ্রেণি মোট বই বিতরণ ২১০৬৯।
২য় শ্রেণি (প্রতি ছাত্রের জন্য ৩টি করে বই), চাকমা- ৫৩৫৮, মারমা-১০২৫, ত্রিপুরা- ৪৬৬, মোট ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা-৬৮৪৯, ২য় শ্রেণি মোট বই বিতরণ ২০৫৪৭।
৩য় শ্রেণি (প্রতি ছাত্রের জন্য ১টি করে বই), চাকমা- ৫৪৮৭, মারমা-১১৪৮, ত্রিপুরা- ৪২৪, মোট ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা-৭০৫৯, ৩য় শ্রেণি মোট বই বিতরণ ৭০৫৯। সর্বমোট- ৬৪৩০৫টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন জেলায় চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষায় শিক্ষক এর অপ্রতুলতার কথা স্বাকীর করেন।
গত ১৬ জানুয়ারি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সভাকক্ষে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং মাতৃভাষায় শিক্ষাদান বিষয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছাত্র ছাত্রীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান থাকলেও খুব বেশি সফলতা লাভ করেনি। এ কার্যক্রমকে বেগবান করার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী।
মাতৃভাষায় শিক্ষাদান বিষয়ে মতবিনিময় সভায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের শিক্ষা কমিটির আহ্বায়ক প্রিয় নন্দ চাকমা, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাঃ আশরাফুল ইসলাম, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন, পিটিআই এর সুপার মোহাঃ রবিউজ্জামান, শিক্ষাবিদ প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউটের সাবেক পরিচালক সুগত চাকমা এবং খাগড়াছড়ি,বান্দরবান জেলা থেকে আগত মাতৃভাষা প্রশিক্ষকরা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার ১০ উপজেলার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাবৃন্দ, প্রাথমিক শিক্ষকবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং মাতৃভাষা বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণ করেন।
এবিষয়ে প্রতিটি বিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ, বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ক্লাস রুটিনে মাতৃভাষা বিষয়টি অন্তর্ভুক্তকরণ, মূল্যায়নের ব্যবস্থাকরণ এবং জেলা পর্যায়ে তত্ত্বাবধানে একটি সেল গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা অনুরাগী, অভিবাবক ও শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।